শিল্প ও সাহিত্য

টেক্সাসান জীবন থেকে: তৃতীয় পর্ব

দিলরুবা আহমেদ: আরেকজন ভালো কথা বললেন, দুই ঘণ্টা পরপর খাওয়া, অল্প করে। এতে করে জারক রস, পিত্ত রস- যা কিছু আছে শরীরের ওইগুলো বের হয়ে চর্বিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারবে।

 

এ ধারে যখন চর্বির সঙ্গে যুদ্ধ চলছে, তখন অন্য ধারে সুস্বাদু খাদ্যের পসরা সাজানো হচ্ছে। অনেক ভাবীই এটা-ওটা রেধেও এনেছেন। টেবিল সাজানো প্রায় শেষ। এ ওর থেকে রেসিপি নিচ্ছে। এটা ভালো, ওটা মজা বলাবলি চলছে। আমি চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বা নজর বুলাতে গেলাম আমার খাস কিটিদের ওপর। লিভিংরুমের শেষ ধারে দুই খালাম্মার একজন আরেক ভাবীর সঙ্গে বসে লুডু খেলছেন। বেশ মেতে আছেন। অন্যজনকে পেলাম পার্লার কর্নারে। পাশেই ছোট করে আজকের জন্য করা হয়েছে বিউটি পার্লার। বেশ কিছু বাঙালি ভাবীই এ ব্যবসা করে ডালাসে ভালোই উপার্জন করছেন।

 

আজকে সবার জন্য ফ্রি। যে যা করতে চায় তারা করে দেবেন। খালাম্মাকে ফ্রি পেডিকিউর করা হচ্ছে। তিনি আলতো গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছেন। মুখে বেশ প্রশান্তির ভাব। আপা কোথায় গেল, খুঁজলাম এদিক-ওদিক। নেই কোথাও। শেষে পেলাম বাচ্চাদের সঙ্গে মাঠে। ওদের দাড়িয়াবান্দা খেলা শেখাচ্ছেন। বললেন কাবাডিও শেখাবেন। বাচ্চাগুলোও মজা করে নতুন কিছু শিখছে।

 

আপা দুচোখ আকাশে তুলে বললেন, এরা জানে না পর্যন্ত এইসব খেলার নাম। কোনোদিন খেলার তো প্রশ্নই উঠে না। বাপ-মাগুলো করেছে টা কী? আপা কেন যে ভাবছে এইমাত্র যাদের সাথে পরিচয় তারাও সবাই আমার মত করে তাকে বড়বোন ভাববেন আর উনি হৃদয় খুলে উপদেশ দিয়ে যেতে পারবেন! আরো কিছু উনি বলার আগেই তাড়াতাড়ি বললাম, ওদের সবাইকে এখন খেতে হবে। ভেতরে চলে আসুন। বাচ্চাগুলো নিমরাজি। খেলা শিখবে, খেলবে, আপাকে ঘিরে আছে তারা। কয়েকজন মা ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ধমক দিতেই ওরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। আপা বিরক্ত চোখে মা-দেরকে দেখলেন। কাছে এসে বললেন, তোমার ভাবীসাবরা একজনও কেউ যুদ্ধের বা আর্মির গল্প শুনতে চাইলো না। ভাবছি বাচ্চাদের শোনাবো। আমি বললাম, অবশ্যই এটা খুবই ভালো বুদ্ধি। তাদেরই শোনান। উনিও বিরক্ত মুখে তরতর করে ঢুকে পড়লেন ঘরে।

 

ঘরে ঢুকেই বাচ্চাদের বললেন, তোমরা লাইন ধরে দাঁড়াও। এসো আমরা জাতীয় সঙ্গীত গাই প্রথমে, তারপরে খাওয়া। দুঃখ করে মায়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা বাচ্চাগুলোকে জাতীয় সঙ্গীতটাও ঠিকমতো পুরোটা শেখাতে পারলে না আজ পর্যন্ত। তিনি ওয়ান টু থ্রি বলতেই যে যার মতো গেয়ে উঠলো, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

 

হঠাৎ বাচ্চাদের থামিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, তোমাদের উঠে দাঁড়ানো উচিত না? এক খালাম্মার পা দুটো পেডিকিউরের টাবে আলতো গরম পানিতে, খালাম্মা আমার দিকে চেয়ে ভাবখানা করলেন- যেন শুধু তাকেই দাঁড় করানোর জন্য আপার এ তাবৎ প্রচেষ্টা। অনেকে খেতেও বসে গেছে। কেউ কেউ কার্পেটে হাত-পা বিছিয়ে বসে মুভি দেখছিল। সবাই একে একে উঠে দাঁড়ালো।

