সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে কবিতা কিংবা কাব্যিক সুরের মধ্য দিয়ে। গদ্যসাহিত্য এসেছে অনেক পরে। অতীতে কবিতা-গানের মধ্য দিয়েই মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো। দেশে দেশে যুগে যুগে এমনটাই ঘটেছে। এই কবিদলের সবাই যে কালের পাতায় সোনালি অক্ষরে রয়ে গেছেন তা নয়, অনেকেই হারিয়ে গেছেন সময়ের স্রোতে। আর যারা তাদের কাব্য প্রতিভা গুণে আজও এই এতো কাল পরেও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তারা নমস্য। এদের অনেকেই জীবদ্দশায় ‘জাতীয় কবি’র সম্মান পেয়েছেন। বিভিন্ন দেশের জাতীয় কবিদের নিয়ে এই লেখা। লিখেছেন অহ নওরোজ।ফেরদৌসি: ফার্সি রাজাদের ইতিহাস নিয়ে লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম মহাকাব্য ‘শাহ্নামা’র লেখক ফেরদৌসি। তিনি বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি একসঙ্গে তিনটি দেশ ইরান, আফগানিস্তান এবং তাজিকিস্তানের জাতীয় কবির সম্মানে ভূষিত। ফেরদৌসির আসল নাম হাকিম বাবু-ই-কাজিম ফেরদৌসি তুসি। ৯৩৫ সালে ইরানের তুসি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করায় তার নামের শেষে তুসি যুক্ত হয়। বর্তমানে এটি ইরানের রাজাভি খোরাসান প্রদেশ। ফার্সি ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী এই কবি ১০২৫ সালে নব্বই বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান। মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হয় তিনি ক্রীতদাস দ্বারা খুন হয়েছিলেন। মহান এই কবিকে নিজ বাগানে সমাহিত করা হয়। পরে খোরাসানের গভর্নরের সহায়তায় সমাধির ওপর একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল। যেটি দেখার জন্য বহু পর্যটক এখনো সেখানে ভিড় জমান। বর্তমানে ফেরদৌসির সম্মানে ইরানে একটি ফেরদৌসি ভাষা চর্চা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়াও ফেরদৌসি ইউনিভার্সিটি অব মাশহাদ নামে ইরানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে ইরান সরকার।মুরাসাকি সিকিবু: জাপানের জাতীয় কবি মুরাসাকি সিকিবু। মহিলা কবি হিসেবে জাপানের সাহিত্যে তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ধারণা করা হয় তার জন্ম ৯৭৩ থেকে ৯৭৮ সালের মধ্যে যে কোনো সময়ে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও প্রতিভা বিকাশে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সিকিবু মূলত লেখালেখি শুরু করেন বিয়ের পরেই। খুব অল্প সময়ে লিখে ফেলেন সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘দ্য টেল অফ জেঞ্জি’। জাপানী সাহিত্যে ক্লাসিক লেখক হিসেবে তার সুনাম আজও অটুট। তিনি ১০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।উইলিয়াম শেক্সপিয়ার: নাটক কিংবা কবিতায় এককভাবে সর্বশ্রেষ্ঠের দাবিদার তিনি। অতীতের মতো বর্তমানেও তার কাজ বারবার অভিযোজিত হয়েছে এবং সাহিত্যে নতুন আন্দোলনের খোরাক যুগিয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ার কালজয়ী ভূমিকা রেখেছেন। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশরা তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। তিনি ১৫৪টি সনেট লিখেছেন। কবিতার এই ধারা নতুন রীতির জন্ম দিয়েছে। শেক্সপিয়ার ১৫৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যের যে অঙ্গনে তিনি হেঁটেছেন তার সবকটিতেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি; তৈরি করেছেন নিজস্বতা। ১৬১৬ সালে অকালে মহাপ্রয়াণ ঘটে বিশ্বসাহিত্যের এই কিংবদন্তির। গ্যাটে: গীতিকবিতা,গদ্য,পদ্য-নাটক, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, সাহিত্য ও নান্দনিক সমালোচনা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, অ্যানাটমি ইত্যাদিতে গ্যাটের ছিল সমান পদচারণা। এত কিছুর পরও কবি হিসেবে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। তিনি বৈজ্ঞানিকও ছিলেন। মৃত্যুর পর তিনি জার্মানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। গ্যাটের পুরো নাম জন উলফগ্যাং ভন গ্যাটে। ১৭৪৯ সালের ২৮ আগস্ট গ্যাটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জার্মান কবিতা বিপ্লবের মহাপুরুষ। এ জন্য তাকে ‘মহাকবি গ্যাটে’ বলা হয়। গ্যাটে ১৮৩২ সালে মারা যান।