কৃষি

উচ্ছল ঝরনা, চিংড়ির লাফ ও কাঁকড়া শিকার

ফেরদৌস জামান : প্রথমেই কৈফিয়ত দিয়ে নেই। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, এখন পর্যন্ত বোধহয় ডজন দুয়েক ঝরনা দর্শনের বৃত্তান্ত আপনাদের সামনে উপস্থাপন করে ফেলেছি। ভবিষ্যতে আরও উপস্থাপন করার ইচ্ছা রাখি। আমাদের দেশটা যে কত সুন্দর, কত যে বৈচিত্র প্রকৃতিতে- তা দুচোখ ভরে না দেখলে বোঝা যায় না। কথাগুলো বলার জন্যই কলম চালানোর সাহস করা। সেই সাহস বা প্রচেষ্টার ওপর বারবার ভর করে দেশের প্রকৃতির অনন্য উপহার ঝরনাগুলো। যে কারণে বারবার তাদের কথাই ঘুরেফিরে আসে।

 

সমুদ্র সৈকত, নদীর স্রোত, নীল দিগন্ত, নিলুয়া বাতাস, সবুজ ফসলের দোলা অদৃশ্য টানে টেনে নেয় যেমন বারবার, ঠিক তেমনি ঝরনার স্বভাব। তার উচ্ছল স্রোতে আমিও ভাসি। সেই আনন্দে একবার মজে গেলেই সর্বনাশ! তখন মনটা সেখানেই ছুটে যেতে চাইবে। আমার এমনটাই হয়েছে। আর এ কারণেই ঝরনা নিয়ে এতো লেখা। আজকেও রয়েছে একটি ঝরনার কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা এই ঝরনার নাম বকত্লাই। এটি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত দেশের সর্বোচ্চ ঝরনা। পরিচিত অভিযাত্রী পরিবারগুলো অনেক আগেই বাকত্লাই দর্শন সেরে নিয়েছে। এত দিন তাদের মুখে শুধু গল্পই শুনেছি কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ২০০৯ কি ১০ সালে কোনো এক অভিযানে ঝরনাটির আশপাশ দিয়েই যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সময় স্বল্পতা এবং দলের সকলে সহমত না হওয়ায় সে যাত্রায় দেখা হয়ে ওঠেনি। সেই যে চাপা পড়ে গেল অবশেষে তার বাস্তবায়ন ঘটল গত বর্ষার শেষে।

 

সহযাত্রী জাকারিয়া পারভেজ-এর পেশাগত কারণে সময় বেঁধে নিয়ে রওনা দিতে হল। একটি দিনও  যদি এদিক সেদিক হয়ে যায় তো নিশ্চিত বিপদে পড়বে সে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বগাপাড়া সেনাক্যাম্পে  গিয়ে পড়তে হল এক মহা ফ্যাসাদে। সমস্ত অভিযাত্রীকে আটকে রাখা হয়েছে। কখন এন্ট্রি করবে তার ঠিক নেই। এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর জানতে পাই, নিকটের পাড়াটায় কিছু একটা ঝামেলা বেঁধেছে, যে কারণে ক্যাম্প থেকে এক দল সেনা সদস্যকে সেখানে যেতে হয়েছে। পথটাও এগিয়েছে সেই পাড়ার মাঝখান দিয়ে। অপেক্ষমানদের মাঝে এরই মধ্যে চাউড় হয়েছে- ড্রাগস অথবা অস্ত্র নিয়ে একটা ঝামেলা হয়ে থাকবে।

 

শেষ পর্যন্ত যদিও প্রকৃত হেতুটা জানতে পারিনি। পরিস্থিতি সুবিধার মনে হল না! আগের দুই রাতে মশার অত্যাচারে ঘুম হয়নি, তার ওপর সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছতে হবে পরবর্তী পাড়ায়। তা না হলে পথেই রাত কাটাতে হবে এবং বিপদে পড়বে জাকারিয়া। পাক্কা দেড় ঘণ্টা বাদে সেনা সদস্যগণ ফিরে এলেন। এন্ট্রির পর শরীরের সমস্ত সামর্থ দিয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দুই পায়ের চারদিকে কয়েকটা করে ফোসকা পড়েছে। নরম তুলতুলে নতুন জুতা, পাহাড়িরা ওতেই বেশি অভ্যস্ত। দেখাদেখি বাজার থেকে নিজেরাও এক জোড়া করে কিনে ফেলি। হাঁটতে যার পর নেই আরাম। প্রথম দিনে দুই ঘণ্টা ট্রেকিং কররা পর বুঝতে পারি আসল মজা। পাহাড়ি ট্রেইলের অবস্থা এমন যে, খালি পায়ে হাঁটা বড়ই কষ্টকর। এদিকে ফোসকার কারণে জুতা পায়েও রাখা যাচ্ছে না। কোনো মতে পাড়ায় পৌঁছে তবে যে রক্ষা।

 

