শিল্প ও সাহিত্য

স্মরণে সত্যজিৎ

দীপংকর গৌতম : সত্যজিৎ রায়। প্রধানত চলচ্চিত্র পরিচালক। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। লেখক, চিত্রকর, সংগীতজ্ঞ এমন আরো অনেক অভিধাতেই তাকে স্মরণ করা যায়। গল্প থেকে চিত্রনাট্য সবই তিনি লিখেছেন। বহু চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন। প্রযোজক হিসেবেও আমরা তাকে দেখেছি। চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময় তাকে বহুবিধ ভূমিকায় আবিষ্কার করে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।কিশোরগঞ্জের মসুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর এই বংশধর ছিলেন অসম মেধার অধিকারী। শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রেই তিনি তার প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। অস্কারসহ অনেক বিশ্বমানের পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।তার বংশানুক্রম প্রায় দশ প্রজন্ম পর্যন্ত বের করা সম্ভব। এ থেকেই প্রমাণিত হয় তারা বংশ পরাম্পরায় প্রতিভাবান ছিলেন। তার আদি পৈত্রিকভিটা কটিয়াদী উপজেলার মসুয়ায়। তাদের সেই পৈত্রিক বাড়ি এখনও রয়েছে। যেখানে তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায় দুজনেরই জন্ম হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের অনেক আগেই উপেন্দ্রকিশোর সপরিবারে কলকাতা চলে যান। বর্তমানে তাদের প্রায় ৪ একরের বিশাল জমি ও বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে। সরকার বাড়িটি কেন্দ্র করে একটি পর্যটন স্পট তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরিকিশোর রায়চৌধুরী প্রায় দুইশ বছর আগে মসুয়ায় শ্রীশ্রী কালভৈরব পূজা উপলক্ষ্যে একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। এখনও প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

