সাইফ বরকতুল্লাহনতুনের কেতন ওড়ে বৈশাখে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে কথাই বলেছেন-‘ওই নতুনের কেতন ওড়েকালবোশেখির ঝড়তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই আমাদের নতুন বছরের শুরু। পুরনো বছরের অতীত পেছনে ফেলে নব প্রত্যাশায় এগিয়ে চলার শুরু হয় এ দিন থেকেই। বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেননা পহেলা বৈশাখই হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব। বাংলা ও বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির মূল বিষয়টি হলো, উৎসবের মধ্য দিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। যে উৎসবের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস, লোকজ ঐতিহ্য ও গৌরব প্রকাশ পায় তা হলো এই পহেলা বৈশাখ। বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে মিশে আছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। সত্য, সুন্দর ও মুক্তির সন্ধানে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হয় প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানান প্রতীকী উপকরণ, রংবেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। এবারও এর ব্যাতিক্রম হবে না। চারুকলা অঙ্গনে পা দিয়েই বুঝা গেল এর সত্যতা। চারদিকে ঠুকঠুক আওয়াজ। ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, কেউ বাঁশ কেটে বানাচ্ছেন হাতি-ঘোড়া। কেউ রং মাখাচ্ছেন মুখোশে। কেউ তৈরি করছেন মাটির তৈজসপত্র। কেউ আঁকছেন ছবি। ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। কারণ এসব তৈরি জিনিস বিক্রি করেই হয় পহেলা বৈশাখের আয়োজন। তাই চারুকলার কারো চোখে ঘুম নেই। চারুকলার শিক্ষার্থীরা জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রা সফল করতে বেশ খরচ হয়। তাই অর্থসংস্থানের জন্য প্রতিবছর চারুকলায় উন্মুক্ত শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এসব শিল্পকর্ম বিক্রির টাকা দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার খরচ সংগ্রহ করা হয়। চারুকলার মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ইরা বলেন, ‘বাঙালির ঐতিহ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ করতে পেরে গর্বিত বোধ করি। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ করি।’
বরাবরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হবে। আমাদের সংস্কৃতির সবকিছুই তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে এ আয়োজনে। এ বিশাল আয়োজনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারুকলার ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা করছেন সহযোগিতা। আর তাদের নানান দিক-নির্দেশনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করছেন চারুকলার শিক্ষকরা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান হলো ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে।’সূর্যের আলোকে প্রাধান্য দিয়েই শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে চারুকলার শিক্ষার্থীরা। কথা হলো চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের তৈরি জিনিসগুলো বিক্রি করে আমাদের উৎসব সাজানো হবে। তাদের কার্যক্রমের তৎপরতার ওপর আয়োজনের স্বার্থকতা নির্ভর করছে। আশা করছি আমরা সফলভাবে উৎসব আয়োজন সম্পন্ন করতে পারবো। প্রতিবারের মতো এবারো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন প্রতিকৃতি।’বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল যশোরে। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মাহবুব জামাল শামীম। শামীম এবং তার বন্ধুরা মিলে যশোরে ‘চারুপীঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার চাপাকলে বাংলা সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হয়। সেই সময়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব নিদর্শন যেমন পাপেট, মুখোশ ইত্যাদি নিয়ে তারা একটা শোভাযাত্রা করবেন। চারুপীঠ থেকে শুরু হওয়া সেই শোভাযাত্রাটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম নববর্ষের শোভাযাত্রা। এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রায় থাকে বিশালাকার চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ বিচিত্র সাজসজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রায় নতুন মাত্রা লাভ করে। সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, দেশবরেণ্য লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা অংশ নেয়।