সকালে রোদ ওঠার আগেই বেড়িয়ে পড়ি। জুতা এবার পায়ে নয়, ব্যাগে। পাথুরে ট্রেইল, খালি পায়ে হাঁটতে বাধ্য হলাম। পথিমধ্যে গাইড হিসেবে পেয়ে যাই বকত্লাই পাড়ার এক কিশোরকে। বান্দরবানের স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে, ছুটিতে বাড়ি গিয়েছে জুমের কাজে পিতাকে সাহায্য করতে। কাজ ছাড়া তারা কিছু বোঝে না, কাজই তাতের জীবন। মূল ট্রেইল ছেড়ে সাইড ট্রেইল ধরে নেমে যেতে থাকলাম নিচের দিকে। ধান ক্ষেতের মাথার ওপর চমৎকার জুম ঘরটায় এবার খানিক জিরিয়ে নেয়ার পালা। পাশেই মাচায় ঝুলছে করলা আর ঝিঙ্গের লকলকে ডগা। চালের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে মিষ্টি কুমড়ার গাছ। তার ফাঁক দিয়ে দূরে চোখে পড়ে সরু একটি জলের ধারা। মূলত তাকে কাছ থেকে দেখার উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছি। ঝরনাটির উচ্চতা সম্পর্কে একেক জনের একেক মত। তবে মত যাই হোক দুএকটা দল সনাতন পদ্ধতিতে পরিমাপ করে বলেছে ৩৭০ থেকে ৩৮০ ফুট হয়ে থাকবে।

 

স্থানীয়দের নিকট জানা যায়, এখনও নাকি কেউ কেউ উচ্চতা পরিমাপের উদ্দেশ্যে গিয়ে থাকে। আমাদের উদ্দেশ্য উচ্চতা বা গভীরতা পরিমাপ করা নয়। কে আগে গেল, কে পরে গেল সে হিসেব কষে বের করা নয়। এমন কি ফেসবুকে কপচানোর মনবাঞ্ছাও  নেই। আমরা যাচ্ছি কেবল সৌন্দর্য দর্শন করতে। মুগ্ধ হওয়া আর সে অনুভূতির খানিকটা রেশ নিয়ে ঘরে ফেরা। কাছ থেকে দেখার জন্য আমাদের শীঘ্রই বিশ্রাম ছেড়ে নেমে যেতে হল ঝরনার গোড়ার দিকে। নির্দিষ্ট কোনো ট্রেইল নেই, যে যেভাবে পারে যায়। নিকটে গিয়ে দেখা গেল মুষলধারায় পানি পড়ছে অনেক উঁচু থেকে। পানি আছড়ে পরে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তারপর বড় বড় পাথরের পাশ দিয়ে, নিচ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর এক ধাপ। বর্ষা মৌসুম না হওয়ায় আমরা ঝরনার আসল সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তথাপিও যতটুকু পেয়েছি তাতেই মুগ্ধ। তখনই ঠিক করে ফেললাম, সুযোগ বুঝে মৌসুমে একবার আসতেই হবে।

 

প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে যায় ঝরনার নিচে খোলা জায়গায়। সেখানেই গোসল, সেখানেই খাওয়া এবং মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি তোলা। মিষ্টি রোদ পড়েছে পাথরের গায়ে। তাতেই শরীর বিছিয়ে দিয়ে বাকত্লাই সামনে নিয়ে বন্ধু জাকারিয়া উদাস কবি হয়ে গেল। বাড়ি যেন কারও ফিরতে হবে না! দুনিয়াদারীর কথা ভুলে বাকত্লাইকে ঘিরেই চলতে থাকল আবেগ উচ্ছাসের কথাবার্তা। গাইড ইশারা দিলে সকলে প্রস্তুত হয়ে উদাস কবির ধ্যান ভাঙ্গিয়ে চলে আসি পাড়ায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। থাকার ব্যবস্থা গাইডের বাড়িতে। জানতে পারি গাইডের নানা পাড়ার কারবারী। খুনখুনো বৃদ্ধ কারবারীর সাথে আলাপ পরিচয়ে জানা গেল তার সংগ্রামী জীবনগাথা। কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের কারণে বাপ দাদার ভিটা রাঙ্গামাটির রাজস্থলি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে তার জীবন থেকে পেরিয়ে গেছে প্রায় পয়ত্রিশ বছর। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পঁচ-সাত বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করতে হয়েছে একেকটি ঠিকানা। সব শেষ গত প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বাকত্লাই পাড়াতেই আছেন। গাইড তার পিতা লাখলেন বমের সাথে কাকড়া শিকারে যাবে। সে কথা আমরা আগেই জেনেছি। কথা হয়ে রয়েছে শিকারে আমরাও যাব।

   

এক বৃদ্ধা গামলায় করে সামনে রাখলেন আস্ত কচি ভুট্টা সেদ্ধ। তারপর ছোট ছোট পাহাড়ি পান। কারবারী সাহেবের অনুরোধে একটি করে পানের খিলি সকলকে খেতেই হল। খেয়ে তাদের সাথে শিকারের উপকরণ নিয়ে চললাম। সরু খাল, পাহাড়ের আজরপাঁজর দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে পতিত হয়েছে কয়েকশ ফুট নিচে আর নামধারণ করেছে বাকত্লাই ঝরনা হিসেবে। খালের অন্ধকার জলের ওপর আলো দেখলেই কাকড়ার দল থমকে দাঁড়ায়। অমনি ধরে ফেলতে হয়। দেড় ঘণ্টার মধ্যে ঝুরির অর্ধেকটা  ভরে গেল, সাথে বেশ কয়েকটা চিংড়ি। মজার এক অভিজ্ঞতা হল। তাতে নিজেদেরকে স্বার্থক না ভেবে পারলাম না। অন্য বন্ধুরা যারা কাকড়া শিকারে গেল না, তাদের তো আফসোসের অন্ত নেই- জীবনে কি সুযোগ থেকেই না নিজেদের বঞ্চিত করলাম!

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/তারা