কৃষি

ওয়াং ফু চিং-এ স্মরণীয় সন্ধ্যায়

শান্তা মারিয়া(চকবাজার টু চায়না- ষষ্ঠ কিস্তি) : রাজপথে আনমনে হেঁটে যেতে যেতে কখনও যদি দেখেন শিক কাবাব কিংবা শাসলির মতো কাঠিতে গেঁথে বিক্রি হচ্ছে পোকামাকড় তাহলে চমকে যাবার কিছু নেই। বুঝতে হবে আপনি আছেন চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে। পথ চলতি কিছু খেয়ে নেওয়ার স্বভাব পৃথিবীর সব বড় শহরের বাসিন্দাদের মতো বেইজিংগারদেরও রয়েছে পুরো মাত্রায়। বেইজিংয়ের স্ট্রিট ফুড চীনা-বিদেশী সবার কাছেই জনপ্রিয়। বেইজিং-এ প্রায় প্রতিটি ব্যস্ত সড়কেই রয়েছে স্ট্রিট ফুডের স্টল। এসব স্টলে কাবাব, বার্গার, চিকেন ফ্রাই, সুপ, রুটি, সেদ্ধ ভুট্টা, মিষ্টি, নুডুলস, পোড়া আলু আর আইসক্রিম চোখে পড়বে। কিন্তু বিশেষ ধরনের স্ট্রিট ফুডের জন্য রয়েছে কয়েকটি বিখ্যাত এলাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ওয়াং ফু চিং। চীনা ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য ওয়াং ফু চিং আর শিয়ামেন ওয়াকিং স্ট্রিট বেইজিংয়ে বিখ্যাত। শুধু খাবারের জন্য নয়, চীনের ঐতিহ্যবাহী জনজীবনের স্বাদ নিতে ওয়াং ফু চিং-এর বিকল্প নেই।

 

অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় প্রথম গেলাম ওয়াং ফু চিং-এ। আমি তখন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বিদেশী বিশেষজ্ঞ হিসেবে মাত্র কাজ শুরু করেছি। তখন পর্যন্ত বেইজিং-এর কিছুই তেমনভাবে দেখা হয়নি। সহকর্মী শিহাবুর রহমান নিয়ে গেলেন ওয়াং ফু চিং-এ। এটি বেইজিংয়ের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। থিয়ানআনমেন স্কোয়ারের খুব কাছেই এর অবস্থান। সাবওয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি এক বিশাল এলাকা। পুরো এলাকাটির নামই ওয়াং ফু চিং । তবে এর মূল আকর্ষণ হলো একটি দীর্ঘ আঁকা বাঁকা গলি। গলিটির প্রবেশপথেই চীনা রীতির বড় একটি তোরণ। এর ভেতর দিয়ে হাঁটা পথটিতে প্রবেশ করে দেখি দু’পাশে খাবারের দোকান। দোকানের খাবারগুলো খেতে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কারণ দোকানের ভেতর বসার কোনো জায়গা নেই। অনেকটা ফেরিওয়ালাদের স্টাইল। যদিও স্টলগুলো স্থায়ী।

 

খাবারের জিনিসগুলো দেখার পর অবশ্য আমি দারুণ চমকে উঠেছিলাম। বিছাজাতীয় এক ধরনের পোকা শিকে গাঁথা রয়েছে। জ্যান্ত। চাইলে ঈষৎ ঝলসে নেওয়া যায় আগুনে। তাহলেও পোকাগুলো জ্যান্তই থাকবে। মাজরা পোকা ধরনের পোকাও রয়েছে। রয়েছে কোকুন বা পোকার ডিম। স্টার ফিশ, সি হর্স, জেলি ফিশ আরও নানা ধরনের সামুদ্রিক পোকামাকড়। আর রয়েছে মাকড়শা। সবই জীবন্ত!