 

এদিকে, আপার নেতৃত্বে বাচ্চাগুলো অদ্ভুত উচ্চারণে আর সুরে গাইতে লাগলো- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। বেসুরোদের দাপট কাহাতক আর সহ্য হবে, তাও আবার জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে, থাকতে না পেরে একটা সময় মায়েরাও গানে গলা মেলালো। মায়েদের প্রায় প্রতিজনেরই স্কুলের সবক’টা দিনই গেছে সকালে অ্যাসেম্বলিতে এই গান গেয়ে। তাই বেসুরে উদ্ভূত ভাঙা উচ্চারণে বাচ্চাদের গাইতে দিতে পারা গেল না সম্ভবত। তারা ধরতেই ফিরে এলো সেই চিরচেনা সুর, মুর্ছনা, আবেগ, ভাবাবেগ। একসময় মনে হলো সবাই যেন মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে নিমগ্ন হয়ে গাইছে। বাতাসেও যেন বাংলাদেশ বাংলাদেশ একটা গন্ধ। এতদূরে আমরা তারপরও বাংলাদেশ।

 

হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে কে যেন বলে উঠলো, মাতারী গো পার্টিতে সোনার বাংলার গান? হইতেছে কী? আমরা সবাই এই বজ্রনিনাদে হঠাৎ থমকে হা করে চুপ করে গেলাম। ফোনে রিং হচ্ছিল। কে যেন স্পিকার অন করে দিয়েছে। গমগম করে ঘরময় রূপসী ভাবীর স্বামীরই গলা শোনা গেল ফোনে। তিনি আবারো বলছেন মাতারী গো পার্টি। আমাদের কিটি পার্টির একি বেইজ্জতি। আমরা বিস্ফোরিত চোখে একে অন্যের দিকে চেয়ে রইলাম।

 

আমার খুবই খারাপ লাগছে রূপসী ভাবীর নাভিশ্বাস দেখে। তিনি সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন মাতারী কোনো খারাপ কথা না। তাদের ফরিদপুরে ভদ্রমহিলাদেরই মাতারী বলে। এটা আঞ্চলিক ভাষা। ঢাকাতে যেমন কাজের মেয়েদের মাতারী বলে সে রকম না। সবাই এতো চুপ যে, কে কি বুঝেছে বা ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না।

 

এক খালাম্মা তার মনকে বুঝলেন যেন, এখানে তো আমরা-তোমরা সবাই কাজের বুয়াই। সারাদিন কাজ করি। ঘর পরিষ্কার থেকে বাথরুম ধোয়া, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা সবই করি। মাতারী তো ঠিকই আছে। রূপসী ভাবী বললেন, ছি ছি খালাম্মা, আমরা কি তাই বলে ঝি নাকি? নিজের সংসারের কাজ নিজে করবো না তো কে করবে! ঝি বলাতে মনে পড়লো, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতে মেয়েকে ঝি বলে।

 

