শিল্প ও সাহিত্য

নিমাই দা’র সাইকেল চড়া || ইবনুল কাইয়ুম

সান্টুদের পাড়ার নিমাই। যেমন চিকন, তেমনি তাল গাছের মতো লম্বা। মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো তার সজারুর কাঁটার মতো সোজা। নাপিতের জন্য খুব সুখকর বিষয়, সহজেই কেটে ফেলতে পারে সে নিমাইয়ের চুল। দুষ্টুমীতে ভরা চোখের চাহনী নিমাইয়ের। সারক্ষণ মনের মধ্যে কি যেনো সব দুষ্টুমি পাকাচ্ছে- তারই কিছুটা ছটা সেই চোখের তারায় ছড়িয়ে থাকে সারাক্ষণ।

 

লম্বা লম্বা পা ফেলে যখন সে হেঁটে যায় সান্টুরা সবাই হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় আস্ত একটা তাল গাছই বুঝি হেঁটে চলেছে। মানুষ এতো লম্বা হয় কি করে তা সান্টুদের ছোট্ট মাথায় আসে না। কার‌ণ সান্টু ও তার বন্ধুরা নিমাইয়ের হাঁটুর সমান লম্বা হবে বড়জোর। সান্টুদের হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে নিমাই তখন একটা চোখ টিপে গাল ‍বাঁকিয়ে কায়দা করে হাসে। সেই হাসিতে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই কারো। ওরাও ফিক করে হেসে ফেলে। নিমাইকে ওরা দাদা বলেই ডাকে। সামান্য সংক্ষেপে নিমাই দা।

 

নিমাই দা দেখতে দশাসই হলে কি হবে, মোটেও কিন্তু গম্ভীর না। খুবই সরেস লোক এই নিমাই দা। যাকে বলে একেবারে রসের হাড়ি। ছোটো বাচ্চাদের সঙ্গে তার খুব ভাব। মজার মজার গল্প শুনিয়ে আর কাণ্ড করে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার ওস্তাদ। তাই যখন সে পাড়ার মধ্য দিয়ে যায় বাচ্চারা সবাই নিমাইকে পেছন থেকে ‘নিমাই দাঁড়া হে’ করতে করতে ছুটে আসে। ‘নিমাই দাদা হে’ কালক্রমে ‘নিমাই দাঁড়া হে’ তে গিয়ে ঠেকেছে আরকি।

 

একদিন নিমাই দা একটা সাইকেল কিনে নিয়ে এলো। পাড়ার ছেলেবুড়ো মিলে নিমাই দার সাইকেল দেখতে ছুটল। সান্টুও গেলো। উঠোনের একে কোণে সাইকেলটি ডাবল স্ট্যান্ড দিয়ে রাখা হয়েছে। নিমাই দা এক মনে সেটির শরীরে তৈল চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। চেইনে তেল দিয়ে মাঝে মাঝে প্যাডেল উল্টো দিকে ঘোরাচ্ছেন। সে সময় এক ধরনের চোঁ চোঁ শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের বাতাসে। সামনের দিকেও মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে পেছনের চাকার ক্ষিপ্রতা দেখে নিচ্ছেন। তার এই প্যাডেল ঘোরানোর কাজে সাহায্য করার জন্য নূর আলম যেচে পড়ে হাত বাড়ায়।

 

নিমাই দা সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্যাডেলটি ছেড়ে দেয়। নূর আলমও খুব ভাব নিয়ে প্যাডেল ঘোরায়। মাঝে মাঝে অন্যদের দিকে তাকিয়ে নিজের মাহাত্ম্য বোঝানোর চেষ্টা করে সে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ পেছন থেকে কে যেনো নূর আলমের মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দেয়। উহু করে পেছনে তাকায় সে। সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ে না। তবে ভিড়ের বাইরে একজনকে ঠিকই ছুটে পালাতে দেখা যায়। পেছন থেকে তাকে দেখে খাইরুলের মতোই মনে হলো।

 

সান্টু সাইকেলটিকে ভালো করে দেখতে থাকে। বড় বড় চাকা। সিট অনেক উপরে। প্রায় পাহাড় সমান উঁচু মনে হলো তার। নিমাই দার মতোই উঁচু তার সাইকেল। বেল নেই। সামনের চাকায় মাডগার্ড নেই। অবাক হয়ে সান্টু দেখল সাইকেলের কোনো ব্রেকও নেই! নিমাই দা এমন নেই নেই পূর্ণ সাইকেল কেমন করে চালাবে সেটাই ভেবে পেলো না সে। সখ করে নিমাই দার সাইকেলে একটু চড়ারও ইচ্ছে হয়েছিল তার। তবে এমন পাহাড়ের মতো উচ্চতা দেখে ভয় পেয়েছে সে।

 

নিমাই তার সদ্য কেনা মরিচা ধরা সাইকেলটিতে এমনভাবে তৈল মর্দন করছে যেনো এখুনি সেটা চকেচকে নতুন হয়ে উঠবে। এক মনে নিজের কাজ করে চলেছে সে। গাট্টা খাওয়া স্থানে হাত বুলাতে বুলাতে নূর আলমও প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছে। কখনো সামনে, আবার কখনো পিছনে চোঁ...চোঁ...ঝাঁ...ঝাঁ আওয়াজও হচ্ছে। আর তাদের ঘিরে গোল হয়ে বসে থাকা ছেলের দলের কাছ থেকে মাঝে মাঝে নানান ধরনের প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে আসছে। ‘সাইকেল কেনো কিনলে নিমাই দা’; ‘সাইকেল দিয়ে কি করবে?’; ‘এটির গায়ে তেল মাখাচ্ছ কেনো?’; ‘সাইকেল কি তেল খায়?’; এটা নতুন নাকি পুরনো?’ ‘তোমার সাইকেল উড়তে পারে?’ এমনি নানান গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন!

