শিল্প ও সাহিত্য

ইসমাইল হোসেন সিরাজী জাতীয় জাগরণের অগ্নিমন্ত্রদাতা

নাজনীন মহল অঞ্জনা : মুসলিম নবজাগরণ, হিন্দু-মুসলিম মিলন, অবরোধবিরোধী আন্দোলন, নারীশিক্ষা আন্দোলন, মাদ্রাসা শিক্ষায় ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান সম্পৃক্তকরণ, মুসলমান সমাজে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন, কৃষক প্রজার দুর্দশা মোচন ইত্যাদি বহুমুখী কর্মকাণ্ডে কীর্তিমান ইসমাইল হোসেন সিরাজী। অথচ তিনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা, অচেনা। বিশেষ দিনগুলোতে বিভিন্ন আলোচনায় অথবা পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, এমনকি ইতিহাসে এ নামটি প্রাপ্য মর্যাদা পায় না, উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়। জানি না কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষকদের এটা ইচ্ছাকৃত না ভুলবশত! তবে এতে যে জাতি তার সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এ কথা বলা যায়।

 

ইসমাইল হোসেন শিরাজী ছিলেন জাতীয় জাগরণের অগ্নিমন্ত্রদাতা। শিরাজী প্রসঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘একটি সুপ্ত জাতিকে কলঙ্কলিপ্ত করিতে না দেওয়া এবং ঘুমন্ত জাতিকে জাগাইয়া অতীত গৌরবের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করিবার কঠিনতম পথে একাকী তিনি অগ্রসর হইয়াছিলেন। আমাদের তরুণ বয়সে তাঁহার ‘অনল প্রবাহ’ রক্তে রক্তে বিদ্যুতের সঞ্চার করিয়াছিল।’ (৫ মার্চ ১৯৪৬)।

 

‘অনল প্রবাহ’ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বইটি ১৮৯৯ সালে যখন প্রকাশিত হয়, তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। ১৯০৮ সালে কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ ওঠে। ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন ইংরেজ শাসক ১৯১০ সালের মার্চে মামলা করে। সে বছর আদালত তাকে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। সিরাজীই উপমহাদেশের প্রথম কবি যিনি স্বাধীনতার জন্য, জাতীয় জাগরণের জন্য কবিতা লিখে জেলের ঘানি টানেন। শুধু তাই নয়, তার কণ্ঠ রোধ করার জন্য তার বক্তৃতা ও সভাস্থলে ব্রিটিশ সরকার ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করেছিলো।

 

পুরুষ শাসিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ উঠে এসেছিল উনিশ বছরের তরুণের কলমে। তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে অন্ধকার অবরোধের প্রাচীরে বন্দী অসহায় নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতার কথা। তিনি লিখেছ্নে :

‘স্ত্রী জাতির তরে দাও শিক্ষা দাও

জাতীয় উত্থানে তাদেরো মাতাও

বাল্য পরিণয় উঠাইয়া দাও

সাম্য স্বাধীনতা তাহাদের দাও

উদিবে অচিরে সৌভাগ্য তপন।’

 

তিনি নির্ভীক কণ্ঠে বলেছেন, ‘যাহারা নারীকে পেছনে রাখিয়া অন্ধ অন্তঃপুরের বেষ্টনে বেষ্টিত রাখিয়া জাতীয় জাগরণের কল্যাণ কামনা করে, আমার বলিতে কুণ্ঠা নাই তাহারা মহামুর্খ!’