আমাদের ছোটবেলাতে বাবা একবার ট্রান্সফার হলেন চট্টগ্রামে। আমরা দুই বোনও ভিকারুননিসা স্কুল ছেড়ে ডা. খাস্তগীরে ভর্তি হলাম। আমাদের এক খালা স্কুলের সব বাচ্চাকে ডেকে ডেকে পরিচয় করাতে লাগলেন, এরা হচ্ছে আমার বোন-ঝি। আমাদের স্কুলের পেছনের দিকে একটা কামিনী গাছ ছিল। আমরা দুই বোন তার নিচে বসে গালে হাত দিয়ে নতুন স্কুলের প্রথম দিনে নীরবে কাদতে লাগলাম, কারণ আমাদের ঝি বলা হয়েছে মানে কাজের লোক। গল্পটা বলামাত্রই সবাই হেসে উঠলো। বদ্ধ বাতাসে হাওয়া খেলেছে যেন। এবার আরেকজন বলে উঠলেন, তাদের অঞ্চলে মেয়ে আর ছেলেকে বেটা-বেটি বলে। অন্য আরেকজন তাকে সাপোর্ট করে বললো, হিন্দি মুভিতে দেখেন না মেরা বেটি, মেরা বেটা বলে জান দিয়ে দেয়। আমিও যোগ করলাম, আর আমরা তো এখানে কারো ওপর রেগে গেলে বলি শয়তান বেটি বা হারামজাদা বেটা অথবা কোনো সুন্দরী ভাবীর ওপর রাগ ঝাড়ি এই বলে যে, দেখতে লাগতাছে কাজের বেটির মতোন। হাত তুলে রূপসী ভাবীর দিকেই ইশারা করলাম। সবাই এবার হো হো করে হাসতে লাগলো। রূপসী ভাবীও আমার দিকে চেয়ে খুবই সুন্দর করে একটা হাসি দিলেন। তাকে আট নাম্বার মহাবিপদ সঙ্কেত থেকে উদ্ধার করার জন্য। এখানে ওই অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, অনেকেই পরিবারের ভেতর কথা বলছে হয় অকৃত্রিম আঞ্চলিক ভাষায় নতুবা ইংরেজিতে। মাঝামাঝি যে শুদ্ধ বাংলা ভাষাটি রয়েছে তা বেমালুম লাপাত্তা। সে সঙ্গে ভেবে অবাক হলাম, আমরা কাজের বেটিকে গালি হিসেবে ভাবছি অথচ আমাদের দেশের সমাজে প্রচুর কাজের মেয়ে বা ছেলে আছে, এটা শুধুই কোনো একটা বিশেষ্য বা বিশেষণ নয়। নাম বা গালি নয়। সত্যিকারের রক্ত মাংসের মানুষ, প্রাণ আর অনুভূতি আছে। কষ্ট পেলে উহ্-আহ্ করে।

 

ছোট ছেলেমেয়েগুলো গ্রাম থেকে শহরে এসে গৃহভৃত্য হিসেবে বাসাগুলোতে ঢুকছে। আমরা শহরবাসী ওইভাবেই ওদের গ্রহণ করছি, লালন বা ধারণ করে যাচ্ছি। কাকডাকা ভোরে উঠবে, মাঝরাতে ঘুমাতে যাবে সেভাবেই তাদের ছক চলছে। উন্নয়ন বা উত্তরণের চেষ্টা খুবই সীমিত আমাদের মতো সর্বসাধারণের পক্ষ থেকে। এদিক-ওদিক কিছু আলোর ফুলকি তো ব্যতিক্রমি  কিছু। থাকে। থাকবে। এখন ওই আমেরিকাতে এসে সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করে উপলব্ধি করছি কতোই না কষ্ট করে এসব বাচ্চা মানুষগুলো আমাদের বসতবাড়িতে। যাকে বলে হাতে-কলমে শিখেছি বা রিয়াল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স।

 

