কৃষি

তাইওয়ানের সাতকাহন : ৩য় পর্ব

মাসুদুজ্জামান  :   দিল্লিতে সেই আমার প্রথম পদার্পণ। কী যে দুঃসহ অবস্থা তখন দিল্লিসহ সারা ভারতের। প্রচণ্ড গরম। দিনের বেলায় যেন আগুনের হলকা বয়ে যায়।

 

দিল্লি স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম। যে কদিন ছিলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বলে রাতে আমার ঘুমটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু দিনের বেলা সে আরেক ছুটোছুটি।

 

প্রথমেই গেলাম ভারতীয় মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। ওরাই শিক্ষার বিষয়আশয় দেখে। প্রায় তিন দিন লাগলো ওখান থেকে আমার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট প্রত্যায়িত করিয়ে নিতে।

 

চতুর্থ দিনের পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম চাণক্যপুরির দূতাবাস পাড়ার- বাংলাদেশ দূতাবাসে। আগে থেকেই জানতাম ওই দূতাবাসে একজন লেখক কর্মরত আছেন- কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ। ওয়াসির সঙ্গে আগে থেকে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম ওয়াসি আমাকে চিনবেন আর আমি তার সহায়তা পাব। ভাগ্য ভালো, অফিস ছুটির মুহূর্তে ওয়াসিকে পেয়ে গেলাম। রিসিপশনকে জানিয়ে দিলেন সরাসরি তার অফিস রুমে যেন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

ওয়াসি সত্যি অপূর্ব একজন মানুষ। প্রথম আলাপেই মনে হলো আমরা কতদিনের পরিচিত, এমনই তার ব্যবহার। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে যখন জানালাম আমার আসার উদ্দেশ্য, বললেন আমি তো শিক্ষার বিষয়টা দেখি না, দেখেন আরেকজন। ইন্টারকমের রিসিভার তুলে খোঁজ করলেন সেই সতীর্থের। কিন্তু তিনি ততক্ষণে অফিস ত্যাগ করে চলে গেছেন। এখন উপায়? আবার কী আমাকে পরদিন বাংলাদেশ দূতাবাসে আসতে হবে? তাহলে আমি কখন যাব তাইওয়ানের দিল্লিস্থ সাংস্কৃতিক কার্যালয়ে? ওয়াসি ভাবনায় পড়লেন। কী ভেবে যেন বললেন, “দ্যান, আমিই একটা চিঠি লিখে দেই ওদের। কাজ হলেও হতে পারে। আফটার অল দূতাবাসের প্যাড আর সিলগালা করা চিঠি, অগ্রাহ্য করতে পারবে না।”

 

কথাটা আমার মনে ধরলো। আরও ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব আর আরেক দফা কফি খেয়ে কাটানোর পর ওয়াসি আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। সেখানেই সারতে হলো রাতের খাবার। এরপর তারই গাড়িতে ড্রাইভার আমাকে পৌঁছে দিল আমার হোটেলে।

 

সিদ্ধান্ত নিলাম দিল্লি থেকে ভিসা নেবো না। সাত থেকে দশদিন দিল্লি বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। সেই ছুটিও আমার নাই। বড় জোর আমি হয়তো একদিন দিল্লি শহরটা কোনো টুরিস্ট প্যাকেজের অংশ হিসেবে ঘুরে দেখতে পারি। আমি ঠিক সেটাই করলাম।

 

পরদিন ঘুরে দেখলাম দিল্লি গেট, রাজভবন, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ আর ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর। এই জাদুঘরেই আমি দেখলাম বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত মুজিব-ইন্দিরার ছবি। প্রত্যায়িত সার্টিফিকেটগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য এরপর হাজির হলাম তাইপের কালচারাল অফিসে। আমার সামনেই ওয়াসিকে তারা ফোন করলেন আমার পরিচয় আর বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক প্রত্যায়িত আমার সার্টিফিকেট যথার্থ কিনা নিশ্চিত হবার জন্যে। এরপর ওই কেন্দ্র থেকে প্রত্যায়িত সার্টিফিকেটগুলো ফেরত পেলাম। যাক, একটা পর্ব তো শেষ হলো। সবচেয়ে যে জরুরি কাজটি, অর্থাৎ তাইওয়ানের ইকনোমিক অ্যান্ড কালচারাল অফিস থেকে আমার সব সার্টিফিকেট প্রত্যায়িত করে নেওয়ার জরুরি কাজটি সম্পন্ন করা গেল। এখন থেকে তাইওয়ানের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমার আবেদনপত্র বিবেচনা করবে এই প্রত্যায়নের জোরে। এরকমই আমাকে জানিয়েছিলেন চ্যান আর ফু।

