সাইফ বরকতুল্লাহ : প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবী। ৯০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন এই লেখিকা। দীর্ঘদিন ধরেই রোগে ভুগছিলেন। অসুস্থ ছিলেন ফুসফুসের সংক্রমণে। অবশেষে ‘হাজার চুরাশির মা’- খ্যাত সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী বৃহস্পতিবার দুপুর ৩.১৭ মিনিটে দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে মারা যান।মহাশ্বেতা দেবী। বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ‘হাজার চুরাশির মা’ তার বিখ্যাত উপন্যাস। মধ্যবিত্ত বাঙালি মায়ের নকশাল করা ছেলেটিকে হারানোর যে বেদনা, সেই বেদনার মধ্য দিয়েই ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল উপন্যাসটি। সেই থেকেই শুরু। এরপর শুধু সাহিত্য চর্চাই নয়, প্রান্তিক মানুষ নিয়ে মাঠেও নেমেছিলেন মহাশ্বেতা। তুলে ধরেছিলেন তাদের দুঃখ, কষ্ট, অধিকার আদায়ের গল্প। মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান লেখক, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার কর্মী। ইতিহাস ও রাজনীতির ভূমি থেকে যে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তা কেবল শোষিতের আখ্যান নয় বরং স্বদেশীয় প্রতিবাদী চরিত্রের সন্নিবেশ বলা যায়। প্রতিবাদী মধ্যবিত্ত প্রান্তিক ও পাহাড়ি-বনাঞ্চলের জীবন ও যুদ্ধ, নৃগোষ্ঠীর স্বাদেশিক বীরগাথা আখ্যান রচনার পারদর্শিতা তাকে বিশিষ্ট করেছে। শুধু উপমহাদেশে নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে তার সাহিত্যকর্ম পঠিত ও আলোচিত হয়েছে। ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের এক খ্যাতনামা পরিবারে তার জন্ম। মহাশ্বেতা দেবীর বাবা মনীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং তার চাচা ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক। তার ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য কথাসাহিত্যিক ছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।
লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ইতিহাস তার সাহিত্যজীবনে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তিনি মনে করতেন ইতিহাসের ভেতর থেকেই বের হয়ে আসে সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং তার আনুষঙ্গিক লোকাচার, লোকজসংস্কৃতি, লোকায়ত জীবনব্যবস্থা। তার প্রথমদিকের সাহিত্যকর্মে এই প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। সবসময় সোজা সাপ্টা কথা বলতে ভালোবাসতেন তিনি। কাউকে জবাব দিতে হলে তার মুখের শব্দ নয়, কলমের ধারই কথা বলত। এমনই ছিলেন তিনি। কাউকে পছন্দ হলে কাছে টেনে নিতে তার একটুকু সময় লাগত না। আবার অপছন্দের ব্যক্তিকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন না। এমনই ছিল তার ব্যক্তিত্ব। তার দৃঢ় সাবলীল চিন্তার সঙ্গে কাজের এতটুকু ফারাক থাকত না। লেখা ছিল তার ভালোবাসা, তা বলে কখনো শুধু লেখার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। মানুষের স্বার্থে মানুষের হয়ে বারে বারে পথে নেমেছেন। আদিবাসী, দুস্থদের মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। বাংলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনে তৎকালীন বাম সরকারের বিরোধিতায় অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে শোকের ছায়ামৃত্যুর খবর ছড়াতেই শোকস্তব্ধ মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে। অনুরাগী, সাধারণ মানুষ, রাজ্যের মন্ত্রী, শিল্পী, সাহিত্যিকরাও একে একে হাসপাতালে পৌঁছান। শোকবার্তা পাঠায় বিশিষ্টজনরাও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে টুইটারে লিখেছেন, ‘সমবেদনা, সাম্য এবং ন্যায়ের কণ্ঠস্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, গভীরভাবে শোকাহত।’
হাজার চুরাশির মা- উপন্যাসের প্রচ্ছদ
তার সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, ভারতীয়, জার্মান, জাপানি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ১৯৭৯ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান অরণ্যের অধিকার-উপন্যাসটির জন্য। ভুবনমোহিনী দেবী পদক, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য স্বর্ণপদক, ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ পদক পান। এ ছাড়া জগত্তারিণী পুরস্কার, বিভূতিভূষণ স্মৃতি সংসদ পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত লীলা পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে ম্যাগসাসাই পুরস্কার পান আদিবাসীদের মাঝে কাজ করার জন্য। ১৯৯৮ সালে সাম্মানিক ডক্টরেট পান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভারতীয় ভাষা পরিষদ সম্মাননা ২০০১ অর্জনসহ আরও অনেক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৬/সাইফ