কৃষি

পাহাড় মেঘ ঝরনার দেশ

সাইফ বরকতুল্লাহ : ঢাকা থেকে যখন রওনা দেই তখন রাত সাড়ে এগারোটা। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। প্রচণ্ড গরম। আকাশভরা চাঁদের আলো। ঢাকা ত্যাগ করে কুমিল্লা, ফেনী পার হয়ে চট্টগ্রাম যখন পৌঁছাই তখন রাত তিনটা প্রায়। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। শেষ রাতের আবহাওয়াটা তখন চমৎকার। জানালা দিয়ে দেখছি রাস্তার দুইপাশে পাহাড়। সারি সারি গাছগাছালি সরে সরে যাচ্ছে। শেষ রাতের নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি আর বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। মনটাও মিশে যায় প্রকৃতির মাঝে।

 

এভাবে যেতে যেতে খাগড়াছড়িতে সকাল সাতটায় পৌঁছে যাই। বাস থেকে নেমে শাপলা মোড়ে দাঁড়িয়ে ফোন দেই মানিক ভাইকে। মানিক ভাই খাগড়াছড়ির স্থানীয় তরুণ সংবাদকর্মী। দুরন্তপনায় প্রাণোচ্ছল এক টগবগে যুবক। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মানিক ভাই এসে হাজির হন।

 

শাপলা মোড়ে হোটেলে বসে সকালের নাস্তা সেরে নেই। নান রুটি আর সবজি। সঙ্গে চা। আট ঘণ্টা জার্নির পর শরীর চাঙ্গা করার জন্য চা জরুরি ছিল। এরপর চাঁদের গাড়ি ঠিকঠাক করে ঘণ্টাখানেকের মতো রেস্ট নেই। এই ফাঁকে রাতে থাকার জন্য হোটেল বুকিং, পরেরদিন রাতে ঢাকায় ফিরে আসার জন্য অগ্রিম বাসের টিকিটও বুকিং দিয়ে রাখি।

 

সকাল সাড়ে নয়টায় শুরু হয় আমাদের খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক ভ্যালিতে যাত্রা। আমরা নয়জনের একটা টিম যাচ্ছি। যাওয়ার রাস্তাটিও চমৎকার। দুপাশে সারি সারি সবুজ আর উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা। কখনো উঁচু আবার কখনো নিচু, এ যেন মন ছুঁয়ে যাওয়া অন্যরকম অনুভব।

 

সাজেকের চূড়া থেকে দেখা যায় এমন দৃশ্য

 

 

দীঘিনালার পথে যেতে দেখি দুপাশে রাবার বাগান, ফলের বাগান। পাহাড়ের বুকে বসবাস করা আদিবাসীদের বসতি। আঁকাবাঁকা পথের বাঁক। পথে আর্মি ও পুলিশ ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হয় আমাদের। দীঘিনালা থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে বাঘাইহাট বাজারে গাড়ি থেমে যায়। ছোটখাটো ছিমছাম বাজার। এখানে আমরা দুপুরের খাবার কিনে নেই। হাঁসের মাংস, ভাত, শুটকি ভর্তা। সাথে দুই বোতল পানি। যদিও খাগড়াছড়ি থেকে তিনটা পানির বোতল নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে পানি সংকটে যেন না পড়ি সেজন্যই দুই বোতল কিনে রাখা। বাঘাইহাট বাজারে আমাদের এক ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ এখান থেকে আর্মি স্কর্ট ছাড়া কোনো পর্যটক আসা-যাওয়া করতে পারে না। যে কারণে আমাদের এই অপেক্ষা।

 

বাঘাইহাট বাজার ছেড়ে যেতেই বড় বড় সব পাহাড়ি রাস্তা। চাঁদের গাড়ির ছাদে বসে মনে হবে এই যেন রোলার কোস্টার। এক পাহাড় থেকে নেমে তীব্র গতিতে উঠতে হয় আরেক পাহাড়ে। দুইপাশে চোখে পড়ে সবুজ আর সবুজ।

 

বাঘাইহাট থেকে মাচালং বাজার। বাজারের পরেই শুরু হয় সাজেকের মূল পথ। অসংখ্য পাহাড়ের বন্ধনে সবুজে ঢাকা অপরূপ সাজেকের রাস্তা। আমরা যাচ্ছি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাজেকের উচ্চতা প্রায় এক হাজার ৭০০ ফুট।

 

পুরো সাজেক পাহাড়ি সৌন্দর্যে মোড়ানো এক মেঘের উপত্যকা। সবুজ অরণ্যে ঘেরা অসংখ্য পাহাড়ের বুকে সাদা মেঘের ভেলা। এ সময় সবকিছু ভুলে শুধুই মনে হয় সত্যি সত্যিই মেঘের দেশে চলে এসেছি। এত কাছ থেকে মেঘ দেখার আনন্দ আহ এক কথায় অসাধারণ!

