কৃষি

হিমু সেজে নুহাশপল্লীর সবুজ মায়ায়

মো. ওয়াহিদুল ইসলাম : সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো এবার পরীক্ষার জটপাকানো তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে হবে। কোথাও বেড়িয়ে আসা দরকার- এ কথা ভাবছিলাম শেষ পরীক্ষার আগের রাতে। বন্ধুদের ফোন দিলাম। পরদিন পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে সবাই একে একে জড়ো হলাম মুক্তমঞ্চের কাছে। শুরু হলো কোথায় যাওয়া যায় এ নিয়ে আলোচনা। অবশেষে খোঁজ পেলাম গন্তব্যের। সময় তারিখ ঠিক হলো বুধবার সকাল ৮টা ৩০মিনিট যাত্রা শুরু হবে। সেই সময় অনুযায়ী বাসে উঠলাম আমরা সবাই। গাড়ি চললো হইহুল্লোর আর আনন্দঘন মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে  আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।

 

রাস্তার দু’পাশে অনেকগুলো কারখানা। মনে হবে যানজট, শব্দ আর বায়ুদূষণের আবাসিক-বাণিজ্যিক জগাখিচুড়ির ভেতরেই আবর্তিত হচ্ছি। তাহলে এত দূর ছুটলাম কেন? এখানে শান্তি কোথায়? ধানের ক্ষেতে মিলেছে কারখানার গাঢ় নীল বর্জ্য-পানি। সবুজ আর নীলের ভালোই খেলা। কিছু দূর এগোলেই গ্রাম। সেই গ্রামের গহীনে মেঠো পথ গিয়ে মিলেছে নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদের সাধের নিবাস। আমরা এসেছি নুহাশপল্লী এখন কেমন আছে দেখতে।

 

গেটের বাইরে বিভিন্ন দেশী ফল নিয়ে বিক্রেতারা বসে আছে। পাশেই চায়ের দোকান। গরুর দুধের চা। গরুগুলো থাকে নুহাশপল্লীর ভেতর। দেখা যাক আর কী কী আছে?

 

 

শুকনো সুইমিং পুলের পাশেই রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের শোবার ঘর ‘হোয়াইট হাউস’ মাটি দিয়ে লেপা ঘরটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে আছে লতানো গাছপালা। সাধ আর সাধ্যের সবটুকু রং দিয়ে নুহাশপল্লীকে সাজিয়েছেন হুমায়ূন। যেমন মানুষ, তেমন তার সাধ। কাছাকাছি নীরব দাঁড়িয়ে আরেক নারী। রাতের নুহাশপল্লীকে আলোকিত করতে ল্যাম্প হাতে সতত দণ্ডায়মান, প্রস্তুত। নুহাশপল্লীতে এ রকম অনেক ভাস্কর্য রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।

 

নুহাশপল্লীর মাঝখানে ঘাসের বিশাল চত্বর। সবুজের কার্পেটে দাঁড়িয়ে নুহাশপল্লীর দিনযাপনের সাক্ষী জাপানি বট গাছটি। আরো রয়েছে দাবার ঘরসহ বড় বড় গুটি। শিশুদের খেলার জন্য ঘরটি তৈরি করা হয়। মাঠ ধরে এগিয়ে গেলে শেফালি গাছের ছায়ায় নামাজের স্থান। মায়ের জন্য নামাজের জায়গা তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন। সামনে খোলা বারান্দা নিয়ে ‘বৃষ্টিবিলাস’। হুমায়ূনের ‘আমার আছে জল’ বা ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সিনেমার অনেক দৃশ্যে বৃষ্টিবিলাস দেখা যায়।

 

প্রিয়জনের খোঁপায় কদম গুঁজে সবুজ মাঠে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য প্রাণভরে দেখতেই হুমায়ূন তৈরি করেছেন বৃষ্টিবিলাস। এখানে কখনো রাত্রিযাপন করেননি তিনি। বৃষ্টি এলে এখন আর কেউ আয়োজন করে বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় বসেন না। হুমায়ূন চলে যাওয়ার পর সিনেমা জগতের বন্ধুদের আড্ডাও বসে না বৃষ্টিবিলাসে। নুহাশপল্লীতে ছোট করে তৈরি আছে পদ্মপুকুর। হয়তো অনেক বছর পর যখন পদ্মফুল বিরল হবে, তখন সন্তানদের দেখাতেই এ পদ্মপুকুর তৈরির প্রয়াস। পদ্মপুকুরের মাঝখানে ‘জলপরী’ অবনত মুখে নীরব দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন রূপকথার জলপরী সত্যি হয়ে ধরা দেয় পদ্মপুকুরে। তারই সামনে বিশাল ‘দানবীয় দৈত্য’। সব অপকে বিনাশ করতে সে রাক্ষস সদা বিরাজমান।