 

তাইওয়ানিদেরও নাকি এমনটা করতে হয়। যেদেশ থেকে ওরা ডিগ্রি অর্জন করেন, সেই দেশের তাইওয়ানিজ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা দূতাবাস প্রত্যয়ন না করলে কোনো বিদেশি সার্টিফিকেট তাইওয়ানে বৈধ বলে বিবেচিত হয় না। বিদেশিদের ব্যাপারে আরো সতর্ক তারা। ফলে, আমার ব্যাপারে তো আরো  সতর্ক থাকবে।

 

দিল্লি আসার উদ্দেশ্য সফল হতেই মনে হলো দিল্লির তপ্ত আবহাওয়া, অর্থাৎ আগুনের পরশমণি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফেরাই একমাত্র কাজ। কাজটা আবার সহজও নয়। পরদিন বিদেশি কোটায় রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট পেয়েই ছুটলাম কলকাতা। কলকাতা পৌঁছেই মনে হলো দুদিন এখানে বিশ্রাম নিয়ে দেশে ফিরবো। এই ফাঁকে আমার এক সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুর আর কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুরে আসবো। কলকাতায় যেদিন পৌঁছলাম, তার পরদিন কী একটা কারণে যেন ভারতবন্ধ ডেকেছে কোনো একটা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল। কী আর করা, কফি হাউজে না গিয়ে সময় কাটাতে হলো দেশপ্রিয় পার্কের স্যার যদুনাথ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর সোস্যাল সায়েন্সের গবেষক গেস্ট হাউজে। পরদিন দিনে যাদবপুর আর সন্ধ্যায় কফি হাউজে যাওয়া হলো না। মৈত্রীবাসে চলে এলাম ঢাকায়।

 

একটা পর্ব শেষ করে ঢাকায় তো পৌঁছলাম। কিন্তু এখন তাইওয়ানের ভিসা পাই কোথায়? সেখানে যাবই-বা কীভাবে? ইমেইল করলাম চ্যানকে, সমস্যাটা জানালাম ফুকেও। ফু দায়িত্ব নিলেন ওদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বহির্বিশ্বের যে-কোনো একটা তাইওয়ানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে আমার ভিসার আবেদন সংক্রান্ত তথ্য পাঠানো হলেই তিনি তার ফলোআপ করবেন। চ্যান আর চ্যানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেই এটা করা হবে। চ্যান এ কথার মাধ্যমে আমাকে যা জানালেন তা হলো, “তুমি তৃতীয় অন্য কোনো দেশে যাও যেখানে তাইওয়ানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা দূতাবাস আছে। সেখান থেকে ভিসার আবেদন কর। কোন দেশের তাইওয়ানি কালচারাল সেন্টারে যাচ্ছ ভিসার জন্য, আমাদের জানাবে। আমরা সেইভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। তোমার ভিসা পেতে তখন আর সমস্যা হবে না।”

 

ভিসা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে এবার তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অস্থায়ী নিয়োগপত্র’।  এর অর্থ হলো  হিল্লি-দিল্লি করার পর তাইওয়ানের ভিসার জন্য আমাকে আরেক দফা অন্য দেশে ছুটাছুটি করতে হবে। ভিসা হবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নাই। তবে একটা নিয়োগপত্র আমার হাতে। ভাবলাম, চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী। ভিসা পেলেও তো পেতে পারি। যদি না পাই, তাহলে যেদেশে যাব, সেই দেশটা তো বেড়ানো হবে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা আর কি!

 

দিল্লির পথে

 

তাইওয়ানের নিয়োগপত্রের কথা উল্লেখ করে আমার কর্মক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরে ছুটির আবেদন করলাম। ছুটি মিললো, যে ছুটিকে প্রশাসনিক ভাষায় বলা হয় ‘বিনাবেতনে অসাধারণ ছুটি’।  এর অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি বহাল থাকবে। ছুটির শেষে বা ছুটির মাঝে যখনই ফিরে আসবো, তখনই আবার কাজে যোগ দিতে পারবো। কিন্তু বেতন পাব না। যেহেতু আমি তাইওয়ানে চাকরি নিয়ে যাচ্ছি, ফলে বেতন তো দু-জায়গা থেকে হতে পারে না। পেতে পারি যেখানে চাকরি নিয়ে যাচ্ছি সেখান থেকে। তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল দুইবছরের জন্যে। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় দিল এক বছরের ছুটি। একবছর গেলে এই ছুটি আবার বর্ধিত করা হবে। এভাবে এক বছর এক বছর করে আমি চার বছর ছুটি পাবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই নিয়ম।

