শিল্প ও সাহিত্য

রম্যরচনা || রেলস্টেশনে কেন ঘড়ি রাখা হয়

তাপস রায়ম্যাচের কাঠির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লম্বা লাইন।লাইনে বেলাইন হলেই মুশকিল। জ্যামে আটকে পড়া গাড়ির মতো লাইন একটু একটু করে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগুচ্ছে। আমার সামনে যিনি ছিলেন তিনি সিরিয়াল পাওয়া মাত্র কাউন্টারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। পারলে মাথাটাও ঢোকাতেন, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। বেচারা মাথা হেলিয়ে এক চোখ বন্ধ করে কাউন্টারের ওপাশটায় উঁকি দিয়ে বললেন- ভাই, আম্বিয়া বু’র একটা টিকিট দ্যান। ট্রেন তো আম্বিয়া বু যায় না। ওপাশ থেকে টিকিট মাস্টারের গলা শোনা গেল। রোবট টাইপের গলা।ছোরি ভাই! আম্বিয়া বু মানে বুবুর জন্যে একটা টিকিট দ্যান।বেচারা টিকিট নিয়ে সরতেই আমার পালা। এক পা এগিয়ে এসে কাউন্টারে হাত ঢুকিয়ে দিতেই পুনরায় রোবট গলা শোনা গেল- কই?টঙ্গী। আজ বোধ হয় ট্রেন লেট। পাঁচটার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে?চারটা ষাট মিনিটে। বুঝলাম রোবটের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। টিকিট হাতে নিয়ে প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালাম। পাঁচটা টপকে ঘড়িতে এখন পাঁচটা পঁচিশ।  অথচ ট্রেনের দেখা নেই। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ মানিব্যাগের চিপা থেকে ত্যানাত্যানা পাঁচ টাকার নোট বের করে বাদাম কিনে চিবুচ্ছে। কেউ বসে ঝিমুচ্ছে, কেউ রস মাখিয়ে বলছে, অনেকেই তা শুনছে, শুনে কেউ হাসছে, হাসতে হাসতেই অনেকে ফাঁসছে (মানিব্যাগটা কই গেল?), কেউ ফেঁসে গিয়ে ঘামছে। আর যারা ঘামাঘামিতে নেই, স্টেশনের আপেল-কমলা দামাদামিতে নেই, মালামাল টানাটানিতে নেই, রাজনীতির হানাহানিতে নেই তারা জানাজানিতে ব্যস্ত। অর্থাৎ তারা পড়ছে।এ ধরনের পাঠক সাধারণত পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শুরু করে ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনের পাতাও পড়েন, কিন্তু বলেন না। তারপরও রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, দুর্নীতি, সুনীতি বারো ভাজা আলোচনায় পুরো প্লাটফর্ম গমগম করছে। আমি তিতিবিরক্ত ভাব নিয়ে বসে আছি। এমন সময় আম্বিয়া বু’র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বুবুর পাশে সেই ভদ্রলোক। সম্ভবত বুবুকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। এখন ট্রেনের বাবা-মা তুলে গালাগাল করছেন। হঠাৎ স্টেশন মাস্টারকে দেখে বেচারা হেরে গলায় তার দিকে তেড়ে গেলেন- আপনাদের টাইম-টেবিলের বাড়িঘর নাই, অথচ ঘড়ি লটকাইয়া রাখছেন। ট্রেনই যখন সময়মতো আসে না তখন ঘড়ি রাইখা ফায়দা কি?ঘড়ি না থাকলে বুঝবেন কীভাবে ট্রেন সময়মতো আসছে কি আসে নাই? বলেই স্টেশন মাস্টার হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন।অথচ আপনি রেলে ভ্রমণ করলেই বুঝবেন যাত্রী সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আরে ভাই, এই দুর্দিনের বাজারে এমন ফ্রি সার্ভিস আর কোথায় পাওয়া যাবে বলুন? কোথায় যেন গল্পটি শুনেছিলাম, এক লোক বেশ বড় একটি বস্তা নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। এক সময় টিটি এসে টিকিট দেখতে চাইল। