শিল্প ও সাহিত্য

হুমায়ূনের হিমু, মিসির আলি, শুভ্র (দ্বিতীয় পর্ব)

মুম রহমান : হিমুর প্রথম আবির্ভাব ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসের মাধ্যমে, ১৯৯০ সালে। জনপ্রিয়তার নিরিখে হিমু চরিত্রের সমতূল্য চরিত্র বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হলেও হিমু হয়ে উঠেছে গণ মানুষের চরিত্র। সেই বিবেচনায় হিমু শুধু একক হুমায়ূনের নয়, তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে একটি আইডল হয়ে উঠেছে। হিমু কতোটা জনপ্রিয় তার একটা ধারণা নেয়া যেতে পারে সোস্যাল মিডিয়া থেকে। সোস্যাল মিডিয়াকে জনপ্রিয়তার সাম্প্রতিক মাপকাঠি বলা যায়। এর মধ্যে ফেইসবুক আমাদের দেশে সবচেয়ে সরব। ফেইসবুকের ফ্যানপেইজ, গ্রুপ ইত্যাদি লাইকের পরিমাণ দেখে জনপ্রিয়তার একটা হিসাব নিকাশ করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ যে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক তার জন্য অবশ্য কোনো মিডিয়া বা কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। আর হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে হিমু যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সে কথা বলতেও কোনো তথ্য-প্রমাণ লাগে না।

 

তরুণ সমাজের বিরাট একটা অংশ হলুদ পাঞ্জাবি পরতে শিখেছে হিমু চরিত্রের কাছ থেকেই। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণরা হলুদ পাঞ্জাবি আদৌ পরতো কিনা সে ফ্যাশান ডিজাইনাররা গবেষণা করতে পারেন। কিন্তু নানা অজুহাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে জোছনা বিহারের বহু ঘটনাই এ দেশে ঘটেছে এক হিমু চরিত্রের প্রভাবে। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে হিমু সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। মাসুদ রানা যদি বাংলাদেশী তরুণদের স্বপ্নের আইকন হয়ে থাকে, হিমু নিঃসন্দেহে তাদের প্রাণের মানুষ। প্রতিটি তরুণের ভেতরেই সচেতন বা অবচেতনে একজন হিমু বাস করে। হুমায়ূন আহমেদ স্বশরীরে এই নশ্বর ভুবনে থাকুন বা না থাকুন, হিমু চরিত্রে রয়ে গেছে লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে, মননে। অনেক পাঠকই হিমুর সাথে একাত্ম হয়ে নিজেকে ‘হিমু’ ভাবতে ভালবাসে।

 

সোস্যাল মিডিয়ার কথা বলছিলাম, তার একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখা গেলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১০ সালে ফেইসবুকে ‘হিমু’ নামে একটি পেইজ খোলা হয়। সেখানে সাড়ে ২৬ হাজার লাইক আছে। ‘হিমু এবং আমি’ নামে আরেকটি পেইজ খোলা হয়েছে ৭ জুন ২০১২ সালে, যাতে লাইক আছে ২৭ হাজার। ২৯ মার্চ ২০১২ তে আরেকটি পেইজ খোলা হয় ‘হিমু ও হিমি’; যাতে লাইক আছে প্রায় ৮ হাজার। তিনটি মাত্র পেইজে ৬০ হাজার লাইক পড়েছে। হুমায়ূন আর তার প্রিয় সৃষ্টি হিমুকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে কতো পেইজ, গ্রুপ আছে আর সেখানে কতো সদস্য আর কতো লাইক আছে তা বোধ হয় স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে।

 

সাহিত্যের জটিল রীতি-কাঠামো আর বড় বড় তত্ত্বের ধার ধারে না হুমায়ূন আহমেদ। সরল আবেশে তিনি হিমুকে তৈরি করেন মহাপুরুষ হিসাবে। হিমুর বাবা চেয়েছিল হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে। সেই চাওয়া এবং হওয়ার প্রক্রিয়াটিও স্বাভাবিক নয়। ‘হিমু’ উপন্যাসে হিমু নিজেই মনোবিশেষজ্ঞ ইরতাজুল করিমের সামনে স্বীকারোক্তি করে: ‘ডাক্তার সাহেব, আমার বাবা ছিলেন অসুস্থ মানুষ। সাইকোপ্যাথ। এবং আমার ধারণা খুব খারাপ ধরনের সাইকোপ্যাথ। তাঁর মাথায় কী করে যেন ঢুকে গেলো- মহাপুরুষ তৈরি করা যায়। যথাযথ ট্রেনিং দিয়েই তা করা সম্ভব। তাঁর যুক্তি হচ্ছে- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাকাত, খুনি যদি শিক্ষা এবং ট্রেনিঙে তৈরি করা যায়, তাহলে মহাপুরুষ কেন তৈরি করা যাবে না? অসুস্থ মানুষদের চিন্তা হয় সিঙ্গেল ট্র্যাকে। তার চিন্তা সে রকম হলো- তিনি মহাপুরুষ তৈরির খেলায় নামলেন। আমি হলাম তার একমাত্র ছাত্র। তিনি এগুলেন খুব ঠান্ডা মাথায়। তাঁর ধারণা হলো, আমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তাকে এ জাতীয় ট্রেনিং দিতে দেবেন না- কাজেই তিনি মাকে সরিয়ে দিলেন।’

 