 

আজ থেকে কত বছর আগে, সেই ১৯০৪ সালে তিনি বলেছেন, ‘পুরুষ সমাজের দেহ, আর মাতৃজাতি সেই দেহের আত্মা।’ ১৯০৪ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষা সমিতির তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে মানুষের স্বাধীনতা হরণের ন্যায় পাপকার্য আর কিছুই নাই। যেরূপ পরাধীনতা মানুষকে নির্বোধ এবং অজ্ঞ করিয়া রাখে, যে পরাধীনতা পরম করুণাময় খোদাতায়ালা প্রদত্ত পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়কে জ্ঞান ও শিক্ষার অমৃত রসাস্বাদন হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখে, সেরূপ পরাধীনতা হইতে মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়। ...তাহা হইলে অকারণে নারী জাতিকে সদা সর্বদা অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখা কীরূপ ভীষণ ও ভয়াবহ পাপ!... দেশে এ পর্যন্ত একটি মুসলমান বালিকাও ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হয় নাই। ইউরোপীয় স্ত্রীলোকগণ যেমন স্বচ্ছন্দে সর্বক্ষেত্রে অনায়াসে গমনাগমন করে তা দেখিলেও আনন্দ হয়।’

 

ইসমাইল হোসেন সিরাজী শুধু বলেই থেমে থাকেননি। পথ প্রদর্শনের জন্য নিজের ছয় বছরের শিশুকন্যাকে ঢাকার ইডেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে হোস্টেলে রেখে যান। বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৮৩২) ও সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) ছিলেন সমবয়সী। দুজনেই নারী জাগরণে কাজ করে গেছেন। সৌভাগ্যবশত রোকেয়ার অবদান বিদিত হলেও সিরাজী অপ্রচ্ছন্নই রয়ে গেছেন। বর্তমান নারী সংগঠনগুলো এবং নারী নেত্রীরাও হয়তো জানেন না, কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা আর অবরোধের প্রাচীর ভেঙে নারী প্রগতি আজকের যে অবস্থানে দাঁড়িয়েছে এর মূলে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর রয়েছে অবদান। কবি আব্দুল কাদির এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মুসলমান সমাজে শিরাজী হচ্ছেন স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মানিত পুরোধা।’

 

শিরাজী উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘দুনিয়ার বুকে আবার শুদ্ধ ও মুক্ত হইয়া দাঁড়াইতে নারীর উত্থান, শিক্ষা, সহানুভূতি ও সাহস চাই।’ এরপর তিনি পুরুষ সমাজের কাছে আবেদন করেছেন, ‘এ বঙ্গে যদি কেহ জাতীয় উত্থানকামী তেজোদীপ্ত মহাপ্রাণ পুরুষ থাকে, তবে সর্বাগ্রে মাতৃজাতির সুশিক্ষার বন্দোবস্তকরত অধঃপতনের খরস্রোত রুদ্ধ করিতে বদ্ধ পরিকর হও। নারী শক্তিকে জাগাইতে না পারিলে সন্তানের শক্তি, সন্তানের প্রাণ আসিবে কোথা হইতে ?’

 

১৯১৩ সালে তুরস্কের বলকান যুদ্ধ থেকে শিরাজী ফিরে আসেন। এ বছর তার ‘তুর্কী নারী জীবন’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পর্কে হিতবাদী পত্রিকা মন্তব্য করে : ‘পুস্তকখানী কেবল মুসলমান বলিয়া নহে, প্রত্যেক হিন্দু রমণীরও পাঠ করা উচিত।’ প্রবাসী পত্রিকায় মন্তব্য প্রকাশিত হয় : ‘গ্রন্থকার শিক্ষিত ও বহুদেশ দর্শনে মার্জিত বুদ্ধি বলিয়া অবরোধ প্রথা ও অজ্ঞান অশিক্ষার যথেষ্ট নিন্দা করিয়াছেন। আমাদের মুসলমান ও হিন্দু সমাজ ইহা হৃদয়ঙ্গম করিলে দেশে শুভকর্মের সূচনা সহজ হইয়া আসিবে।’

 

শিরাজী তথাকথিত পর্দাপ্রথাবিরোধী ছিলেন এবং মুসলিম নারী জাগরণে অত্যুৎসাহী ছিলেন। আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে এই ভাবধারার অনুসারী হতে দেখি। শিরাজী ইসলামকে নারীর মুক্তিদাতা হিসাবে দেখেছেন এবং সে জন্যেই  মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্য বক্তৃতা দিয়েছেন, ওজস্বিনী ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন, তা বাস্তবায়িত করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তারই উত্তরাধিকার কাজী নজরুল ইসলাম।