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল বস্তার ওপর। সে বস্তার জন্য আলাদা টাকা দাবি করে বসল। কিন্তু সেই লোক ঠ্যাটা কম নয়, সে কিছুতেই টাকা দেবে না। টিটিও তার দাবিতে অনড়। শুরু হলো তর্ক। তর্কের তেজ যখন অর্কের সমান প্রায় তখন লোকটি উপায় না দেখে অর্ধেক ভাড়া দিতে রাজি হলো। কিন্তু টিটির তাতেও মন গলে না। সে হাতা গুটিয়ে, মাথায় টুপি চাপিয়ে, ঠোঁট বাকিয়ে, ভ্রু-যুগল নাচিয়ে চলল রেল পুলিশ ডাকতে। এবার উপায় না দেখে সেই লোক বস্তার মুখ খুলতে খুলতে বলল, ওগো তুমি বেরিয়ে এসো। পুরো পয়সাই যখন দিতে হবে তখন তুমি আর বস্তার মধ্যে থেকে কি করবে?প্লাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছি, অনেক কথা মনে পড়ছে। একবার ট্রেনে আখাউড়া যাচ্ছি। ঢিলা ট্রেন। স্টেশনে তো থামছেই,  রাস্তাতেও যখন যেমন খুশি থামছে। অথচ আমার মনটা উড়ু উড়ু। পাশের  ভদ্রলোক কখন আসন থেকে উঠেছেন খেয়াল করি নি। সংবিৎ ফিরে পেলাম তার খেদ মেশানো কণ্ঠে-  দ্যাকছেন কারবার, টয়লেটে গিয়া ফ্লাশ টানলাম পানি তো পড়লই না, উল্টা ছিঁড়া গেল। যত্তসব!অভিযোগ টিটিকে জানাতেই তিনি আমাদের নিয়ে সরেজমিনে বাথরুম পরিদর্শন করে উল্টো আমাদের কাছেই অভিযোগ জানালেন, কিছুদিন আগেই বাথরুমের ফিটিংসগুলো লাগিয়ে বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়েছিলাম- রেল আপনাদের সম্পত্তি, এর হেফাজত আপনাদেরই কর্তব্য। অথচ দেখুন বাথরুমের আয়না গতকাল থেকে দেখছি না।খেয়াল করে দেখলাম অভিযোগ সত্যি। ফিরে আসব এমন সময় চোখ আটকে গেল একটি লেখায়। বিজ্ঞপ্তির নিচেই জনৈক ব্যক্তি লিখে রেখেছেন- নিজের সম্পত্তি মনে করে আয়নাটি নিয়ে গেলাম। হেফাজতের কোনো ত্রুটি হবে না। হঠাৎ দেখি স্টেশন মাস্টার ফিরে এলেন। তারপর কী মনে করে নরম গলায় বললেন, ট্রেন চলে আসবে। বসুন। বসার সময় নাই। ভদ্রলোক বললেন, বসলেই লেট হয়া যাবে। আপনে ড্রাইবাররে একটা মোবাইল করেন না। দ্যাখেন কই আছে। কোনো লাভ নাই! আচমকা এই বাক্যের উৎস খুঁজতে স্টেশন মাস্টার, আম্বিয়া বুসহ সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি গায়ে লালসালু জড়ানো এক জটাধারী। বগলের নিচে ঝোলানো কাপড়ের পুটলি, মুখে রবীন্দ্রনাথ মার্কা দাড়ি। ঠোঁট দেখা না গেলেও উপস্থিত আমরা নিশ্চিত এ বাণী তারই দেওয়া। জটাধারী পুনরায় বাণী দেওয়ার আগেই স্টেশন মাস্টার ধমকে উঠলেন- এই কই যাবি? টিকিট আছে?আমার টিকিট! যেন আকাশ থেকে পড়ল জটাধারী। তারপর সেই আকাশ কাঁপিয়েই গর্জে উঠে বলল, তোরা ডুববি। এই আমি দিব্যজ্ঞানে বইলা দিলাম। এই ট্রেন, ট্রেনের চাকা, বগি, ইঞ্জিন সব, স-ব ধ্বংস হয়া যাবে। ঠিক আছে, আগে টিকিট বের কর। স্টেশন মাস্টার বললেন।আমি সিদ্ধ পুরুষ। আমার আবার টিকিট কি? জটাধারী গো ধরে রইলেন।সে যুগে মুনি-ঋষিদের সেরা অস্ত্র ছিল অভিশাপ। এ যুগেও সাধু বাবারা কেন অভিশাপ দেয় বুঝতে পারলাম। শুধু বুঝল না আম্বিয়া বু। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পাঁচ ভাঁজ দেওয়া পুরনো একটা পাঁচ টাকার নোট তিনি সাধু বাবাকে দিয়ে দিলেন। কিন্তু সাধুবাবা তার ব্রহ্মাস্ত্র ফিরিয়ে নিলেন নো। স্টেশন মাস্টারের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে ‘সব, স-ব ধ্বংস হয়া যাবে’ বলতে বলতে তিনি দক্ষিণ দিকে হাঁটা ধরলেন।রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়