উপেন্দ্রকিশোরের সময়েই সত্যজিৎ রায়ের পারিবারিক ইতিহাস এক নতুন দিকে মোড় নেয়। উপেন্দ্রকিশোরের সন্তান সুকুমার রায়। যিনি বাংলা সাহিত্যে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। দক্ষ চিত্রকর ও সমালোচক হিসেবেও সুকুমারের খ্যাতি ছিল। ১৯২১ সালে কলকাতায় জন্ম নেন তার একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎয়ের বয়স যখন মাত্র তিন তখন বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু ঘটে। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করেন। সত্যজিৎ বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান, যদিও চারুকলার প্রতি সব সময়ই তার দুর্বলতা ছিল। ১৯৪০ সালে সুপ্রভা দেবী সন্তানকে বিশ্বভারতীতে পড়ার কথা বললে সত্যজিৎ এড়িয়ে যান। কারণ কলকাতাপ্রেমী সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনের শিক্ষার পরিবেশ সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মায়ের অবাধ্য তিনি হননি। শান্তিনিকেতনে গিয়ে সত্যজিৎ প্রাচ্যের শিল্পের মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। পরে তিনি সেকথা স্বীকার করেন এই বলে যে : ‘আমি নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। শান্তিনিকেতনে না এলে তা সম্ভব ছিল না।’১৯৪৩ সালে সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ না করেই কলকাতা চলে আসেন। এখানে শুরু হয় তার পেশাজীবন। ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিজে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা সম্মানীতে তিনি ‘জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার’ হিসেবে যোগ দেন। চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন সত্যজিৎ রায়ের পছন্দ ছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি সুনামের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু মালিক পক্ষ ইংরেজ ও ভারতীয়দের সমান সম্মানী দিতেন না। তাছাড়া সত্যজিৎ রায় মনে করতেন, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা মূলত বোকা!সত্যজিৎ রায় খুব দ্রুতই ডি কে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ডি কে গুপ্ত তাকে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন এবং এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতা দেন। এখানে সত্যজিৎ প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন। এগুলোর মধ্যে জিম করবেটের ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন ও জওহরলাল নেহেরুর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস পথের পাঁচালীর একটি শিশুতোষ সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপুর কাজও করেন। এই উপন্যাসটি সত্যজিৎকে দারুণ প্রভাবিত করে। এবং এই গল্পটিকেই তিনি প্রথম চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন। বইটির প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি এর ভেতরের বিভিন্ন চিত্র এঁকে দেন। এগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তিনি তার নির্মিত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সাথে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সদস্য হবার সুবাদে তার অনেক বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়। এ সময় তিনি প্রচুর ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন; তিনি তাদের কাছ থেকে শহরে আসা নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর খবর নিতেন। এ সময় তিনি নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়েল এয়ার ফোর্সের এক কর্মচারীর সংস্পর্শে আসেন, যিনি সত্যজিৎ-এর মতোই চলচ্চিত্র, দাবা ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সংগীত পছন্দ করতেন।এভাবেই এগিয়ে চলছিল জীবন। সেই জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলেন বান্ধবী বিজয়া দাস। ১৯৪৯ সালের ঘটনা এটি। সে বছরই জঁ রনোয়ার দ্য রিভার চলচ্চিত্রের শুটিং করতে কলকাতা আসেন। সত্যজিৎ রনোয়ারকে গ্রামাঞ্চলে চিত্রস্থান খুঁজতে সহায়তা করেন। ঐ সময়েই তিনি রনোয়ারের সঙ্গে পথের পাঁচালীর চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে কথা বলেন এবং উৎসাহিত হন। ১৯৫০ সালে ডিজে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে পাঠান। লন্ডনে তিন মাস থাকাকালীন সত্যজিৎ প্রায় ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। এর মধ্যে ইতালীয় নব্য বাস্তববাদী চলচ্চিত্র লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (বাইসাইকেল থিপ) তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরে সত্যজিৎ বলেছেন : ‘ঐ ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময় আমি ঠিক করি চলচ্চিত্রকার হবো।’১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ দি এলিয়েন নামে একটি চিত্রনাট্য লেখেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের যৌথ প্রযোজনার এই চলচ্চিত্রের প্রযোজক ছিল কলাম্বিয়া পিকচার্স। পিটার সেলার্স ও মার্লোন ব্রান্ডো ছবিটির প্রধান অভিনেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু চিত্রনাট্য লেখা শেষ করার পর সত্যজিৎ জানতে পারেন যে, সেটির স্বত্ব তার নয় এবং এর জন্য তিনি কোনো সম্মানী পাবেন না। পরবর্তীতে মার্লোন ব্রান্ডো প্রকল্পটি ত্যাগ করেন। তার স্থানে জেমস কোবার্নকে আনার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ততদিনে সত্যজিৎ রায়ের আশাভঙ্গ ঘটে। তিনি কলকাতা ফিরে আসেন।যদিও ১৯৮২ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের ই.টি. মুক্তি পেলে অনেকেই ছবিটির সাথে সত্যজিৎ-এর লেখা চিত্রনাট্যের মিল খুঁজে পান।সত্যজিৎ ১৯৮০ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড  ম্যগাজিনে প্রকাশিত একটি লেখায় প্রকল্পটির ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন। পরে সত্যজিৎ রায়ের জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসন এই ঘটনার ওপর আরও বিস্তারিত লেখেন (১৯৮৯ সালে প্রকাশিত দি ইনার আই)। সত্যজিৎ বিশ্বাস করতেন যে, তার লেখা দি এলিয়েন-এর চিত্রনাট্যের মাইমোগ্রাফ কপি যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে না পড়লে স্পিলবার্গের ছবিটি বানানো হয়ত সম্ভব হত না।চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার- এই তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে অপু ত্রয়ী বলা হয়। এই চলচ্চিত্রত্রয়ী তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বহুল স্বীকৃত। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনি লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে খ্যাত হলো ১৯৯২ সালে পাওয়া একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার (অস্কার)। জীবনে কাজের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন অজস্র। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ-এর চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা।’অন্যদিকে তার নিন্দুকেরা মনে করেন, তার ছবিগুলো অত্যন্ত ধীর গতির আধুনিকতা-বিরোধী। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন : ‘আমার কিছুই করার নেই।’ তবে কুরোসাওয়া সত্যজিৎ-এর পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘তার ছবিগুলো মোটেই ধীরগতির নয়। বরং এগুলোকে শান্তভাবে বহমান এক বিরাট নদীর সাথে তুলনা করা যায়।’ এটা ঠিক যে, ভারতে ও বিশ্বব্যাপী বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে সত্যজিৎ রায় একজন সাংস্কৃতিক প্রতিভূ। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তিনি সুগভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন।রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়