   

সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত হলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও এর যাতায়াত সুবিধা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার।

 

সাজেকে গিয়ে আমরা যখন পৌঁছি তখন সময় দুপুর একটা। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। এমনিতেই রাত জেগে জার্নি তারপরে আবার প্রচণ্ড গরম। সাজেকে পৌঁছেই প্রথমে দুপুরের খাবার সেরে নেই আমরা। তারপর সাজেকের সৌন্দর্য দেখতে থাকি।

 

সাজের চূড়ায় নরম ঘাসে বসে দেখি মেঘ। এর মধ্যেই ইভান আমাকে বলে, মামা কয়েকটা ছবি তুলে দাও। আমি ক্যামেরা নিয়ে সাথে সাথে ক্লিক করি। আর তাকিয়ে দেখি মেঘ আর পাহাড়।

 

আমার মোবাইলে চার্জ শেষের দিকে। কিন্তু সাজেকে বিদ্যুৎ নেই। আছে সোডিয়াম লাইট, বায়োবিদ্যুৎ। স্থানীয় রুসুই ত্রিপুরা আমাকে জানাল, এখানে রাতে জ্বলে সোডিয়াম বাতি। চার্জ আর দিতে পারলাম না।

 

 রিছাং ঝর্না

 

আমাদের হাতে সময় আছে আর ঘণ্টাখানেকের মতো। কারণ সাড়ে তিনটার মধ্যে সাজেক থেকে রওয়ানা করতে হবে। আমরা আরো মেঘের কাছে অর্থাৎ পাহাড়ের কোলঘেঁষে যাই। সামনে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি এক টুকরো সাদা মেঘ। চলতে চলতে নিজেকে মনে হয় মেঘের রাজ্যের অতিথি। পাহাড়ের কোলঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত জলের হ্রদ। নীল আকাশ মিতালি করে সেই হ্রদের সাথে। আমি হারিয়ে যাই অন্য এক মোহনায়।

 

মেঘ আর পাহাড় দেখতে দেখতে কখন যে সময় শেষ হয়ে যায় টের পাইনি। মাহবুব, আশিক, সাইমন, ইভান ওরা আগেই গাড়িতে চলে গেছে। চাঁদের গাড়ির ড্রাইভার মান্নান আমাকে ফোন করে বলে, স্যার চলে আসেন, যেতে হবে। আমি শেষ সেলফি তুলে বিদায় জানাই সাজেক ভ্যালি।

 

রাতে যখন খাগড়াছড়িতে পৌঁছাই তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাস। শহরের শাপলা মোড়ে আটকা পড়ে যাই। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো এ অবস্থা। বৃষ্টি কিছুটা কমলে হোটেলে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে আবারও বের হই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। খাবার হোটেলে গিয়ে বিপদে পড়ি। কোনো ভাত নেই।

 

হোটেল ম্যানেজারকে বললাম, এ অবস্থা কেন? হোটেল ম্যানেজার জানাল, গত দুই দিনে পর্যটকদের প্রচণ্ড চাপ। জন্মাষ্টমীর ছুটি থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। একটু বসেন, ভাত রান্না হচ্ছে।

 

 তারাংয়ে দাঁড়িয়ে লেখক

 

যাই হোক, আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গরম আতপ চালের ভাত সাথে কচুশাক, আর গরুর মাংসের ভুনা দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। হোটেলে গিয়ে আর কোনকিছু না ভেবে সরাসরি ঘুম।

 

পরের দিন সকালে চলে যাই রিছাং ঝরনা। খাগড়াছড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে আলুটিলা হয়ে সেখান থেকে আরো দুই কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গা উপজেলাতে এই ঝরনা। ঝরনায় নেমেই মনটা শান্ত হয়ে গেল। ঝরনার পানি এতো ঠাণ্ডা। পানিতে পা রেখে পাথরের উপর বসতেই শরীরটায় প্রশান্তি নেমে আসে।

 

এরপর আমরা চলে যাই আলুটিলা পাহাড় ও গুহায়। সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যময় অহঙ্কার আলুটিলা। আলুটিলা পাহাড় থেকে খাগড়াছড়ি শহরের পুরো চিত্র দেখা যায়। প্রাকৃতিক গুহা যা এখানকার মূল আকর্ষণ। এই গুহা ২৮২ ফুট দৈর্ঘ্য এবং গুহার একপাশ থেকে অন্য পাশে যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। গুহার একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি প্রবাহমান। গুহার ভিতর অনেক অন্ধকার। পর্যটন কেন্দ্রের গেটে আমরা ২০ টাকা দিয়ে মশাল নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাই।

 

 ঝুলন্ত ব্রিজ

 

এরপর তারাং, ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে চলে আসি খাগড়াছড়িতে। রাত নয়টায় খাগড়াছড়িকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা করি ঢাকার উদ্দেশ্যে। যখন বাস ছাড়ে তখন আকাশে অনেক তারা, আর চাঁদের আলো। আমি জানালা দিয়ে তারার আলো আর রাস্তার দুপাশে পাহাড়, গাছগাছালি দেখছি। জানালা দিয়ে শরীরে হালকা বাতাসের পরশ লাগছে। হাতে ঘড়িটায় যখন চোখ রাখি- দেখি রাত তিনটা। ততক্ষণে খাগড়াছড়ি চলে গেছে স্মৃতির ডায়েরিতে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৬/সাইফ/তারা