শিল্প ও সাহিত্য

পৃথিবীব্যাপী তরুণ কবিদের দুর্দশা চোখে পড়ার মতো : ইয়োস

কিউবার সাহিত্যাঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে সায়েন্স ফিকশনকে পাঠকপ্রিয় করে তোলার নেপথ্যে যিনি রয়েছেন তিনি ইয়োস। জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সাহিত্যচর্চা এবং সংগীতে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়া ইয়োসের পুরো নাম ইয়োস মিগুয়েল সাঞ্চেজ গোমেজ। তিনি সেদেশের শ্রোতাপ্রিয় রকস্টারও বটে। আছে নিজের ব্যান্ড তেনাস। এখানকার প্রধান গায়ক তিনি। ইয়োস গত ২০ নভেম্বর হাভানা, মাদ্রিদ, রোম, দুবাই হয়ে তিনদিনের যাত্রা শেষে ঢাকা সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। রাইজিংবিডি’র পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ে ল্যাটিন আমেরিকার এই জনপ্রিয় লেখক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন অহ নওরোজ।

 

অহ নওরোজ : কেমন আছেন?ইয়োস : এখন কিছুটা আরাম বোধ করছি। তিনদিনের জার্নি তো আর ছোট কথা না। আমাকে দুবাইয়ে তেইশ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে।

 

অহ নওরোজ : ভারতবর্ষে কি প্রথমবারের মত এলেন?ইয়োস : শুধু ভারতবর্ষেই না, এশিয়া মহাদেশেই আমি প্রথম এলাম। এর আগে আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি এই দেশ সম্পর্কে, আমার বন্ধু মারিও মেরাতি আমাকে বলেছিল- বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি তোমায় আগেই কিছু বলবো না, তুমি আগে যাও পরে বলবো।

 

অহ নওরোজ : এখন কেমন মনে হচ্ছে?ইয়োস : আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ছোট একটা দেশ। রাজধানীতে ছোট একটা উৎসব হবে, সেখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু আমি এসে দেখি, অনেক বড় একটি উৎসব হচ্ছে এখানে। আমি সম্পূর্ণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন দেশের বড় বড় সাহিত্যিকরা এখানে এসেছেন, আমার নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। সবাই খুব অতিথিপরায়ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। অসাধারণ! অসাধারণ!

 

অহ নওরোজ : আপনার দেশের সাথে আমাদের দেশের কি মিল দেখলেন?ইয়োস : সবচেয়ে বড় মিল হলো, এখানে যেমন গরম আবহাওয়া আমাদের দেশেও তেমন। আর এ দেশের মানুষের আবেগের গভীরতার সাথে আমাদের আবেগ মিলে গেছে। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছি শহরে এত মানুষ দেখে। আমাদের দেশের সঙ্গে মনে হয় এটি একটি বড় অমিল। আমাদের দেশে কখনো এত মানুষ একসঙ্গে জড় হতে আমি দেখিনি। ঢাকা আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ।

 

অহ নওরোজ : সংগীতের পাশাপাশি এভাবে সাহিত্যচর্চা করতে সচরাচর দেখা যায় না। আপনি সাহিত্যচর্চা করতে কীভাবে অনুপ্রাণিত হলেন?ইয়োস : আমার মা সাহিত্যের সাথে জড়িত না থাকলেও শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য আর শিল্পচর্চা তো এক ঘরানারই। আমার মা দীর্ঘদিন মঞ্চে অভিনয় করেছেন। মঞ্চ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি বেশ সফলও বলা যায়। মা যেহেতু শিল্পের মানুষ সেহেতু সাহিত্যচর্চা করতে আমার বেগ পেতে হয়নি বা পরিবার থেকে বাধা আসেনি।

 

অহ নওরোজ : তাহলে কি মা-ই আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন?ইয়োস : ঠিক সেটা না। আমি ছোটবেলা থেকে প্রচুর সায়েন্স ফিকশন পড়তাম, পড়তে পড়তে এক সময় আমি যে লাইব্রেরি থেকে বই নিতাম সেখানকার সব বই পড়া শেষ হয়ে গেল। তখন আমার মনে হলো আমিও তো এদের মত লিখতে পারি, সেখান থেকে লেখাটা শুরু হয়েছে। তখন আমার বয়স পনেরো।

 

অহ নওরোজ : গানটাও কি ছোটবেলা থেকেই?ইয়োস : আমি অনেক পরে গান শুরু করি। আমার যখন বয়স একুশ তখন থেকে। তবে গানটা করি সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকে। কারণ আমি গান লিখতে পছন্দ করি। গান লেখাও তো এক প্রকারের সাহিত্য। তবে আমি শুধু আমার ব্যান্ডের জন্যই লিখি।

 