যাহোক, এখানকার বাচ্চাগুলোকে আপাতত একরুমে বাধ্যতামূলকভাবে আটকানো হয়েছে। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউই বের হতে পারবে না। বাচ্চাগুলো খুবই বিরক্ত সহকারে খাচ্ছে। খেলা ফেলে খাওয়া এসবের কোনো মানে আছে, এ রকম ভাব ওদের চোখে-মুখে। একজন ভাবী আরো বিরক্ত মুখে ওদের হুমকি দিলেন, কতো গরিব মানুষ খেতে পায় না আর তোমরা মুখ বাকাও? আরেকজন আরো উস্কানি দিলেন, ধরে একটা করে চড় বসালে সঙ্গে সঙ্গে ভাত পেটে ঢুকবে। বাচ্চাদের দলের বয়সের সীমাটা তিন থেকে ১৪/১৫ হবে। ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ এলো, চাইল্ড পেটালে ৯১১-এ কল দেয়া হবে। বলা বাহুল্য ভাবীটি অনেকক্ষণ ধরে পালের এ গোদাকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। বাচ্চাদের কেউই ফাঁস করালো না, কে এই মন্তব্য করেছে। একতা পার্টির উদ্দেশে ভাবীটি নিজেই গর্জাতে লাগলেন, আর যদি কোনোদিন ওইসব শুনেছি তো তোমাদেরই একদিন কি আমাদের। আমরা বাই বর্ন বাংলাদেশি মা। মনে থাকে যেন। অতো সহজে আমাদের থেকে পার পাবে না। ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি। বেশকিছু বাচ্চা এমনভাবে তাকালো বোঝাই গেল, উনার পাখিতত্ত্ব ওরা বুঝেনি। কয়েকজন বললো ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে বলতে। ভাবীটি আরো রেগে গেলেন, বললেন বাংলা বোঝ না, বুশের নাতি হয়েছ না? হঠাৎ এক খালাম্মা এসে আমাকে বললেন, বলো তো কোন নারী নারী না। ভালোই চিন্তায় ফেললেন আমাকে। তার টার্গেট হিট করার জন্য তার মতো করে ভাবতে চেষ্টা করলাম। বললাম, আমেরিকান মেয়েগুলো নারী না। উনি ধুর বলে হাসলেন। তাকে আরেকটু হাসানোর জন্য এবার বললাম, বাংলাদেশের পুরুষরা নারী না। এবার তিনি খিল খিল করে হাসতে লাগলেন। তিনি কিছু বলার আগেই বললাম, যে নারী গাড়ি চালায় সে নারী না, সে তো ড্রাইভার। তিনি ধুত্তোর বলে বললেন, কলনারী আর্ট নারী না। এই খালাম্মার ইংরেজির জ্বালায় আমার ক্ষণে ক্ষণে চক্ষু চড়কগাছ হয়, হলোও। এখানে এসে এই ইংরেজিটা উনার শেখা হয়েছে বলে বেশ আনন্দিত। তবে মনে হলো তাদের পার্টিতে এনে ভালোই করেছি। দুজনাই বেশ ফুর্তিতে আছেন। আপার কথা আমি বাবা বলতে পারছি না। মিলিটারির মা, সারাক্ষণ চোখ-মুখ কুচকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

 

একটু আগেই অন্য খালাম্মাটি এসে পা দেখিয়ে গিয়েছিলেন। কি সুন্দর হয়েছে দুটো পা। এই জীবনেও তার পুত্রবধূটি পা-টাও কোনোদিন ধুয়ে দিল না। আর এই এতো সুন্দর মেয়েগুলো তার পা ধরছে, ঘষাচ্ছে, ধুচ্ছে, লোশন দিচ্ছে, মুগ্ধতার শেষ সীমায় তিনি পৌঁছে গেছেন। তাকে অবশ্য বললাম না পয়সার জন্য পা পরিষ্কার করে দেওয়াটা এখন ভালো একটা ব্যবসা। আহারে, কী মায়াভরা মেয়েগুলোরে, মমতায় গদগদ হয়ে আছেন খালাম্মা। সবাই দুই খালাম্মাকে খুবই আপ্যায়ন করছে। আপার ধারেপাশেও কেউ তেমন ভিড়তে পারছে না। তিনি ঝাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। একজন বললো, তার হাতে একটা ঝাড়–গুঁজে দিয়ে, আচলটা কোমরে গুঁজে, একটা সাইবোর্ড তার পাশে দাড় করিয়ে রাখলে কেমন হয়- কাছে এলেই ঝাটার বাড়ি। আমার হাসি পেলেও হাসলাম না, কারণ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। মুরব্বি মানুষ। পাশে বসা খালাম্মা এখনো অনবরত কথা বলেই যাচ্ছেন। বললেন, ওই যে সুন্দরমতো মেয়েটা, আমাকে ডেকে নিয়ে গেল বারান্দায়, বললো এখানে সবাই কলনারী আর্ট নিয়ে আলাপ করছে, আপনার ভালো লাগবে। আমি ভাবলাম আর্টের কি বুঝবো আমি, ছবি আঁকা আমার কর্ম নয়। ওমা দেখি যে ওনারা সব রান্নাবান্নার গল্প করছে। একটা নতুন ইংরেজি শিখলাম কি বলো। শেখার কি শেষ আছে। সব বয়সেই শেখা যায়। আমি বললাম এই যুগে সবই ওকে মানে, ঠিক আছে। কিন্তু এই যুগেও ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে কথাটা ঠিক হওয়া কি দরকার ছিল। হলো, তাও আমার ক্ষেত্রেই।

 

অফিসে কমপিউটার চালাই, এখন বেড়াতে এসেও যদি দাঁড়াতে হয় পিসির সামনে, মানে হয় কোনো এর। অনেকেই ইদানিং, এসপি বাদ দিয়ে ভিস্তা অপারেটিং সিস্টেম কিনছে।

 