কিন্তু এই হিমু তার বাবার ধারণা ও শিক্ষাকেই ধারণ করে চলে। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসে সে বলে, ‘আমার বাবা কি আসলেই অপ্রকৃতিস্থ? কাদের আমরা প্রকৃতিস্থ বলবো? যাদের চিন্তা-ভাবনা স্বাভাবিক পথে চলে তাদের? যারা একটু অন্যভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাদের আমরা আলাদা করে ফেলি- তা কি ঠিক? আমার বাবা তার পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার কথা শোনামাত্রই আমরা তাকে উন্মাদ হিসাবে আলাদা করে ফেলেছি। কোনো বাবা যদি বলেন, আমি আমার ছেলে বড় ডাক্তার বানাবো তখন আমরা হাসি না, কারণ তিনি চেনা পথে হাঁটছেন। আমার বাবা তার সমগ্র জীবনে হেঁটেছেন অচেনা পথে। আমি সেই পথ কখনো অস্বীকার করিনি।’

 

আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি হিমু তার বাবার দেখানো অচেনা পথেই হেঁটে চলেছেন। হিমুকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’-তে হিমু বলে, ‘আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভাল লাগে। মাঝে মাঝে এই ভূমিকায় আমি অভিনয় করি, মনে হয় ভালোই করি। সত্যিকার মহাপুরুষরাও সম্ভবত এত ভালো অভিনয় করতেন না।’ আমরা সবাই কমবেশি কিছুক্ষণের জন্য হলেও মহাপুরুষ হতে চাই। তখন জাগতিক কদর্যতা, নোংরামিগুলো অনেক বেশি করে আমাদের ভাবায়। হিমুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।

 

‘হিমু’ উপন্যাসের শুরুতে হুমায়ূন আহমেদ ‘প্রসঙ্গ হিমু’ নামে ছোট্ট একটি ভূমিকা লিখেছেন : ‘হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি- নিজেকে হিমু মনে হয়, এক ধরনের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন করে ঘটে না। হিমুকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা ময়ূরাক্ষি। ময়ূরাক্ষি লেখার সময় ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করি। দ্বিতীয়বার লিখলাম দরজার ওপাশে। তখনো একই ব্যাপার। কেন এরকম হয়? মানুষ হিসাবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই। যদি কখনো জানতে পারি  পাঠকদের জানাব।’

 

পাঠককে বরাবরই এক রহস্যময় জগতে রেখেছেন তিনি। হিমু সেই রহস্যের অন্যতম আধার। অন্যদিকে মিসির আলির আবির্ভাবই হয় রহস্য উন্মোচনে।

 

হুমায়ূনের একাধিক আত্মজৈবনিক লেখা এবং তাকে নিয়ে নানা জনের স্মরণ কথাতে এটুকু বুঝতে পারা যায়, হুমায়ূনের ব্যক্তি চরিত্রে হিমুর পাগলামী যেমন আছে তেমনি মিসির আলির যৌক্তিকতাও আছে। তিনি একই সঙ্গে স্বচরিত্রে মিসির আলি ও হিমুকে ধারণ করেন। কালক্রমিকভাবে হুমায়ূন আহমেদের হিমু উপন্যাসের প্রকাশকাল নিম্নরূপ :

১.        ময়ূরাক্ষী, অনন্যা, মে ১৯৯০

২.         দরজার ওপাশে, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২

৩.        হিমু, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩

৪.        পারপার (১৯৯৪)

৫.        এবং হিমু, সময়, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫

৬.       হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, দিব্যপ্রকাশ, এপ্রিল ১৯৯৬

৭.        হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭

৮.       হিমুর রূপালী রাত্রি জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, অক্টোবর ১৯৯৮

৯.        একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁপোকা, পার্ল পাবলিকেশন, মে ১৯৯৯

১০.      তোমাদের এই নগরে, অনন্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০০

১১.      চলে যায় বসন্তের দিন, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০২

১২.      সে আসে ধীরে, অন্যপ্রকাশ, ২০০৩

১৩.     হিমু মামা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, শিশুতোষ

১৪.      আঙুল কাটা জগলু, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৫

১৫.      হলুদ হিমু কালো র‌্যাব, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৬

১৬.     আজ হিমুর বিয়ে, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭

১৭.      হিমু রিমান্ডে, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮

১৮.     হিমুর মধ্যদুপুর, অন্বেষা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৯

১৯.      হিমুর নীল জোছনা, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০

২০.      হিমুর আছে জল, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১১

২১.      হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১১

২২.      হিমু এবং হাভার্ড চয.উ. বল্টু ভাই, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১২

 

হিমু প্রসঙ্গে অন্যান্য গ্রন্থ :

১.        হিমুর বাবার কথামালা, অন্বেষা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

২.         হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার, গল্পগ্রন্থ, অন্বেষা প্রকাশন, অক্টোবর, ২০০৮

 

লক্ষণীয় ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদ হিমুকে নিয়ে একটি করে উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন (এর মধ্যে কেবল ১৯৯১, ২০০১ ব্যতিক্রম)। ২০১১ সালে তিনি হিমুকে নিয়ে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। এ বিষয়ে ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ উপন্যাসের ভূমিকা লক্ষ্যনীয়। তিনি লিখেছেন : ‘আমাদের কালচারে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার ব্যাপারটা আছে। লেখালেখি জীবনের শুরুতে প্রচুর ঢেঁকি গিলেছি। শেষের দিকে এসে রাইস মিল গেলা শুরু করেছি। হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী তার উদাহরণ। বৎসরে আমি একটাই হিমু লিখি। বিশ্বকাপ বাংলাদেশে হচ্ছে বলে দু’জন হিমু। একজন মাঠে বসে খেলা দেখবে অন্যজন পথে পথে হাঁটবে।’ (চলবে)

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ নভেম্বর ২০১৫/তারা