শিল্প ও সাহিত্য

প্রসঙ্গ : পোড়ামাটির শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

শিহাব শাহরিয়ার : পোড়ামাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্প। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, কান্তজি`র মন্দির ও উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত নিদর্শন বা উপাদানে এই প্রাচীনত্বের প্রমাণ মেলে। গবেষকদের মতে, এই সব উপাদান বা নিদর্শন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে তেরো শতকের বহু স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন এসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন মন্দির ও মসজিদের গায়ে মাটি বা টেরাকোটার যে শিল্পকর্ম, তাও মৃৎশিল্প বা পোড়ামাটির ঐতিহ্যের চমৎকার উদাহরণ।মৃৎ মানে মাটি। এর সাথে শিল্প শব্দটির সংযোগে মৃৎশিল্প শব্দটির উৎপত্তি। যারা এই শিল্পকর্মে জড়িত তাদের ‘কুমার’ বা ‘কুম্ভকার’ বলা হয়। বর্তমানে তাদের মৃৎশিল্পী হিসেবেও অভিহিত করা হয়। পরিবারকেন্দ্রিক এই শিল্পে একজন পুরুষ শিল্পীর সাথে অবশ্যই একজন নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত। এর ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায় না বললেই চলে। মৃৎশিল্পকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন এক আর্থেন ওয়ার, দুই স্টোন ওয়্যার ও তিন পোরসালিন। দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্র স্টোন ওয়্যারের অন্তর্ভুক্ত। কুমার বা কুম্ভকাররা এই শিল্পের ধারক ও বাহক। মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি। কুমাররা সাধারণ মাটি দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করেন। এরপর এগুলো চুল্লির আগুনে পোড়ানো হয়। মাটি মসৃণ করে ছেনে স্টোন ওয়্যারের শ্রেণিভুক্ত তৈজসপত্রগুলো সাড়ে এগারশ’ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ১৫শ’ ডিগ্রী তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এসবের নান্দনিক উপকরণগুলো রং-তুলির সাহায্যে দৃষ্টি নন্দন করে তোলা হয়।মাটি দিয়ে যেসব জিনিস তৈরি করা হয় এর মধ্যে হাঁড়ি, পাতিল, ঢাকনা, কলসী, জলকান্দা, পিঠা তৈরির সাজ ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে টেবিল ল্যাম্প, ফটোফ্রেম, ভাস্কর্য, ফুলদানি, মোমদানি, এসট্রে, কলমদানি, ঘণ্টা, কলম, কাপ, ওয়াল শোপিস ও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ইত্যাদি। মাটি দিয়ে তৈরি এসব পণ্য প্রথমে রোদে শুকিয়ে পরে আগুনে পুড়িয়ে টেকসই করে রং দিয়ে দৃষ্টি নন্দন করা হয়। দেশের হাট-বাজারে এবং গ্রামীণ মেলায় এসব পণ্য প্রদর্শিত হয়। রাজধানী ঢাকার শিশু একাডেমীর সামনে মাটির তৈরি নান্দনিক শিল্পকর্মের বছরব্যাপী বিক্রি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় মাটির তৈরি এসব পণ্যের বেশিরভাগ আসে পার্শ্ববর্তী রায়েরবাজার, কালিয়াকৈর, ফুলপার ও মানিকগঞ্জ এবং পটুয়াখালী, রাজশাহী, শরীয়তপুর ও কুমিল্লা থেকে। এসব পণ্য তৈরিতে নিরলস শ্রম দিয়ে আসছেন এ দেশের গ্রামীণ নারীরা। পণ্য তৈরি, পোড়ানো, রং করা থেকে শুরু করে বাজারজাত করার ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে চলেছে। এসব শ্রমজীবী নারীর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগই অশিক্ষিত, বাকি ১০ ভাগ সামান্য লেখাপড়া জানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু জীবিকার জন্য নারীরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।অন্যান্য শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মতো মৃৎশিল্পের নারীরাও মজুরি বৈষম্যের শিকার। পুরুষের সমান কাজ করেও তারা একজন পুরুষ শ্রমিকের মজুরির দুই-তৃতীয় লাভ করে। নারী উন্নয়নে এসব মৃৎশিল্পীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দৃষ্টি দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মৃৎশিল্প একটি উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় খাত। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা নারীদের এতটুকু অবসর নেই। নেই কোনো বিনোদন, নেই ভালো খাবার-দাবার। সংসারের কঠিন ঘানি টানা এসব শ্রমজীবী নারীর সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়তে পারে না। ছোট্ট দুধের শিশুকে নিয়েও নারীকে কাজে বের হতে হয়। এ চিত্র আরো করুণ। এসব খেটে খাওয়া নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। অথচ বর্তমানে এই শিল্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়।বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রী সহজলভ্য হওয়ায় মৃৎশিল্প অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। একদিকে দামে সাশ্রয়ী ও টেকসই এবং প্লাস্টিক সামগ্রী রিসাইক্লিং করার সুযোগ থাকায় প্রস্তুতকারকরা ক্রেতাদের বাড়তি সুবিধা দেয়। ইত্যাদি কারণে ক্রেতারা প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসবের পরও বাংলাদেশে এই শিল্পটির কদর কম নয়। এখনও এমন কোন বাড়ি বা ঘর পাওয়া যাবে না, যেখানে মৃৎ পণ্য নেই। ঘর গেরস্থালী থেকে শুরু করে নান্দনিক শিল্পকর্ম হিসেবে এই পণ্যগুলো এখন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের রান্নাঘর ছাড়াও ড্রইং রুম শোভা পাচ্ছে। কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি এসব পণ্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা পাচ্ছে।

   মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি নদীমাতৃক বাংলাদেশে সহজলভ্য। অথচ এই কাদামাটি ভারতের পশ্চিম বাংলায় দুর্লভ। এ কারণে এই শিল্পটির সম্ভাবনা বাংলাদেশেই উজ্জ্বল। সরকারি, বেসরকারি সহায়তায় এই শিল্পটির প্রসার একদিকে যেমন কুমার সম্প্রদায়কে তাদের বাপ-দাদার পুরনো ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখে স্বাবলম্বী করতে পারবে, তেমনি এগুলো বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আমাদের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে পারে। মৃৎ সামগ্রীর বাণিজ্যিক প্রসারের জন্যে মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা এবং তাদের তৈরি পণ্যের প্রদর্শনী ও বাজারজাত সুনিশ্চিত করতে হবে। ঐতিহ্যপূর্ণ এসব শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে মৃৎশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটবে। অনেক শিল্পমনস্ক মানুষ মনে করেন, আধুনিক মৃৎশিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেলে এরা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে। তবে সেক্ষেত্রে সুদবিহীন ঋণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। মৃৎশিল্পীদের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ ও অনুদান এবং বিনাসুদে অথবা সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে সহজেই এ শিল্পের গৌরব টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম প্রধান অংশ; মৃৎশিল্প বা পোড়ামাটিশিল্পের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংগ্রহ করেছে ও প্রদর্শন করছে এই শিল্পের বহু প্রাচীন ও আধুনিক উপাদান বা নিদর্শন। তবে স্থান বা পরিসরের অভাবে সংগ্রহের সবগুলোই দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি। সেকারণে মাঝে মাঝেই দর্শকদের জন্য, প্রধানত নতুন প্রজন্মের মানুষদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করে এসব সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে একাডেমিক পর্যায়েও সাম্প্রতিককালে মৃৎশিল্পের চর্চা এবং উৎপাদন বেশ সাড়া জাগিয়েছে। মৃৎশিল্প মানেই হিন্দু সম্প্রদায়ের পাল বংশের লোকেদের কাজ; এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পোড়ামাটি বা মৃৎশিল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিত্য-নতুন চর্চা ও গবেষণায় এবং আধুনিক ফর্মে বা পদ্ধতিতে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মৃৎশিল্পের আধুনিক পর্যায়কে দারুণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদও বিশাল ভূমিকা রাখছে।বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর তার চিন্তা ও কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাথে যৌথভাবে আয়োজন করল পোড়ামাটি শিল্পকর্মের একটি বিশেষ প্রদশর্নী। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তা জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, বিশেষ অতিথি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড. মুস্তফা শরিফ, সাবেক সংসদ সদস্য জনাব এস এ আকরাম, প্রধান অতিথি সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এবং সভাপতি বরেণ্যশিল্পী জনাব রফিকুন নবী একই সুরে বলেন, বাংলার হাজার বছরের লোকশিল্পের এই অন্যতম পোড়াশিল্প বা মৃৎশিল্পকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। বাঁচিয়ে রাখতে হবে চর্চা ও উৎপাদনের মাধম্যে। পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে এর অগ্রযাত্রায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এই যৌথভাবে আয়োজন নতুন মাত্রা যুক্ত করল।প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ১৫ জুলাই, শেষ হবে ২৬ জুলাই। দর্শকদের জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রদর্শনী খোলা থাকে।রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুলাই ২০১৬/তারা