ওটার অনেক কিছুই এখন আমার কজন ভাবীকে বোঝাতে হবে। পার্টিতে অনেক ভাবীই আছেন যারা খুবই হাই-ফাই চাকরি করেন। তাদের থেকেও দেখলাম গৃহী ভাবীদের উৎসাহটা বেশি। এক ইঞ্জিনিয়ার ভাবী বিরক্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা আপনার ওই আপা যে আমাদের ওই সময় বড়লোকের বউ, বড়লোকের বউ ইত্যাদি বলে গেল কিছু বললেন না কেন, আমরা নিজেরাই তো বড়লোক। হাজব্যান্ড থেকে কি কম আর্ন করি। আপনার গায়ে লাগলো না কেন? বললেন না কেন আমাদের রোজগারে আমরা বাড়ি-গাড়ি কিনে হিট, সুপার হিট হয়ে যেতে পারি। আহ মরণ। বললাম, ছোটলোকের বউ বললে বলতাম কিছু। এখন তিনি তো পাশের রুমেই আছেন। শাড়ি উচিয়ে দেখিয়ে আসুন নিচের পা দুটো আপনার নিজেরই, ধার করা না। হাজব্যান্ডের লোমশ লোমশ পা না। তিনি আমার কথায় হাসতে লাগলেন। আপা আসার পর থেকেই সবাইকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অক্লান্ত ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন, কেউ শুনুক বা না শুনুক উনি বলেই চলেছেন। একজন বললো, চিন্তা নেই আপা, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে দুলাভাইয়ের পায়ের ওপর ভর করে আপনার পায়ে কুড়াল মারবো না। আপা অবশ্যই এসব অর্বাচীন কথাবার্তায় খুবই বিরক্ত হলেন। তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা নিয়ে ফাজলামো? আপা বুঝতে চান না যে, গ্রহণযোগ্যতার প্রথম শর্তটাই হচ্ছে সময়। সময় বুঝে কথা বলতে হয়। যাকে বলে ঝোপ বুঝে কোপ মারা। অন্যথায় কেও কথা শুনবে না।

 

একটু পরপরই ফোন বাজছে, সবার স্বামীই ফোন করে খবর নিচ্ছে পার্টিতে কি অবস্থা চলছে, চলছে না হঠাৎ ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। একজন দুঃখ করে বললেন, তার সঙ্গে ঝগড়া করি বলে কি দুনিয়াময় ঝগড়া করে বেড়াবো নাকি? যে কোনোভাবেই হোক, এ বাসার টেলিফোনের স্পিকারে ডিরেক্ট কানেকশন হয়ে গেছে। যে ফোন করছে তার কথা ঘরময় শোনা যাচ্ছে। সবাই বললো, এভাবেই থাকুক। আজকে কোনো প্রাইভেসিরই দরকার নেই। সবাই শুনবে কার বর কার সঙ্গে কিভাবে কথা বলে।

 

হঠাৎ আমার সেল ফোনটা বেজে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে জনতার দাবি, আমার সেলের স্পিকার অন করতে হবে। করলাম। ফোনটা করেছেন অবশ্য দুলাভাই। আপাকে না চেয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা এখন কোথায়? রঙ কি আপনার গাড়িটার। রাস্তায দেখছি একটা গাড়ি উল্টে কয়েকজন মরে পড়ে আছে। বলতে পারতাম আমি কথা বলছি, অতএব আমি জিন্দা; কিন্তু ফোনের কানেকশনটা এতোই খারাপ যে, কোনো কথাই পরিষ্কার নয়। সিগনাল পাচ্ছে না ঠিকমতো। ঘষ ঘষ শব্দ হচ্ছে। দুলাভাইয়ের সঙ্গে মজা করা গেল না। বললাম, গাড়ির রং শ্যামপেইন কালার। দুলাভাই আবারো চেচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কন কি বুঝি না? এবার তার বোঝার সুবিধার জন্য আমেরিকান নামটা বললাম, ডেজার্ট সেন্ড মাইকা। কি শুনলেন তিনিই জানেন। তবে অবাক হয়ে বললেন, কন কি মাইয়া লোকেরা ডেজার্টে বইসা শ্যামপেইন গিলতাছেন! চারদিকে ওহ্ মাই গস বলে একটা রব উঠলো। আমি দ্রুত ফোনটা আপার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। আপাও ঝটিকা বেগে ফোনের ক্যাপটা বন্ধ করে দিলেন, যেন চিরতরের জন্য দুলাভাইয়ের মুখ তিনি এক্ষুনি সেলাই করে দিলেন। যদিও আমরাই আরেক দফা অবাক হয়ে চুপ করে গেলাম। বিস্ফোরিত চোখে একে অন্যকে দেখতেও এবার ভুলে গেলাম। আপা শুধু বললেন, পুরুষশাসিত সমাজে এটাই চলবে। আমরা কেউ কোনো মন্তব্য করলাম না। তবে সে শুধু দুই মিনিটের জন্য। এরপরেই অট্টহাসির রোল উঠলো ঘরময়। ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলো সবাই।