 

কানে তোলা তো দূরের কথা, প্রশ্ন কর্তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না নিমাই দা। নিজের কাজেই মশগুল। বাতাস পড়ে যাওয়ায় দরদর করে ঘামছে সে। সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই তার। সাইকেল পেয়ে এমন মজেছে যে কোনো দিকেই তার মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। ছেলের দল আরো কিছুক্ষণ তার কাজ দেখল। তারপর একে একে সবাই মন খারাপ করে বিদায় নিল। নূর আলমও ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে উঠে পড়ল। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল নিমাই দা তখনো এক মনে সাইকেলের যত্নে মশগুল।

 

পরের দিন থেকে সকাল থেকে নিমাইকে দেখা গেলো গ্রামের কাঁচা রাস্তায়। সাইকেল চালানো শিখছে সে। সান্টুদের দলটিকেও দেখা গেল সোৎসাহে দল বেঁধে হৈ হৈ রব তুলে সাইকেলের পেছন পেছন ছুটতে। নিমাইয়ের মুখে হাসি নেই। রসের হাড়ি নিমাই মুখটাকে কঠিন করে রেখেছে। প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে সাইকেলে প্যাডেল মারতে। একবার দুবার প্যাডেল মেরেই থেমে যাচ্ছে সে। দুপাশ থেকে থামের মতো নেমে আসছে তার পা দুখানি। মাটিতে ঘষা খেয়ে ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে পড়ছে। সে সময় পেছন থেকে ছেলের দল সাইকেল পেরিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে। আবার নিমাই সাইকেল সামনে বাড়ানোর তোড় জোড় করতেই তারা পিছনে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ পেছন থেকে ঠেলাও দিচ্ছে।

 

একবার ঠেলা খেয়ে ছেদুর বাঁশ বাগানের মধ্যে সাইকেলসহ ঢুকে গেল নিমাই। তার পা-ব্রেকে কাজ করেনি। ছেলেরাই আবার তাকে সাইকেলসহ টেনে বের করল। দেখা গেল তার হাতে-মুখে কয়েক যায়গায় ছড়ে গেছে। এবার আর তাকে ততটা গম্ভীর থাকতে দেখা গেল না। মুখে হাসির রেশ ফুটেছে। ছেলেরাও খুশি। চিরচেনা নিমাই দাকে হাসতে দেখা গেছে। খুশির চোটে এবার ঠেলার জোরও বেড়ে গেছে। কে কার আগে ঠেলবে সেই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুবার পড়ে গেছে নূর আলম। তার পেট আর দুই কনুই ছড়ে গেছে। তাতে কী? সাইকেলের পেছনে যায়গা পাওয়ার জন্য তাকেই সবচেয়ে বেশি গুঁতোগুঁতি করতে দেখা গেল।

 

নিমাই দা সাইকেলে বসার কায়দাই এখনো রপ্ত করে উঠতে পারেনি। সে তার লুঙ্গিটা সাইকেলের চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বসেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে একটা চলন্ত তাঁবু। আর সেই তাঁবুর মাথার ওপর নিমাইয়ের আজদাহা শরীরের উর্ধাংশ। গ্রামের লোকজন তার এই কাণ্ড দেখে হাসি চেপে রাখতে পারে না। কেউ কেউ উৎসাহ যোগায়। তাতে নিমাইয়েরও মনে হয় সে সঠিক কাজটিই করছে।

 

তবে একবার মাঠের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় ধারণাটি পাল্টে যায় তার। জোরে এক ঝলক বাতাস এসে তার লুঙ্গিটি উড়িয়ে মাথার উপরে নিয়ে ফেলে। এই অবস্থায় কিছুদূর গিয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে পা-ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় নিমাই। ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি যায়। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সেও হাসিতে যোগ দেয়।

 

পরের দিন নিমাই দা সাইকেল রাস্তায় বের করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দলে সাড়া পড়ে গেল। প্রতিযোগিতা করে ওরা সাইকেল ঠেলছে। নিমাইকে সাইকেল চালানো শেখানোই যেনো ওদের একমাত্র ব্রত। নিমাইদা এখন প্যাডেলে পা তুলে বসে থাকে, আর ছেলেরা সাইকেল ঠেলে। এভাবে বেশ চলছিল।

 

হাতেমদের পুকুরপাড়ে এসে ছেলেদের মধ্যে সাইকেল ঠেলা ঠেলি নিয়ে কী একটা গোলযোগ বাঁধল। কেউ ঠেলে, কেউ টেনে ধরে। এই করতে করতে সবাই মিলে একযোগে ঠেলা শুরু করে। নিমাই দা- ‘পড়ে যাব, পড়ে যাব’ করতে করতে ঘ্যাচ করে তার পা-ব্রেক কষে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ব্রেক কাজ করে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতেমদের পুকুরের মাঝখানে সাইকেলসহ নিমাইদাকে আবিষ্কার করে ছেলেরা। রক্ত জবার মতো লাল চোখে তাদের দিকে তাকায় নিমাই দা। কিন্তু পুকুরপাড়ে কাউকে দেখা গেল না। যেনো সেখানে কেউ ছিলই না কখনো।

    রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৫/সনি