 

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ শিরাজী প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেকালে মুসলিম সমাজে মহিলাদের জন্যে কঠোর পর্দাপ্রথা বা অবরোধপ্রথা চালু ছিল। শিরাজী সাহেব সভাসমিতিতে এ অবরোধ প্রথার সরাসরি প্রতিবাদ করতেন। তিনি কোরআন-হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, পর্দা ইসলামের একটি অপরিহার্য অঙ্গ কিন্তু বর্তমানে যে পর্দা চালু তা ইসলামের পর্দা নয় বরং তা ইসলামবিরোধী অবরোধ প্রথা। নিজ কন্যা ফেরদৌস মহলকে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করানো এবং কোনো কোনো সভায় কন্যাকে দিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করাতেন। শিরাজী সাহেব ইসলামে সঙ্গীত হারাম নয় প্রমাণ করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।’

 

সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীকে প্রগতি ও আধুনিকতার জন্য মানসিক নির্যাতন এমনকি শারিরীক নির্যাতনও সইতে হয়েছে। তবে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদাবোধ তার চলার পথকে করেছিল আরো সাহসী ও গতিশীল। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বজ্রের মত কঠিন আর ন্যায় ও সত্যের প্রতি কুসুমকোমল। বীর শিরাজী প্রহৃত হয়ে রক্তাক্ত শরীরে লেখেন :

‘এ সংসারে জন্ম লোভি না সহিয়া মূর্খের প্রহার

মানুষ হয়েছে কে বা বল এই পৃথিবী মাঝার।

...

যতই করিবি তোরা শত অত্যাচার অবিচার

ততই যে তেজানল হবে ভীম প্রবল আকার!

বারে বারে বীরে কণ্ঠে  বলিতেছি শুনে লও আজি

আল্লাহ ছাড়া এ জগতে কাহারেও মানে না শিরাজী।’

 

‘অনলপ্রবাহ’, ‘উছ্বাস’, ‘উদ্বোধন’, ‘মহাশিক্ষা’ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি ‘তারা-বাঈ’, ‘রায়নন্দিনী’, ‘জাহানারা’সহ বেশ কয়েকটি উপন্যাসও রচনা করেছেন। তার দুইটি সঙ্গীতগ্রন্থ হলো, ‘সঙ্গীত সঞ্জীবণী’ এবং ‘প্রেমাঞ্জলি’। এ ছাড়াও ‘স্বজাতি প্রেম’, ‘আদব কায়দা শিক্ষা’, ‘স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা’, ‘সুচিন্তা’, ‘তুর্কী নারী জীবন’ শিরোনামে কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থও রচনা করেছেন। তার একমাত্র ভ্রমণ কাহিনী ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে।

 

শিরাজী বাঙালি জাতি তথা মুসলিম বাংলার জাগরণের দূত হিসেবে পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও তৎকালীন শোষকগোষ্ঠীর সকল বাধা অতিক্রম করতে চেয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। বাংলা গদ্য সাহিত্যে মুসলিম লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা সৈয়দ আবদুল করিম (খন্দকার) ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। সে যুগের অন্যতম বিদূষী মহিলানূরজাহান বেগম ছিলেন তার মা। আরবি, ফার্সি, বাংলা ভাষায় তার দখল ছিলো ঈর্ষণীয়। প্রবল দেশপ্রেমেরঅধিকারী ছিলেন এই মহীয়সী নারী। মায়ের সমস্ত গুণই ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মাঝেপ্রস্ফুটিত হয়েছিলো। ১৯৭২ সালের ১৭ জুলাই জাতীয় জাগরণ তথা আজকের এই নারী জাগরণের অগ্রদূত ইসমাইল হোসেন সিরাজীমৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে, রাজনীতিতে, শিল্প সাধনায়, বিজ্ঞানচর্চায়, নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তির জন্য তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে এটুকুই প্রত্যাশা।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়