 

বাসায় ফিরছি, রাত হয়ে গেছে। আমার তিন কিটিও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনে ভালোই ধকল গেছে তাদের ওপর। চুপচাপ চারদিক। ডালাসের রাস্তাঘাট বড়। বিশাল প্রশস্ত। দুই ধারে মাইলকে মাইল খালি। ধু-ধু মাঠ। লোকালয় নেই। তার ওপর রাত। আরো নিঝুম নিশ্চুপ। শুধু চাদ আছে আকাশে, তাও একা। আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়লো, যাকে বলেছিলাম বোবা মেয়ে বিয়ে করতে। ভদ্রলোক এমন সুন্দর এক চাঁদনী রাতে ভালোবাসার মেয়েটিকে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে চান। বন জোছনার মাতাল হাওয়ায় মাইলকে মাইল চষে বেড়ানোর ইচ্ছায়। তিনি ভাবছেন কোনো কথাই থাকবে না ওই সময় প্রিয়ার মুখে। উপস্থিতিই সব কথা হয়ে উঠবে। পাগল নাকি এই লোক! বোবা মেয়ে বিয়ে করবে না অথচ কথাও বলতে দেবে না। বসে থাকবে সাদা জোছনায় বকুল ফুল হয়ে। নো ওয়ে। কিটি থাকলেই কথা, বাকবাকুম পায়রার মতো বক বকাবে।

 

হঠাৎ দেখলাম, আশ্চর্য এরাও সবাই চুপ হয়ে গেছে। নীরবতাই যেন অন্য কোনো সুরে কথা বলছে। নিজে নিজে মনের ভেতরে ভেতরে। মনে হলো নদীকূলে গিয়ে বসা গেলে এমন রাতে চমৎকার হতো। হঠাৎ পেছন থেকে এক খালাম্মা বললেন, আমি একা প্রায়ই একটা নদীর ধারে যাই। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার মনের কথা বলছে কেমন করে! অন্যজন বললেন আমিও। আমার কাছেও একটা নদী আছে। নদীটার নাম আমি দিয়েছি দুঃখ। অন্যজন বললেন, আমি প্রথমে নাম দিয়েছিলাম অশ্রুজল, পরে বদলে আমিও করে দিয়েছি দুঃখ। আমি বললাম, আমাকে দেখাবেন নদীটা কেমন? এক খালাম্মা বললেন, এই নদী দেখা যায় না। আমাদের সঙ্গেই শুধু দেখা করে যায়। আপা কিছুই বলছেন না। মাথা পেছনে এলিয়ে খোলা মুন রুফ দিয়ে বহুদূরের আকাশের দিকে চুপচাপ চেয়ে আছেন। তিনিও কি দাবি করবেন নাকি, তারও একটা আকাশ আছে? দুঃখের আকাশ। আপা কিছু বলছেন না।

 

আমি পেছন ফিরে দুই নদীর মালিককে দেখতে চেষ্টা করলাম না। বা সাহস করলাম না কারো দুই চোখে নদীর ছিটা দেখতে। স্মৃতির ভিড় ঠেলে দুঃখকে যে দেখতে চায় দেখুক। টেক্সাসের আলোচিত বন্যার পানিতে দুইফোটা অশ্রুজল কিইবা আর তোলপাড় ঘটাবে। আমি জোরে গান ছেড়ে দিলাম, ধুমধাড়াক্কা মার্কা গান। তাদের দিনে যখন পৌঁছাবো হয়তো আমিও মালিক হবো দুঃখ নামের কোনো এক নদীর। কে জানে কী হবে! আজ ভুলে থাকি। আনন্দ করে নেই।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মে ২০১৬/সাইফ