 

তাইওয়ানের ভিসা কীভাবে পাওয়া যায় সহকর্মীদের জানাতেই কেউ বললেন হংকং যেতে, কেউ সিঙ্গাপুর। আমি হংকংয়ে যাওয়াই স্থির করলাম। এটা ২০০৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকের কথা। আমাকে যদি তাইওয়ানি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপত্রের শর্ত মানতে হয় তাহলে যোগ দিতে হবে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখের মধ্যে। কারণ তাইওয়ানের ওই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মের ছুটি শেষে খুলবে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে। ভাবলাম, হংকংয়ে গিয়ে ভিসা পেতে বড় জোর হয়তো দু-একদিন লাগবে। আমার হাতে তো নিয়োগপত্র আছেই। এরকম একটা ভাবনা থেকে সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে হংকং গিয়ে পৌঁছলাম। হংকংয়ে যেতে হলে এখনকার মতো ভিসা নিতে হতো না, অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা মিলতো। হংকংয়ে আমার সেটা প্রথম আসা। সত্যি বলতে কী আমি এর আগে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশে যাইনি।

 

রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে হংকং সত্যিকার অর্থেই দারুণ একটা এলাকা।  ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে চীনের শাসনাধীনে চলে এলেও হংকংয়ের কিছুই বদলায়নি। চীনই বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার  মর্যাদা দিয়ে এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে।  হংকং একারণেই পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। অচেনা এই ভূখণ্ডে নেমেই আমার মনে হলো বাংলাদেশকে অনেক দূরে ছেড়ে এসেছি। এটা শুধু পথের দূরত্বে নয়, ভিন্ন পরিবেশের দূরত্বে, অচেনালোকের নতুন স্পর্শে মনটা কেমন যেন করে উঠল। ভৌগোলিক বিন্যাসের দিক থেকে হংকং চারটি ভাগে বিভক্ত : দক্ষিণে লানতাউ আর হংকং দ্বীপ, উত্তরে নতুন অঞ্চল আর কাউলুন। প্রথমেই ভালো লেগে গেল লানতাউ দ্বীপে একেবারে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে নির্মিত হংকংয়ের নতুন বিমানবন্দরকে। কী বিশাল আলোকোজ্জ্বল বিমানবন্দর। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো। এর প্রায় সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। বেশ কয়েকটা লেভেলে বিমানবন্দরটি তৈরি। প্রথমে তো হদিসই পাচ্ছিলাম না কোন পথ দিয়ে কীভাবে বিমানবন্দর ত্যাগ করবো। কিন্তু বিমানের ভেতরেই দেখেছি বাংলাদেশের অনেক যাত্রী, প্রায় ঠাসাঠাসি করে ঢাকা থেকে আসছিলাম চীনের ড্রাগন এয়ারলাইন্সের একটা এয়ারবাসে। হংকংয়ে নেমে দেখলাম ওদের অনেকেই হংকংকে বেশ ভালোই চেনে। ঝটপট এদিক-ওদিক করে ইমিগ্রেশনের কাজ আর কাস্টমসের নিরাপত্তাবেষ্টনী অতিক্রম করে ঢুকে যাচ্ছে যাত্রী লাউঞ্জে। আমি ওদেরই পথ ধরলাম। যে-কোনো বড় বিমানবন্দরের এই এক সুবিধা। ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য যে শুধু তথ্যকেন্দ্র থাকে তাই নয়, অসংখ্য ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা থাকে কীভাবে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে হবে। কোন দিক দিয়ে ঢুকতে হবে, বের হতে হবে। বিভিন্ন ব্যাংকের অসংখ্য বুথও থাকে মুদ্রা বিনিময়ের। সেভাবেই শুরু। টুরিস্ট ব্যুরোর অফিস থেকে বাসের বা ট্যাক্সিতে করে কীভাবে কাউলুনে পৌঁছবো, তার একটা লিটেরেচার নিয়ে পৌঁছে গেলাম চতুর্থ লেভেল থেকে একেবারে ভূমিতে স্থাপিত বাসস্টপে। এরপর ঘণ্টাখানেকের এক্সপ্রেস বাসযাত্রা।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৬/সাইফ