কৃষি

হাওরে বোরো চাষে অনাগ্রহ

কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলার মধ্যে ৯টি উপজেলাই হাওর অধ্যুষিত। হাওরের বুকের হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি এ বছর এখনো পতিত।

এখন বোরো আবাদের মৌসুম। এসব জমিতে যেখানে বোরো আবাদ হওয়ার কথা, সেখানে হাওরের মাঠ এখন ফসল শূন্য ধুধু বালুচর। যে মাঠে ধানের চারা রোপণ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে গরু চড়িয়ে বেড়াচ্ছে কৃষক। আবার কোথাও তপ্ত রোদে ফেটে গিয়ে ধান চাষের আবাদি জমিগুলো খা খা করছে।

কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬ শত ৭৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা পূরণ হয়নি। পুরো জেলায় ১ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধানের।

হাওরাঞ্চলের সাধারণ কৃষকরা বলছেন, হাওরে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর জমি এবার পতিত রয়েছে। এর কারণ, গত কয়েক বছর ধরে বোরো চাষ করে ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ এ অঞ্চলের কৃষক। অব্যাহত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে বোরো আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। ফলে চলতি বোরো মৌসুমে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি এখনো অনাবাদি।

এবার তিনকাঠা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের কৃষক বদরুল আলম। তিনি বলেন, ‘এত জমি থাইক্যাও তো লাভ নাই, আমার মোট নয় কাডা জমি আছে। এইবার হগলে তিনকাডা জমিত বোরো লাগাইছি। কি করতাম, প্রত্যেকবারই ধান ফলাইয়া মাইর খাই। হয় দামের মাইর, নয় বন্যার মাইর। আরও মরার উপরে খাড়ার ঘা তো আছেই, ঋণের বুঝা। হেল্লেইগা সব জমিত চাষ করি নাই।’

মিঠামইন উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের কৃষক লালু শেখ কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘আমরার কতা কেডা ভাবে, প্রত্যেক বছর অকাল বন্যায় সব তলাইয়া নেয়। লাভের মুকতো দেহিই না, উল্ডা সুদের ঋণ দিতে দিতে জান অর্ধেক শেষ। আর চাষের সময় সারের দাম কেমনে যে বাড়ে কি কইতাম। আমরার এলাকার চাষিরা জমি রাইক্যা অহন শহরে গিয়া কামলা দেয়। দিন আনে দিন খায়। ঋণের জ্বালায় কত পরিবার যে এই বোরো আবাদ কইরা পথে বইছে, হেরার খোঁজ কেও রাখেনা। গত বছর চাষ কইরা এখনও আমার লক্ষ লক্ষ টেহা কৃষি ঋণ দেওন লাগে। এ ব্যাপারে সরকার না ভাবলে আমরার কিছুই করার নাই।’

প্রতি বছরই বোরো চাষ করার খরচ যোগাতে ব্যাংক, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন কৃষকরা। ধান চাষে লোকসান হওয়ার কারণে এসব ঋন পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে চলে গেছেন। আবার অনেকে জমি বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করেছেন। জমি বিক্রেতার সংখ্যা বেশি থাকার কারণে জমির দামও ভাল পাচ্ছেন না তারা। তাই খাওয়ার জন্য অল্প জমি চাষ করে বেশির ভাগ জমিই পতিত রেখেছেন অনেকে।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আশোক পারভেজ জানান, এ জেলা মূলত হাওর অধ্যুষিত। ৯টি উপজেলায় বছরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিকটন চাল উৎপন্ন হয়। এ অঞ্চলে বোরো আবাদই সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকরা যাতে লাভবান হয় তার জন্য বিকল্প ফসল হিসেবে ভুট্টা, সরিষা ও সূর্যমুখী আবাদের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। হাওর অঞ্চলে যাতে কোন জমি পতিত না থাকে সে ব্যাপারেও চেষ্টা করা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ/টিপু