কৃষি

বাংলার দিঘি বাংলার জল || তাপস রায়

ধর্মসাগর দিঘি  প্রাচীন ত্রিপুরার মহারাজা ধর্মমাণিক্য ধর্মসাগর দিঘি খনন করেন। দেশের প্রাচীন এই দিঘির আয়তন প্রায় ৯.৩৮১ হেক্টর। স্বচ্ছ চকচকে পরিস্কার পানির এই দিঘির চারপাশ পাকা করা। দিঘির জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। দিঘিটি যে কারও নজর কাড়বে। শুরুতে দিঘির মাঝখানে একটি মাটির ঢিবি ছিল। যদিও এর কারণ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। দিঘির পূর্ব পাড়ে কুমিল্লা স্টেডিয়াম। উত্তরে রয়েছে কুমিল্লা পৌরপার্ক। পার্কের বিভিন্ন জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বসার জায়গা। ফলে পর্যটকেরা চাইলে সেখানে বসে বিশ্রাম করতে পারবেন। এ ছাড়া যে কেউ চাইলে দিঘিতে রাখা নৌকায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এ জন্য ঘণ্টাপ্রতি গুণতে হবে প্রায় একশ টাকা। দিঘির স্বচ্ছ পানিতে ভেসে ভেসে পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে মন্দ লাগবে না। শীতকালে এই দিঘির চারপাশে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

 

গঙ্গাসাগর দিঘিকয়েকশ বছর আগের ঘটনা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ঈশ্বরচন্দ্র মানিক বাহাদুর কুমিল্লায় কর আদায় করতে আসতেন। তখন এ অঞ্চলে এবং এর আশপাশে পানির সুব্যবস্থা ছিল না। এলাকায় পানির অভাব দেখে রাজা চিন্তিত হন। তখন তিনি দিঘি খনন করার কথা ভাবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খনন করা হলো বিশাল দিঘি। শুধু টলটলে পানির দিঘি নয়, এর উত্তর পাশে রাজা একটি সান বাঁধানো ঘাটও তৈরি করে দিলেন। এর নাম রাখা হলো ‘গঙ্গাসাগরের ঘাট’। রাজা সময় পেলেই ঘাটে এসে বসতেন। শীতল হাওয়া রাজার বিক্ষিপ্ত মনকে শ্রান্ত করত। রাজা দিঘির নাম রাখলেন দেবী গঙ্গার নামানুসারে। দিঘির পাশে রাজা কর আদায়ের জন্য তফসিল কাচারি তৈরি করেছিলেন। যদিও এখন সেই কাচারিঘর নেই। এক সময় এই দিঘির পাশেই ছিল ত্রিপুরা ব্যাংক। এখন সেটিও নেই।

দুর্গাসাগর দিঘিরানী দুর্গাবতী ছিলেন রাজা শিব নারায়ণের স্ত্রী। রাজার মৃত্যুর পর রানী নিজেই রাজ্য পরিচালনার ভার নেন। প্রজাহিতৈষী হিসেবে রাজমাতা দুর্গাবতীর পরিচিতি ছিল। প্রজাদের সুবিধার্থে ১৮৭০ সালে তিনি রাজকোষ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে  একটি দিঘি খনন করেন। তার নামানুসারে দিঘির নামকরণ করা হয়। জনশ্রুতি আছে, পেছন ফিরে না তাকানোর প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী রাজমাতা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যতদূর হেঁটে যেতে পারবেন ততদূর পর্যন্ত তিনি দিঘি খনন করার ঘোষণা দেন। ৬১ কানি জমি অতিক্রম করার পর ঘোড়ার ডাকের শব্দে, আবার অনেকে বলেন রাজ কর্মচারীদের ঢাক বাজানোর শব্দে রানী দুর্গাবতী পেছন ফিরে তাকান। পরবর্তীতে সেই স্থানজুড়ে তিনি দিঘি খনন করেন।

 

কমলা রানীর সাগরদিঘিপল্লীকবি জসিমউদদীন এই দিঘি দেখতে এসে পাড়ে বসে লিখেছিলেন :‘কমলা রানীর দীঘি ছিল এইখানে, ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তাদের পানে।আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী বধূর দল, কমলা রানীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল।’

নীলসাগর দিঘিবহু আগে এর নাম ছিল ‘বিরাট দিঘি’ বা ‘বিরনা দিঘি’। সেখান থেকে নামটি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘বিন্না দিঘি’। এই নামের পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। ঐতিহাসিকদের মতে, বিরাট নামক এক রাজা এই দিঘি খনন করেছিলেন। যারা ‘মহাভারত’ পড়েছেন তারা এই রাজার নাম শুনে থাকবেন। পঞ্চপান্ডব কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হয়। পান্ডবরা তখন অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট রাজার রাজ্যে এই স্থানটিতে ছদ্মবেশে বাস করতে থাকে। পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতেই রাজা বিরাট এই দিঘি খনন করেন।

রামসাগর দিঘিনামে সাগর হলেও এটি আসলে একটি দিঘি। দেশের অন্যান্য আর সব দিঘির মতোই এটিও তৈরি করেছিলেন রাজন্য বর্গের মানুষেরা। রাজা রামনাথ এই দিঘি খনন করেন প্রজাদের সেচ সুবিধা ও পানির সমস্যা দূরীকরণের জন্য। এই দিঘি এত বড় যে, পায়ে হেঁটে দিঘির চারপাশে একবার ঘুরে আসা প্রায় অসম্ভব। যে কারণে দিঘির পাশ ঘেঁষে ইটের রাস্তা রয়েছে। দিঘির চারপাশে হাজার ধরনের গাছ রয়েছে। নাম না জানা পাখির কলরব আপনাকে মুগ্ধ করবে। আপনি চাইলে দিঘির পাড়ে বসে একটু জিড়িয়ে নিতে পারেন। দিঘির জল ছুঁয়ে আসা শীতল হাওয়া আপনার মন জুড়িয়ে দেবে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৫/তাপস রায়