অহ নওরোজ : আপনার হেভিমেটাল ব্যান্ড ‘তেনাস’ কিউবায় জনপ্রিয়। এর পেছনের কারণ কী মনে হয়?ইয়োস : আমার মনে হয় গানগুলোর কম্পোজ এর একটা কারণ। আমার নিজের কাছেই এগুলো খুব পছন্দের। গানের কথাগুলো সত্যি ভালো লাগে।

 

অহ নওরোজ : আপনার প্রথম বই তো পুরস্কৃত হয়েছে। সেই উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ কেমন ছিল?ইয়োস : বইটির নাম ছিল ‘তিমশেল’। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘পেরেমিও দেভিদ’ পুরস্কার পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল আমি লিখতে পারি। কারণ এটি ল্যাটিন অ্যামেরিকার জনপ্রিয় পুরস্কারগুলোর একটি। এরপর আমি আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম লেখায় নিজেকে নিয়জিত করতে।

 

অহ নওরোজ : তাহলে আপনি কি বলবেন পুরস্কার একজন লেখকের জন্য গুরুত্ব বহন করে?ইয়োস : অবশ্যই। পুরস্কার একজন লেখককে আরও বেশি অনুপ্রেরণা দেয়। তবে এটি স্বচ্ছ হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার প্রথম বইয়ে পুরস্কার পাওয়া আমাকে আরও জ্বালিয়ে তুলেছিল। আমি আরও বেশি মনোনিবেশ করেছিলাম।

 

অহ নওরোজ : বর্তমানে আপনার বইয়ের সংখ্যা কত? সবগুলোই কি সায়েন্স ফিকশন?ইয়োস : এ পর্যন্ত আমি সর্বমোট ৩১টি বই লিখেছি। সবগুলোই সায়েন্স ফিকশন। আমি গদ্য এবং প্রবন্ধ লিখি বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য। তবে কবিতা লিখতে পারি না।

 

অহ নওরোজ : কবিদের সম্পর্কে কবি ঘাসান ঝাকতান বলছিলেন, তাদের ওখানেও নাকি তরুণ কবিরা বিপন্ন অবস্থার মধ্যে বসবাস করে। তাদের জীবনযাত্রা খুব ভালো নয়। আমাদের দেশের তরুণ কবিরাও ঠিক কাছাকাছি জীবনযাপন করেন। ল্যাটিন অ্যামেরিকার তরুণ কবিদের সম্পর্কে শুনতে চাই।ইয়োস : ফিলিস্তিনের ওই কবি ঠিকই বলেছেন। শুধু ওখানে কিংবা আপনাদের দেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী তরুণ কবিদের দুর্দশা চোখে পড়ার মতো। সব কবিদেরই তরুণ অবস্থায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এটা শিল্প-সাহিত্যের শুরু থেকে হয়ে আসছে। আর কবিতা যেহেতু সবচেয়ে বড় শিল্প, সেহেতু এর পেছনে বেশি সময় দিতে গিয়ে অন্যদিকে টানাপোড়েন থাকবেই।

 

অহ নওরোজ : বাংলা কোনো লেখা পড়েছেন? কোনো বই?ইয়োস : আসলে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে এতটুকুই জানি যে, দেশটি ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছে যা আগে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য ছিল। আর দেশটির প্রধান একজন নারী। তবে একজন আমাকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই দিয়েছেন। ইংরেজিতে অনুবাদ করা কবিতা। আমি বইটি এখানে আসার পর থেকে পড়ছি। খুব ভালো লাগছে।

 

অহ নওরোজ : সম্প্রতি আপনার একটি বই দেখলাম ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বইটি সম্পর্কে বলুন।ইয়োস : বইটির নাম ‘এ প্ল্যানেট ফর রেন্ট’। বইটি অনুবাদ করেছেন ডেভিড ফ্রেই। এটি একটি নিরেট সায়েন্স ফিকশন। আমেরিকার মোটামুটি সবখানেই বইটি পাওয়া যাচ্ছে।

 

অহ নওরোজ : কেমন লাগছে এ দেশ। এ দেশের কাউকে দিয়ে আপনার বই অনুবাদ করানোর ইচ্ছে আছে কিনা?ইয়োস : প্রথমেই বলে নেই, আমি সুযোগ পেলেই আসবো। কারণ বাংলাদেশীদের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। তাদের চমৎকার ব্যবহার আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এমন কাউকে যদি পাওয়া যায়, যিনি আমার বই সুন্দর করে অনুবাদ করবেন, তাহলে তো ভালোই হতো। আমি কথা দিচ্ছি, বাংলাদেশে সুযোগ পেলে আবার আসবো, গান করবো, সাহিত্য আলোচনা করবো।রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ নভেম্বর ২০১৫/তারা