কৃষি

আরভিনের আপেল বাগিচা

শাকুর মজিদ(মিরিকিনে : তৃতীয় কিস্তি) নুরুর বিছরায় (সিলেটী শব্দ, ছোট সবজি ক্ষেত বা বাগান) সুপারী গাছের আকারে একটা আপেল গাছও আছে এবং এই গাছে কয়েকটা আপেল লাল হয়ে পড়ে আছে কয়েকদিন ধরে। আপেলগুলো অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিদের। তাদের হাতের স্পর্শে আপেলগুলোর জীবনাবসান হবে, এমনটি ছিলো পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এক পর্যায় যখন ঘটছে তখন আমি ঘরের ভেতর থেকে দেখি এক কিশোর ক্যামেরা নিয়ে তাক করে আছে আর তার মধ্যবয়েসী জননী আপেলের গায়ে হাত দিয়ে রেখেছেন। ছবিটা তোলার জন্য হাত ফ্রিজ করে রাখা। ফটোগ্রাফার যখন নিশ্চিত করলেন যে ছবিটা তোলা হয়ে গেছে, তখন নিজ হাতে পাড়া আপেলটি মধ্যবয়স্কার দন্তগহ্বরে নিষ্পেষিত হতে শুরু করে। তার মুখাবয়বের মধ্যে বিবি হাওয়ার মতো ফূর্তির ভাব! হাওয়া বিবিও তো এই আপেল খেয়েছিলেন! নাকি অন্য কিছু?

 

আমেরিকানরা আপেল প্রিয়। বাইবেলে মাদাম ইভ তো এই আপেলই খেয়েছিলেন! আমেরিকানদের কাছে আপেল একটা প্রধান খাবারও। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে ডিনারে পর্যন্ত আপেলের রস, শরবত, পাই, এসবের কিছু তাদের চাইই। পৃথিবীতে বছরে ৮০০ কোটি টন আপেল উৎপন্ন হয়। চীনের পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আপেল উৎপাদক হচ্ছে আমেরিকা। গাছ থেকে এই আপেল মাটিতে পড়তে দেখেই কিন্তু আইজ্যাক নিউটন ভেবেছিলেন এটা উপরে না উড়ে, নিচে পড়তে গেলো কেনো?  তারপর তিনি জানান দিলেন- মহাকর্ষ তত্ত্ব, বল বিদ্যা, কত কিছু। শুধু নিউটনই নন, পৃথিবীর আকার বুঝাতে আপেলের কথা বলা হয়ে থাকে। আর স্টিভ জবস যে প্রডাক্ট উদ্ভাবন করে পৃথিবীকে একটি ছোট্ট গোলকের মধ্যে আটকে দিলেন, তার নামও দিলেন আপেল। আইফোন, আইপ্যাড, আইপড, ম্যাকিন্টস- এসবই তো এই আপেলের লগোটি বহন করে।

 

আপেল নিয়ে অতো কথাবার্তা শুনছি গত দুদিন ধরে। এসব শুনে নুরু বলে, আজ বিকেলে তোমাদের নিয়ে যাবো এক জায়গায়, দেখবোনে কত আপেল পাড়তে পারো।

 

আমেরিকার এই শহরে কেউ নিজের গাড়ি ছাড়া চড়ে বলে মনে হয় না। পাবলিক বাস চোখে পড়ে না, শহরের মধ্যে ট্রেন নাই। ঘরে ঘরে জনে জনে গাড়ি লাগে। আমি যাদের মেহমান হয়েছি, এই বাড়িতে চারজন থাকে, তিনজন প্রাপ্ত বয়স্ক, তিনজনই গাড়ির চালক, তাদের দুইখানা গাড়ি। তারপরও একজনকে নিয়ে আসা হয়েছে বাফেলো থেকে। আমাদের হায়ারি সোফার বাবলু ভাই।

 

গাছের তলায় পড়ে থাকা আপেল

 

