কৃষি

মেঘের দেশে হারিয়ে যেতে নেই মানা

রাকিব হোসেন  নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কল্পনার সুদূরে নয়, হাতের কাছে। ইচ্ছে হলেই ছুঁয়ে দেখা যায়। এজন্য প্রয়োজন নেই পাখির হওয়ার কিংবা উড়োজাহাজে চড়ার। বাস্তবে মেঘের দেশে হারিয়ে যেতে চাইলে বেড়িয়ে আসুন প্রতিবেশি দেশ ভারতের শিলিগুড়ি ও শৈলশহর দার্জিলিং। খুব কাছ থেকে অনুভব করা যাবে মেঘের উষ্ণতা। দেখা যাবে মেঘের লুকোচরি খেলা। এই খেলায় আমরাও মেতে ছিলাম ।৫ ডিসেম্বর ২০১৩। ব্যক্তিগত পাসপোর্টের ক্যারিয়ার সুরক্ষায় শ্যামলী বি.আর.টি.সি বাসে যাত্রা করলাম শিলিগুড়ির পথে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মতিঝিল ইডেন মসজিদ সংলগ্ন শ্যামলী বাস কাউন্টার। রাত ৮টায় মিনি শ্যামলী পরিবহনে কল্যানপুর কাউন্টার। সেখান থেকে গাড়ি পরিবর্তন করে ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হলো মূলযাত্রা। পরদিন সকাল ১০ টায় পৌঁছলাম সীমান্তে বুড়িমারি স্থল বন্দরে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে সময় লাগলো ৩ ঘণ্টা। এরই ফাঁকে জিরো পয়েন্টের দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী করে নিলাম। এবার ওপার বাংলার পালা। পায়ে হেঁটে চ্যাংরাবান্দা বর্ডারে (ভারতের সীমান্ত)। এখানে মুদ্রা পরিবর্তনের জন্য রয়েছে ১০টি মানি এক্সচেঞ্জ। শ্যামলী পরিবহনের নিয়োগকৃত এজেন্ট নির্ভরতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদন করে। বিনিময়ে যাত্রী পায় ভারতীয় ইমিগ্রেশনের হয়রানি থেকে মুক্ত থাকার মতো কিছু বাড়তি সুবিধা। তৃতীয় দফায় বাস পরিবর্তন করে যাত্রা শুরু হলো শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে ৬ টায় পৌঁছে গেলাম এয়ার ভিউ মোড়ে। এখানেই এয়ার ভিউ প্যালেসে আমাদের রুম বুকিং দেয়া হয়েছে। কাজটি আগে থেকেই করেছে আমার সহযাত্রী শফিক ভাই। পুরো নাম শফিকুল ইসলাম। তিনি স্কয়ার ওষুধ কোম্পানীতে কর্মরত। শ্যামলী বাস কাউন্টাওে পরিচয়। সেই থেকে যোগাযোগ এবং এক সাথে শিলিগুড়িতে।পরদিন (৭ ডিসেম্বর) সকালে নাস্তার টেবিলে মিনি মিটিং। বিষয় দার্জিলিং। এয়ার ভিউ থেকে অটোতে চড়ে সোজা মালাগুড়ি মোড়। এখানেই হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে থেকে খুব সহজেই দার্জিলিং যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। সিঙ্গেল ২০০-২৫০ রুপি, রিজার্ভ ৭০০-৮০০ টাকা। আমরা স্থানীয় একটি ট্যুরিজম কোম্পানীর সাথে চুক্তি সাপেক্ষে এবার দার্জিলিংয়ের পথে। উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সরু রাস্তা বেয়ে আমরা যেন শুধু উপরেই উঠছি। কি পরিমাণ উপরে আছি তা নিচে তাকালে বোঝা মুশকিল। এমন কি ভয়ে আঁৎকে উঠতে পারেন। তাই দার্জিলিং যাওয়ার পথে নীচে না তাকানোই ভালো। তবে নীচে তাকানোর মুহূর্ত পাল্টে দেবে চা বাগানের সবুজ দৃশ্য। মনে হবে বাগান নয় যেন সমুদ্রের নীল ঢেউ আর নীলাকাশে সাদা মেঘ। মেঘের কণার ওড়াউড়ি। স্পর্শ করছে হাত। এমনই এক মনোমুগ্ধকর জার্নি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ের পথ। সাড়ে তিন ঘণ্টা কিভাবে পার হলো টেরই পেলাম না। গাড়ি থামলো শৈলশহর দার্জিলিংয়ের প্লেজার প্যালেস হোটেলের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই ধূসর গুঁড়ি গুঁড়ি শিশির বিন্দু শরীর স্পর্শ করছে। এবার হোটেল বিশ্রামের পালা। উদ্দেশ্য, দার্জিলিংয়ে দ্বিতীয় দিন থেকে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা। হোটেল বয় এর মাধ্যমে ফোর হুইলার জীপ গাড়ি সংগ্রহ হয়েছে। এবার যাচ্ছি অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান টাইগারহিল। এটি দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান। সাগর থেকে সাড়ে ৯ হাজার ফিট উপরে। ভারতে একমাত্র এই স্থান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে আসেন এই ‘সানরাইজ’ দেখার জন্য। এ জন্য আপনাকে ৪টা ৪৫ মিনিটের আগে যেতে হবে টাইগার হিলে। তবেই দেখা মিলবে সাত রঙে রাঙা সূর্য। এই দৃশ্য আরো সুন্দর হওয়ার কারণ হচ্ছে সূর্যোদয় হওয়ার পর এটি কাঞ্চন জঙ্ঘার ওপর প্রতিফলিত হয়। তখন দেখা যায় কাঞ্চন জঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে আরো বাড়তি পাওনা মেঘের লুকোচুরি খেলা। তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘের কণা উড়ে উড়ে করে আপনাকে স্পর্শ করবে।