শিল্প ও সাহিত্য

সমকালের কবিতায় নজরুলের প্রভাব

ড. হোসনে আরা জলী : একজন লেখক যখন তাঁর দেশ এবং সমাজের নিজস্ব ভাবধারা ও চেতনা রক্তের স্পন্দনে অনুভব করেন তখনই তাঁর পক্ষে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়। এ জন্যে প্রথমেই তাঁকে যে সত্যটি উপলব্ধি করতে হয় তা হলো, ব্যক্তিমনের চেয়ে দেশাশ্রিত মনকে বড় করে দেখা। বাংলা সাহিত্যে ব্যক্তি, বর্ণ সব কিছুর উর্ধে দেশকেই বড় করে দেখেছেন এমন কোনো কবি-সাহিত্যিকের নাম বলতে গেলে প্রথমেই যাঁর নামটি উচ্চারিত হয় তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই বাংলা  কাব্যজগতে তাঁর আবির্ভাব। যখন তাঁর খ্যাতি মধ্য গগণে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। এই দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকু ছিল অস্থির, বিক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক- সবখানে ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থা। নজরুল তাঁর সমকালীন সমাজের এই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পুর্ণরূপে পরিচিত হয়েই কাব্য রচনায় ব্রতী হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন বলেই হয়তো বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দেশের বিশৃঙ্খল-বিক্ষুব্ধ অবস্থা রক্তের স্পন্দনে অনুভব করতে পেরেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর এ অবস্থা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপলব্ধি করেন নি, তা বলা যাবে না। অবশ্যই করেছিলেন। কিন্তু এটাও সত্য যে, কবিতা লেখার সময় বাইরের জগতের এই আন্দোলন তিনি স্বচ্ছন্দে পরিহার করেছিলেন। এই সত্য উপলব্ধি করা যায় তাঁর এ সময় প্রকাশিত তিনটি কাব্য ‘পূরবী’, ‘মহুয়া’, ‘লিপিকা’ থেকে। তিনটিই প্রেমের কাব্য। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের প্রেম, গ্রাম-বাংলার  নিসর্গ বর্ণনা বিষয়ক কবিতা তখন বাংলাকাব্যে এক ধরনের ভাবালুতায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এমন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই তখন রবীন্দ্রকাব্য ধারা থেকে একটি স্বতন্ত্র কাব্যধারা সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কাব্যধারায় থাকবে সমকালের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চকণ্ঠ, যা একজনের হয়েও হবে সকলের। বিশের দশকে এমন স্বতন্ত্র কাব্যধারা সৃষ্টিতে অঙ্গীকারবদ্ধ যে তিনজন কবিকে আমরা পাই তাঁরা হলেন- কবি মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং কাজী নজরুল ইসলাম। উল্লিখিত তিনজনের মধ্যে নজরুল ইসলাম ব্যতিক্রম।ব্যতিক্রম এ জন্যে যে, নজরুল ইসলাম অস্থির সমাজ ও সময়ের আন্দোলন সচেতনভাবে তাঁর কাব্যে তুলে ধরে যেমন তরুণ কবি গোষ্ঠী ও পাঠককে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন তেমনটি অন্যদের ক্ষেত্রে ততটা ঘটেনি। তিনি বাংলাকাব্য ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। নজরুল প্রবর্তিত এই কাব্যধারা হলো বিপ্লবের, বিদ্রোহের। আর এ জন্যেই তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সমালোচক তাঁকে মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো যুগ-প্রবর্তক কবি বলেও অভিহিত করেছেন। আবার অনেকেই নজরুলের এই স্বতন্ত্র বিদ্রোহের  ধারা স্বীকার করতে চান নি। বরং তাঁর লেখায় অনৈসলামিকতা আবিষ্কার করে তাঁকে শয়তান, নরাধম, খোদাদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী, ফেরাউন নজরুল ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। কেউ আবার রবীন্দ্রানুসরণ দেখতে না পেয়ে নিন্দে  করেছেন। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেখানে নজরুলকে বরণ করে নিয়েছিলেন সেখানে রবীন্দ্র অন্ধভক্ত  ‘প্রবাসী’ নজরুলকে কবি সমাজ থেকে বাদ দিতেও দ্বিধা করেনি! ‘প্রবাসী’ কর্তৃপক্ষপুষ্ট ‘শনিবারের চিঠি’  নজরুলের সাহিত্যাদর্শ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতায় সব সময়ই সচেষ্ট ছিল। তবে এটা ঠিক যে, নজরুল সম্পর্কে বিশের দশকে যত বিরুদ্ধ সমালোচনাই হোক না কেন, নজরুল যে বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু দান করেছেন তা কেউ স্বীকার করুক বা না করুক এ কথা ক্রমশ সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জাতির পক্ষ থেকে কলকাতা এ্যালবার্ট হলে নজরুলকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভাষণেও তা স্পষ্ট। সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন : ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর  গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই।  . . . দুর্গমগিরি কান্তার মরুর কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা শুধু তাঁর  নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির।’আর প্রফুল্লচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেন : ‘ফরাসী বিপ্লবের  সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়িতেছিলাম। তাহাতে লেখা দেখেছিলাম, সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতিমানুষে পরিণত হইবে।’জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৯), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১), জসীম উদ্দীন (১৯০৩), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮), সুবীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০৮), বিষ্ণুদে (১৯০৯), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯০৯) প্রমুখ বয়সের দিক থেকে নজরুলের  সমসাময়িক হলেও কাব্য রচনার ক্ষেত্রে  নজরুলের এক দশক পরের কবি। নজরুল বিশের এবং অন্যরা  ত্রিশের কবি হিসেবে পরিচিত। তিরিশের এই কবিদের নজরুল প্রভাবিত করেছেন। আবার তিরিশের এই কবিরাও কোনো না কোনোভাবে নজরুল দ্বারা প্রভাবিত। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্র মোহন বাগচী, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আবুল হোসেন, গোলাম মোস্তাফা প্রমুখ বয়োজ্যেষ্ঠ কবি। কল্লোল গোষ্ঠীর অনেক খ্যাতনামা কবিও নজরুলের কাব্য থেকে ঋণ-গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে ১৩৩০ ও  ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত ‘কল্লোল’ ও ‘কালি কলম’ পত্রিকার মাধ্যমে একদল তরুণ সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে যারা রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত হয়ে নজরুলের বাস্তব বিদ্রোহাত্মক চেতনা ধারণ করে লেখালেখি করেন।জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম পর্যায়ের কাব্যে নজরুলের অনুসারী। যদিও দুজনের কাব্যধারা ভিন্ন তবুও কোনো কোনো বিষয়ে সামান্য হলেও  জীবনানন্দের ওপর নজরুলের প্রভাব পড়ে