আপেল বাগানে এসে আমাদের দলের বিশেষ করে নারী ও শিশু সদস্যরা অতিমাত্রায় উল্লসিত হয়েই পড়েন। হাত বাড়ালেই যেহেতু আপেলের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে শান্তি নাই। কষ্ট করে গাছ বাইতেই হবে। গাছগুলোও বামুনের মতো। দুই ফুট ওপরে উঠলেই গাছের মাঝডালে পৌঁছা যায়। এমন উচ্চতার গাছের ডালে উঠে আনন্দে নয় খানা হচ্ছেন তারা। গাছের ওপরে বসেই আপেল নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করে দিয়েছেন। এসবে এখন নির্দেশনা দিচ্ছেন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পর্যটক নুরজাহান। তিনি বলছেন, চাবিয়ে চাবিয়ে রস খেয়ে ফেলে দিতে হবে, তা না হলে বেশি খাওয়া যাবে না। আর আপেলের শাঁস খেয়ে পেট ভরানোর কোন প্রয়োজন নাই। সবার উদরের যা অবস্থা, তাতে ফর্মালিনমুক্ত এই আপেলও আপাতত দুটোর বেশি চাবানোর সুযোগ নেই। ব্যাগ আছে একটা এটা ভরা যাবে। এই ব্যাগটা নেয়া হয়েছে ১৭ ডলার দিয়ে। পুরো পরিবারের জন্য এই কী। আমরা দেখে দেখে গোল্ডেন আপেল দিয়ে ব্যাগ ভরে ফেলি। এক দুটো প্যান্টের, জ্যাকেটের পকেটে, এক দুটো হাতে। আমি চিন্তায় পড়ে যাই। এখানে ওদের লাভ কোথায়? লাভ ছাড়া আমেরিকায় কোথাও কোনো সার্ভিস নাই।

 

লন্ডনে দেখেছি রাজ পরিবারের দান-খয়রাত (চ্যারিটি)-এ কিছু জাদুঘর ফ্রি দেখা যায়, আমেরিকাতে ফলের খামার দেখিয়ে ফ্রি খাইয়ে দেবে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। ১৭ ডলার দিয়ে আমরা ৯ জন এসেছি। জন প্রতি দুই ডলারের কম খরচ। এ দিয়ে গাড়ি চড়িয়েছে ফ্রি। এখন আবার ওদের দেয়া ব্যাগ ভর্তি করে নিচ্ছি। ওজন প্রায় ৩০ পাউন্ড। দোকান থেকে কিনলে প্রতি পাউন্ড ৩ ডলারে কিনতে হবে। একশো ডলারে আপেল ১৭ ডলারে কেনো দেবে বুঝতে পারি না।

 

আমার সঙ্গী আমেরিকান বাঙালিরা বলেন অন্য কথা। বলেন, চাষবাসের জন্য আমেরিকা খুব উদার। নানা রকমের সুযোগ সুবিধা দেয়া থাকে। খাবার খেয়ে মানুষ যাতে তুষ্ট থাকে, আমেরিকা তার জন্য সব করে। এটা দেখানো এর অন্যতম উদ্দেশ্য। এটা ছাড়াও গেটের কাছে ওদের দোকান আছে। সেই দোকানে এই বাগানের আপেল দিয়ে বানানো নানা রকমের উপাচার আছে। এসবের মধ্যে আছে বিয়ার, ওয়াইন, পাই, টেট্রি, কেক, জ্যাম, জেলি এমনকি চাকসহ মধুও।

 

আমরা ঘণ্টা দুই সময় এখানে থাকি। শেষ বিকেলে শরৎকালের আমেরিকান আকাশে ফকফকা রোদে সাদা মেঘ আর নীল আকাশ এক ব্যঞ্জনাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। আমরা ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। লন্ডন থেকে রাসেলের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি একটা সেলফি স্টিক। এটা আমার প্রধান বিনোদন। ছবি তোলা এখন অনেক সহজ। নিজেকে আর আড়াল করার সুযোগ নাই। আমি নিজের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেই। একটা ছবি দেখে আমার বন্ধু ফজলে রাব্বী চট্টগ্রাম থেকে মন্তব্য করে। সে লিখেছিল- দোস্ত, তুই গাছের নিচে গিয়ে বসে থাক। মাথার উপর যদি বাইচান্স একটা আপেল পড়েই যায় তখন স্যার আইজ্যাক শাকুরের তিন সুত্র স্কুল সিলেবাসে যুক্ত হয়ে যাবে। রাব্বিকে তাঁর মন্তব্যেও কোন জবাব দেই না। আমি বরং সেলফি তোলা কমিয়ে দিয়ে দলের সঙ্গে স্টার্লিং হাইটস-এর দিকে ছুটে চলি।

 

৩ অক্টোবর, ২০১৫। স্টারলিং হাইটস, মিশিগান।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়