টাইগার হিল থেকে ছুটলাম বাতাশিয়ালুক। তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতের কোঠায়। এখানে রয়েছে পার্ক টয়ট্রেন। বৃটিশ আমলের এই টয়ট্রেন চড়ে আপনি ঘুরে বেড়াতে পারেন। এখানে রয়েছে ছবি তোলার বিশেষ আয়োজন। বিভিন্ন দেশের পোশাক পড়ে ছবি তুলতে পারেন। সঙ্গে ক্যামেরা থাকার প্রয়োজন নেই। প্রস্তুত আছে অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার। বাতশিয়ালুক দেখা শেষে এবার হোটেলে নাস্তা খাওয়ার পালা। চটজলদি নাস্তা সেরে নিয়ে চলে গেলাম ঘুমমনেস্টি দেখার জন্য। ঘুমমনেস্টি এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু রেল স্টেশন। জায়গাটি বছরের প্রায় দশমাসই মেঘলা থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বার এসেছেন ঘুমমনেস্টিতে। গল্প লিখেছেন ঘুমমনেস্টি নিয়ে। তার ভাষায় এলাকাটি ঘুমন্ত ও শান্ত সৃষ্ট স্থান। এই স্থানের উচ্চতা সাড়ে ৮ হাজার ফিট। ঘুমমনেস্টি দেখা শেষ হলে ঘুরে আসুন তেনজিং মিউজিয়াম। এখানে দেখতে পাবেন তেনজিং শের পা ও এডমন হিলারির এভারেস্টে যাওয়ার সকল সরঞ্জাম ও প্রথম এভারেস্ট জয়ী তেনজিংয়ের মমি। এরপর ঘুরে দেখুন ক্যাবল রোপওয়ে।ক্যাবল রোপওয়েতে উঠতে আপনাকে ২৫০ ভারতীয় রুপি দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হবে। এটি দশ কি.মি. লম্বা। ক্যাবল রোপওয়েতে বসে দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছোট ছোট গ্রাম, চা বাগান, লেক, ঝর্ণা ও মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখা যায়। বাড়তি পাওনা সিকিম বর্ডার। আপনার সিকিম যাওয়ার সৌভাগ্য না হলেও ক্যাবল রোপওয়েতে বসে সিকিম বর্ডার দেখতে পাবেন।দার্জিলিংয়ে আরো যে সব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেনজিং রক, হ্যাপিভ্যালি টি গার্ডেন, জাপানিজ টেম্পল, লাল কুঠি, কুচবিহার বাজার, রাজবাড়ি ও রং মহল। ফিরে আশার পথে নেপাল বর্ডার হয়ে ঘুরে আসুন মিরিক।মিরিকে রয়েছে বিশাল লেক। এই লেকে বড় বড় মাছ এবং কচ্ছপই হচ্ছে ঘুরে দেখার অন্যতম আকর্ষণ। ইচ্ছে হলে খাবার কিনে দিতে পারেন এই প্রাণীকুলকে, তবেই তাদের দেখা মিলবে। এখানে আপনি ২০-৫০ রুপির বিনিময় ঘোড়ার পিঠে চড়ে লেক ভ্রমণ করতে পারবেন। মিরিক ঘুরে দেখার পরে হাতে বাড়তি সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন কালিমপং। এটি তিন হাজার ফিট উপরে। কালিমপংয়ে রয়েছে ভেলো পার্ক। ১০ রুপি দিয়ে টিকেট নিয়ে ভেলো পার্ক থেকে কালিমপং ও সিকিমের সুদৃশ্য সিনারি দেখা যায়। রয়েছে প্যারাগ্লইডিং। শিশুদের ২০০০ রুপি ও বড়দের ২৫০০ রুপির বিনিময় পাহাড়ের উপর দিয়ে ট্রেনারের সাথে ২৫ মিনিট ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। কালিমপংয়ে আরো রয়েছে রামভক্ত হনুমানের ভাস্কর্য, পাহাড়ি ফুলের বাহারি সব আয়োজনের ফ্লাওয়ার গার্ডেন, হ্যালিটকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ছবি তোলা ও বুদ্ধিস্ট টেম্পল।কালিমপং থেকে সোজা চলে আসুন শিলিগুড়ি। যদি কোন কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছে থাকে তবে আপনাকে শিলিগুড়ি থেকেই শপিং করতে হবে। কারণ দার্জিলিং ও কালিমপংয়ের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম দামে শিলিগুড়িতে কেনাকাটা করা যায়। এজন্য রয়েছে বিধান মার্কেট, সিটি সেন্টার ও বিগ বাজারসহ বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক শপিংমল।ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, মিরিক ও কালিমপং ঘরে আসতে সময় লাগবে ৬/৭ দিন। যাতায়াত ঢাকার কল্যাণপুর অথবা আরামবাগ থেকে বি.আর.টি.সি. শ্যামলী বাসে শিলিগুড়ি। ভাড়া : যাওয়া ও আসা ৩২০০ টাকা।

 

রাইজিংবিডি / শাহ মতিন টিপু