শিল্প ও সাহিত্য

সুফিয়া কামালের দর্শন এবং সময় বাস্তবতা

সাইফ বরকতুল্লাহ : স্বাধীন বাংলাদেশের নারী জাগরণ ও মুক্তি সংগ্রামে সুফিয়া কামাল এক ইতিহাস। একটি পশ্চাৎপদ দেশে যে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিবার, সমাজ পরিচালিত ও প্রভাবিত সেখানে নারীর ব্যক্তি অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আদর্শ চেতনা বিকশিত করার সংগ্রামে বেগম সুফিয়া কামাল নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

 

নারী পুরুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার জন্য তিনি লাগাতার সংগ্রাম করেন। শুধু তাই নয়, তিনি সাহিত্য সাধনায় ছিলেন অগ্রদূত। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা `হেনা` সুফিয়ার মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে। গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাকে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি মোহগ্রস্ত হন তিনি। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাকে উৎসাহিত করেছে।

 

বিয়ের সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফএ পাস করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ লাভ করেন সুফিয়া কামাল। যা তাকে সাহিত্যচর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে।

 

নারী জাগরণের কথা এলে মানসপটে জ্বলজ্বল করে ওঠে সুফিয়া কামালের নাম। পরাধীন দেশে নারীকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি অগ্রগণ্য। অন্যায়, অসত্য আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু সরব ছিলেন। বাংলাদেশে নারী নেতৃত্ব তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তাকে গণ্য করা হয় মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কবি ও সমাজসেবী হিসেবে। এর বাইরেও তার স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। সুফিয়া কামাল অধ্যয়ন করলে শত বছরের নারী আন্দোলনের ইতিহাস জানা যায়। নারীর অধিকার অর্জনের আন্দোলন সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হয় পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের নানাবিধ বৈষম্য-অসাম্যের বিরুদ্ধে।

 

শুধু তাই নয়, আজকে যদি বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা নিয়ে ভাবা যায়, তাহলে দেখা যায় বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়- তাতে নারী নির্যাতনের ভয়ংকর চিত্র দেখা যায়। পুলিশ সদর দফতরের হিসেব অনুযায়ী, গত চার বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬৭ হাজার ২২৯টি, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১২ হাজার ৯৭১ জন। যৌতুক ও নানা কারণে স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই হাজার পাঁচজন নারী। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৪৪২ জন আর নির্যাতনের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে আরো এক হাজার ৬৬১ জন নারীকে।

 

জাতীয় মহিলা পরিষদ গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে নারী নির্যাতনের একটি পরিসংখ্যান তৈরি করে। এই ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন নারী। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরো ৫১ জন। বাংলাদেশের নারীরা প্রতিনিয়তই এ ধরনের অবস্থার শিকার হচ্ছেন।

 

গত দশ বছরে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থার চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নির্যাতনের নানা তথ্য। গত ৮ জানুয়ারি ২০১৫ দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের তুলনায় পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা ১১ শতাংশ এবং পারিবারিক নির্যাতন ৪৪ শতাংশ বেড়েছে।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, শুধু পত্রিকার খবর অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে ‘ঘরোয়া নির্যাতনে’ মারা গেছেন ৯৯ জন নারী। এর মধ্যে স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন, স্বামীর প্রহারে মারা গেছেন ৫৮ জন, স্বামীর পরিবারের লোকজনদের অত্যাচারে নিহত ১০ এবং নিজের আত্মীয়দের প্রহারে প্রাণ হারিয়েছেন চার জন নারী। যৌতুকের বলি হয়েছেন ৪৩ জন নারী।

 

এই সংবাদগুলো প্রমাণ করে নারী সমাজকে এখনও সুফিয়া কামালের দেখানো পথেই হাঁটতে হবে। কারণ বিংশ শতাব্দীর বাংলার নারী জাগরণের সঙ্গে এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিচিত্র ইতিহাসের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালের নাম নিবিড়ভাবে জড়িত। সময়ের দাবিতে ব্যক্তিগত জীবনের মতো তিনি স্বপ্ন দেখতেন সবুজ পৃথিবীর।

 

বেগম সুফিয়া কামাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনীতিক, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। একজন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও শৃঙ্খল ভেঙেছেন তিনি। নারীদের এনেছেন মুক্ত আলোর সন্ধানে। তিনি কবিতায় বলেছেন :‘তোমার আকাশে দাও মোর মুক্ত বিচরণ-ভূমি,শিখাও আমারে গান। গাহিব, শুনিবে শুধু তুমি।মুক্তপক্ষ-বিহগী তোমার বক্ষেতে বাঁধি নীড়যাপিবে সকল ক্ষণ স্থির হয়ে, চঞ্চল অধীর।               [ সূত্র: কবিতা-আমার নিশীথ ] ।সুফিয়া কামালের কবিতায় জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব সমাজ জিজ্ঞাসা প্রবল হয়েছে। কর্তব্যবোধের তাড়না তিনি অনুভব করেছেন। পর্দানশিন পরিবারের মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে বাল্যকালে তিনি মুক্তাঙ্গনের কোনো বিদ্যাপীঠে গমন করার সুযোগ পাননি। ঘরের মধ্যেই আরবির পাশাপাশি শিখতে শুরু করেন বাংলাভাষা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা ও পড়ার ঝোঁক।

 

এ সম্পর্কে তিনি স্মৃতিচারণে লিখেছেন : ‘এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা `হেনা` পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।`

 

সুফিয়া কামাল ১৬টি সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯২৫ সালে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি বরিশাল এলে নিজে চরকায় সুতা কেটে গান্ধীজির হাতে তুলে দেন। তিনি ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনে প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্য মনোনীত হন। বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে তিনি কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতায় লেডি ব্রেবোন কলেজে আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়োজন ও মিছিলে নেতৃত্বসহ সামগ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

 

১৯৫৪ সালে ওয়ারী মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তার নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠিত হয়। তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী নিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ করার প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠনেও ছিল তার অবদান। পরের বছর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঢাকা শহরে অবরুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন। এমনই এক কর্মজ্জ্বল মানুষ ছিলেন তিনি।

 

বেগম সুফিয়া কামালের জন্ম বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে। জন্ম তারিখ ১৯১১ সালের ২০ জুন। পৈত্রিক নিবাস ছিল ত্রিপুরা জেলার শিলাউর গ্রামে। মাত্র সাত বছর বয়সে ১৯১৮ সালে কবির বিয়ে হয় সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। ১৯৩২ সালে স্বামী নেহাল হোসেন মারা যান। এরপর তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি চলে সাহিত্যচর্চা। ১৯৩৯ সালে কবির পুনরায় বিয়ে হয় কামালউদ্দীন খানের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন। পুনরায় শুরু হয় তার নতুন জীবন। বরিশালে মাতৃমঙ্গল সেবাদানের কাজ দিয়ে সুফিয়া কামালের সমাজসেবী কর্মজীবনের শুরু। ৮৯ বছর বয়সে ২০০০ সালের ২০ নভেম্বর তার কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।

 

সুফিয়া কামালের সাহিত্যিক জীবনও ছিল উজ্জ্বল। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সাঁঝের মায়া, একাত্তরের ডায়েরী, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল, কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি। ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে। জীবদ্দশায় সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।

 

১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার `তঘমা-ই-ইমতিয়াজ` লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

 

মহিয়সী নারী বেগম সুফিয়া কামালের আজ জন্মদিন। তিনি নেই, রেখে গেছেন অনন্য কীর্তি। আমরা এ দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুন ২০১৫/তাপস রায়/সনি