 

দেখে পিলে চমকে উঠতে পারে তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিষাক্ত নয় কোনোটিই। একশিক ১০ ইউয়ান বা ১১৩ টাকা। এগুলো মূলত টুরিস্টদের মজা দেওয়ার জন্য। ইউরোপ-আমেরিকার টুরিস্টরা দেখলাম এগুলো কিনে খাচ্ছে এবং হুড়োহুড়ি করে ছবি তুলছে। একই দামে আরও রয়েছে শিকে গাঁথা ছোট পাখির বা মুরগির বাচ্চার রোস্ট। এগুলো খুবই ছোট, যেন সদ্য ডিম ফোটা শাবক। শুধু পালক ছাড়ানো হয়েছে। দেখলে মনে হয় ডায়নোসরের বাচ্চা। গরু, ছাগল, শূকরের মাংসের শিক কাবাব বা ছুয়ান রয়েছে। আছে জিহ্বা ভাজা। ছোট ছোট বাটিতে বিক্রি হচ্ছে ভুড়ি, চামড়া ভাজার সুপ। মিস্টি খাবারের আয়োজনও রয়েছে। চেরিসহ বিভিন্ন ফল শিকে গেঁথে গরম চিনির শিরায় ঢেলে দেওয়া হয়। এটি চীনের খুব জনপ্রিয় খাবার। ঐতিহ্যবাহী তো বটেই।

 

ওয়াং ফু চিং-এ শিল্প সামগ্রী

 

অন্যান্য পানীয়ের মধ্যে কোক, স্প্রাইট এবং বিভিন্ন ফলের জুস পাওয়া যায় প্রচুর। আর বিয়ার ও অন্যান্য হার্ড ড্রিংকসের কথা না হয় নাই বললাম। ওয়াং ফু চিং-এ বড় সড়কে গাড়ি চলার অনুমতি নেই। এখানে সবাই হেঁটে বেড়ান। এটা করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। অক্টোবরের সেই সন্ধ্যাটি ছিল দারুণ সুন্দর! ওয়াং ফু চিং-এর বড় প্রশস্ত সড়কে একটি মেলা বসেছিল। চারিদিকে নানা রকম সুভ্যেনির বিক্রি হচ্ছে। হালকা শীত। মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি বিদেশি চলচ্চিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সেই সন্ধ্যার পর আরও অনেকবার ওয়াংফুচিংয়ে গিয়েছি। বেইজিংযে এটি ছিল আমার অন্যতম প্রিয় জায়গা। ওয়াং ফু চিং-এ গেছি ক্রিসমাসের সময়। সড়কের ওপর বড় বড় ক্রিসমাস ট্রি সাজানো দেখেছি। এখানকার ম্যাকডোনাল্ডসও কেএফসিতে খেয়েছি অনেকবার।

 

ওয়াং ফু চিং-এ এই দুটি চেইন শপেরই বিশাল বিশাল আউটলেট রয়েছে। আর এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো ওয়াং ফু চিং শপিংয়েরও স্বর্গ। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ড শপ। ঘড়ি, গয়না, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সব পাওয়া যায়। সেখানে রয়েছে চীনের বিখ্যাত চায়ের দোকান। এই দোকানটি প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো। এতে জেসমিন টিসহ বিভিন্ন ধরনের চায়ের প্যাকেট পাওয়া যায়। খোলা অবস্থাতেও রয়েছে চা। চীন দেশে গোলাপ থেকে শুরু করে চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের চা তৈরি হয়।

 

ওয়াং ফু চিং-এ একটি বিখ্যাত টুপির দোকান আছে। এই দোকানটিও অনেক প্রাচীন। রয়েছে বিখ্যাত চীনা রেশম বা চায়না সিল্কের দোকান। আর রয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী ছোট বড় শোপিস বা স্যুভেনির। রাস্তার দু’পাশেই মিলবে এসব। বুদ্ধ মূর্তি থেকে শুরু করে নানা রকম পুতুল, ঢোল, চীনের বাঁশি, গয়নার বাক্স, ব্যাগ কী নেই। আধুনিক খেলনাও প্রচুর। খেলনার জন্য অবশ্য আলাদা কয়েকটি বিশাল দোকানও রয়েছে। খেলনার দোকানগুলোতে গেলে মনে হয় শিশুদের স্বর্গরাজ্যে এসে পড়েছি। কত যে খেলনা তার আর ইয়ত্তা নেই!

 

চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগ থেকে ওয়াং ফু চিং-এর ওপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়। সেটি আমি এবং  সহকর্মী জিনিয়া ওয়াং উপস্থাপনা করি। ওয়াং ফু চিং-এ পরে বহুবার গিয়েছি তবে প্রথম সেই সন্ধ্যাটি ছিল অসাধারণ সুন্দর। আমার জীবনের এক স্মরণীয় সন্ধ্যা হিসেবে সেটি চিরদিন মনের গভীরে রয়ে যাবে।

 

ছবি : শিহাবুর রহমান

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ নভেম্বর ২০১৫/তারা