আলেকজেন্ডার পুশকিন: পুশকিন রাশিয়ার জাতীয় কবি। তিনি ১৭৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কবি,ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। তাকে রুশ সাহিত্যে আধুনিকতার জনক বলা হয়। রুশ কবিতায় রোমান্টিকতার সূচনাও তার হাতে। তার একটি বিখ্যাত নাটক ‘বরিশ গুডোনভ’। তবে তিনি মূলত কবি ছিলেন এবং মাত্র পনেরো বছর বয়সে সেটা প্রকাশ পায়। পুশকিন তার জীবদ্দশায় ত্রিশটির অধিক বই লিখেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই কবিতার বই। তার কবিতার বই ‘পোলতাভা’ (১৮২৯) বেশ সমাদৃত। এটি অনেক ভাষায় অনূদিত। ১৮৩৭ সালে আলেকজেন্ডার পুশকিন মৃত্যুবরণ করেন।চার্লস বোদলেয়ার: কবিতার সৌন্দর্য দিয়ে ফ্রান্সের একটি পুরো প্রজন্মকে যিনি প্রভাবিত করেছিলেন তার নাম চার্লস পিয়েরে বোদলেয়ার। বোদলেয়ার নামে তিনি বিশেষ পরিচিত। ফ্রান্সের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে তাকে। বোদলেয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থের নাম ‘দ্য ফ্লাওয়ার অব ইভিল’। তার কবিতা আধুনিক ফরাসি কবিতার ধারক এবং বাহক। বোদলেয়ারের প্রথম বইয়ের নাম ‘স্যালন অব ১৮৪৫’, বেশ সাড়া ফেলেছিল বইটি। এই কবির জন্ম প্যারিসে ১৮২১ সালের এপ্রিলে। তবে তিনি মাত্র ৪৬ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান।পাউলিন জনসন: পাউলিন কানাডার জাতীয় কবি। তার পুরো নাম এমিলি পাউলিন জনসন। তিনি ইংরেজি কাব্যসাহিত্যের বিখ্যাত মহিলা কবিদের একজন। কবিতা লেখার পাশাপাশি অভিনেত্রী হিসেবেও সফল ছিলেন। প্রয়োজনের তাগিদে নাটকও লিখেছেন। ১৯১২ সালে তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ফ্লিন্ট অ্যান্ড ফেদার’ কানাডার সাহিত্যে বিশেষ প্রশংসা পায়। বইটি পরে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়। পাউলিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬১ সালে ওন্টারিওতে। ১৯১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ওলাভো বিলাক: ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিলাক ১৮৬৫ সালে রিও ডি জেনেরিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি,সাংবাদিক এবং অনুবাদক। তার সময়ের আরো দুই প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন আলবার্তো ডি অলিভিয়েরা এবং রামেন্ডু করেরিয়া। এদের তিনজনকে একত্রে ‘কাব্যত্রয়ী’ বলা হতো। যাই হোক, ওলাভো বিলাক ১৯০৭ সালে ব্রাজিলের জাতীয় কবির জন্য মনোনীত হন এবং তিনি জাতীয় কবির মর্যাদা পান। আইনে পড়াশোনা করলেও এই কবি জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। তার প্রথম লেখা কবিতাটি ছিল সনেট। নাম ‘সেস্টা ডি নিরো’, যেটি ১৮৮৪ সালে স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিলাকের আটটি গ্রন্থের মধ্যে ‘পয়েসিয়াস’ (১৮৮৮) ছিল সবচেয়ে পাঠক সমাদৃত। বিলাক একাকীত্ব পছন্দ করতেন, যে কারণে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তিনি ১৯১৮ সালে মারা যান। তার শেষ কথা ছিল, ‘আমাকে কফি দাও। আমি লেখা শুরু করব।’হেনরি লাউসন: অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ছোট গল্পকার এবং কবি হেনরি হলেন সে দেশের জাতীয় কবি। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্যকে আলাদা অবস্থানে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও তাকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার বলা হয়। সব মিলিয়ে তার পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত এবং সবগুলোই সমান জনপ্রিয়। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এতটা জনপ্রিয় যে ১৯৪৯ সালে তার ছবি ওই দেশের ডাকটিকিটে ঠাঁই পায়। ১৯৬৬ সালে তার ছবি সংবলিত অস্ট্রেলিয়ান ডলারও ছাপা হয়। হেনরি ১৮৬৭ সালের ১৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২২ সালে ৫৫ বছর বয়সে মারা যান। আহমেদ সাকি: আরবি সাহিত্যে মহাকাব্যের রীতি প্রচলনের জন্য যার নাম বিশেষভাবে পরিচিত তিনি আহমেদ সাকি। মিশর সরকার কুর্দি বংশোদ্ভূত এই কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। তার পদবি হলো আমির-আল-ছুয়ারা। এর অর্থ কবিতার রাজপুত্র। তিনি একাধারে কবি এবং মিশরের নাট্যব্যক্তিত্ব। নাট্যজগতে তার প্রবেশের কাহিনী বেশ মজার। তিনি আইনের ছাত্র ছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্স গিয়েছিলেন। সে সময় ফরাসি নাটক তাকে নাটক লেখার ক্ষেত্রে বিশেষ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তার প্রথম নাটক ‘মাজনুন লায়লা’ বেশ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এরপর একে একে লেখেন আটটি বিখ্যাত নাটক। কবিতায়ও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। তাকে আরবি ভাষার প্রথম আধুনিক কবি বলা হয়। কবিতার কারণেই ১৯৩১ সালে তিনি মিশরের জাতীয় কবির স্বীকৃতি পান। পেশায় আইনজীবী সাকি ১৮৬৮ সালে মিশরের কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৪ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ‘এশ শাকিয়াত’ তার অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ।রবার্ট ফ্রস্ট: পৃথিবীর মানুষের কাছে কবিতা দিয়ে যিনি সাবলীলভাবে পৌঁছেছেন, তিনি কবি রবার্ট ফ্রস্ট। তাকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি। বেঁচে থাকা অবস্থায়ই কবিতার জন্য চারবার (১৯২৪,১৯৩১,১৯৩৭,১৯৪৩) পুলিৎজার পুরস্কার পান তিনি। এই প্রাপ্তি তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতার জন্য ১৯৬০ সালে ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। এরপর ১৯৬২ সালে তাকে এডওয়ার্ড ম্যাকডোয়েল পদকে ভূষিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফ্রস্টের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৮৭৪ সালের মার্চে। তার পুরো নাম রবার্ট লি ফ্রস্ট। তার গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। তিনি ১৯৬৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।ইকবাল: উর্দু ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী কবির নাম ইকবাল। তিনি আল্লামা ইকবাল নামে বিশেষ পরিচিত। তার কাব্যের পঙ্ক্তি কাব্যসাহিত্য প্রিয় মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তিনি ফার্সি এবং উর্দুতে সমান পারদর্শী ছিলেন। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। লিখেছেন ইংরেজিতেও। পাকিস্তান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। তার বইয়ের সংখ্যা মাত্র তেরো। তিনি ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।মাজিসি কুনেনি: দক্ষিণ আফ্রিকার কবিতা সম্রাট বলে খ্যাত মাজিসি কুনেনি সে দেশের জাতীয় কবি। তিনি ইউরোপ এবং আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী সংগঠক হিসেবে বিশেষ পরিচিত। তিনি ১৯৩০ সালের ১২ মে ডারবানের কয়াজুলু-নাটাল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। জুলু এবং ইংরেজি ভাষার এই কবির প্রথম লেখা ছাপা হয় এগারো বছর বয়সে আঞ্চলিক পত্রিকায়। ১৯৫৬ সালে দেশব্যাপী আয়োজিত বান্টু সাহিত্য প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখে তিনি পুরস্কৃত হন। এর মাধ্যমে তার কাব্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তিনি সবার নজরে চলে আসেন। যদিও বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে জড়িত থাকায় ১৯৬৬ সালে আফ্রিকায় তার কবিতা নিষিদ্ধ হয়। ১৯৭৯ সালে তার লেখা ‘ইম্পেরর শাখা দ্য গ্রেট’ (রাজা শাখার অধিন থেকে জুলুদের উত্থানের কাহিনী) উপন্যাসটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। অর্থাৎ কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্যচর্চাও করতেন। ছিলেন ঐতিহাসিক এবং কূটনীতিক। তার কাব্যগ্রন্থ ‘ইন্ডিডা ইয়ামান চাসাকাজি’ (১৯৯৫) জুলু কবিতায় বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। তার প্রকাশিত সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা দশ। কুনেনি ২০০৬ সালের ১১ আগস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশ তাদের ভাষার কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেছে। কিছু কিছু দেশে জাতীয় কবির সংখ্যা একাধিক। যেমন ভারতের জাতীয় কবি সাত জন। চিনের জাতীয় কবি তিন জন। এভাবে নাম না জানা অনেক কবি আছেন যারা তাদের ভাষায় অমর হয়ে রয়েছেন কবিতা লিখে।