 

নুহাশপল্লীর ভিতরে রয়েছে জুরাসিক পার্ক, সেখানে রয়েছে হাতি, ডাইনোসর বা বাঘের মাথা। এ ছাড়া কিছু দোলনা রয়েছে। নুহাশপল্লীর আরেক দৃষ্টি-আকর্ষক লিচু গাছের ওপর ‘ট্রি হাউস’। ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ সিনেমার কয়েকটি দৃশ্যে এ ঘরটি দেখতে পাওয়া যায়।

 

 

হুমায়ূন-শাওন দম্পতির প্রথম সন্তান লীলাবতী। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বিদায় নেয়। আট মাস বয়সে মায়ের গর্ভেই মারা যায়। লীলাবতীকে স্মরণে রাখতেই নুহাশপল্লীর উত্তর প্রান্তে হুমায়ূন খনন করেন শানবাঁধা দিঘি ‘লীলাবতী’। দিঘির বুকে বসানো কাঠের সেতু। সেতু দিয়ে ‘দ্বীপ বিলাস’ যাওয়া যায়। এটি কৃত্রিম দ্বীপ। লীলাবতীর পাড়েই ‘ভূতবিলাস’ দাঁড়িয়ে। হুমায়ূন বলতেন, নুহাশপল্লীর গাছপালা ভূতদের জন্যই বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। বোধকরি সে জন্যই এখানে গাছের এক সমৃদ্ধ সমাহার গড়েছিলেন তিনি। ৩০০ প্রজাতির ফলজ, বনজ গাছের পাশাপাশি এখানে রয়েছে বিরল ঔষধি গাছ।

 

আমৃত্যু আড্ডাবাজ হুমায়ূন বড় ভয় পেতেন নিঃসঙ্গতা। হয়তো সেজন্যই আস্থা রেখেছিলেন মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু গাছেদের ওপর। গাছে গাছে ভরিয়ে দিয়েছেন নুহাশপল্লী। এভাবেই চেয়েছেন নিজেকেও ভরিয়ে দিতে। নুহাশপল্লীর সবকিছু্ই আছে শুধু হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া। হুমায়ূন বিহীন নুহাশপল্লীর দিন কাটে প্রাণহীন, রাত কাটে আঁধারে। এখন আর কেউ প্রতিদিন নুহাশপল্লীর খোঁজ নিয়ে দিন শুরু করে না। নুহাশপল্লীকে আগের মতো পরিপাটি করে সাজানো হয় না। সকালবেলা সবুজ ঘাসে হেঁটে কেউ নুহাশপল্লীর সব জায়গার তদারকি করেন না। কথা বলেন না, কুশল জিজ্ঞাসা করেন না গাছেরা কেমন আছে।

 

১৯৯৭ সালে গাজীপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের পিরুজালী গ্রামে আলো-আঁধারের মেঠোপথে শান্তির সন্ধানে নামেন হুমায়ূন আহমেদ। ৪০ বিঘা জমির ওপর নিজের মতো করে সাজান একটি গ্রাম। কী নেই সেই গ্রামে! একেবারে যেন হুমায়ূনের খেয়ালের খেলাঘর। এ ভাবেই সবাই বিচরণ করতে করতে দুই প্রহর কাটিয়ে দিলাম স্বপ্নের নুহাশপ্ললীতে। আনন্দঘন এই হইহুল্লোরের মাঝেই সবাইকে এবার নিতে হবে বিদায়। ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বিকালের রোদ গায়ে লাগতেই। নুহাশপল্লীর অপূর্ব কিছু স্মৃতিপট মনের মধ্যে ধারণ করে ফিরে আসলাম আমরা সবাই।    

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ নভেম্বর ২০১৫/তাপস রায়