শিল্প ও সাহিত্য

সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || শেষ পর্ব

রশীদ গ্লাস নিয়ে কলসি থেকে পানি ঢেলে আনে। মাটির কলসির পানি ও কখনো পান করেনি। আজ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বেশ লাগে।

 

বলে, এই পানিতে আমার মায়ের স্নেহ আছে। পানি যখন গলা দিয়ে নেমেছে তখন মা বলেছে, গলাটা এমন শুকিয়ে রাখিস না বাবা।

 

রশীদ হা হা করে হাসতে হাসতে বলে, এমুন কথা মুই জীবনে শুনি নাই। এইডা কেমুন কথা হইল! থাম, থামরে পোলা। হাফিজা খাতুন দ্রুত কণ্ঠে বলে, এই কথা হইল মায়ের লাগি পরান পোড়ার কথা। মা যার পরানে তড়পায় হেই এমুন কথা কয়। বুঝছস!হ বুঝছি। আপনেও মোর পরানের গহিনে আছেন মাগো।তুই মোরে পরানে রাখছস বাজান, কিন্তু মোর পরানে শান্তি নাই।

 

হাফিজা খাতুন মশিরুলের দিকে তাকিয়ে বলে, পোলাডা বিয়া কইরতে চায় না। কয়, বউয়ের লগে মায়ের যদি বাজাবাজি হয় তাইলে মুই কী করমু? আমি কই, বাজাবাজি অইব না। মুই এক কোনায় পইড়া থাকুম। তোমাগো সংসারে হাতই থুমু না। পোলা তাও মোর কথা হুনতে চায় না। এইডা একডা জ্বালা না বাজান? হ্যাঁ, জ্বালা তো বটেই। কী রে রশীদ-আপনেও তো বিয়া করেন নাই ভাইজান-আমি তো একা থাকব ঠিক করেছি।মুইও একা থাকুম। মা মইরা গেলে মুই মেঘনা নদীতে ডুইবা যামু।কী কস বাজান! চিৎকার করে ওঠে হাফিজা। তারপর কেঁদে বুক ভাসায়।মশিরুল ওর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে, মাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? বোকার মতো কথা বলছিস। গাধা একটা।

 

রশীদ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। পরমুহূর্তে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাজান হারায়ে গেল ক্যান? বাজানের কবর থাকব না?মশিরুল ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে, চল বাজারে যাই। আমি এখন আসি খালা। পরে আবার আসব।

 

দুজনে বেরিয়ে আসে। ওর সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। তার পরও জিজ্ঞেস করে, ঘুঘুর ডিম আছে কোন গাছে রে? বাচ্চা ফুটিয়েছে?জানি না। কইতে পারুম না।তুই তো আগে পশুপাখির খোঁজ রাখতি। অহন আর ভাল্লাগে না।তোর কী হয়েছে রে? এই বয়সে যদি এমন কথা বলিস তাহলে জীবনভর কি বলবি? সামনে কতশত দিন পড়ে আছে না? বল, তোর কি হয়েছে?কী অইব? কিছু অয় নাই। মোর বিয়া করার ইচ্ছা নাই। কী অইব বিয়া কইরা? অহন নিজের মতো থাহি। ইচ্ছা অইলে কাম করি। দিনমজুরির কাম। ইচ্ছা না অইলে করি না। পুকুরের ধারে বইয়া মাছ ধরি। মায়েরে মাছ ধইরা দিলে মা রান্দে। দুইজনে মিলা খাই। দিন তো কাইটা যায়। খুব ভালা কাইটা যায়।বুঝেছি। তুই খুব ভালো আছিস। তোর দিন সুখেই কাটছে। হা-হা করে হাসে রশীদ। হাসিতে ওর ভালো থাকার প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হয়। মশিরুলের নিজের ভেতরে একই স্পন্দন মাতিয়ে তোলে ওকে। ও ভাবে, ও এখন নতুনভাবে জেগে ওঠা সহস্র বছর আগের পূর্ববঙ্গ। বুকের ভেতর হাজার নদীর কল্লোল।

 

কয়েকদিন থেকে মশিরুল ফিরে আসে ঢাকায়।মেইন গেট বন্ধ। গেটের চাবি একটি ওর কাছে আছে, অন্যটি শরীফের কাছে। ও চাবি বের করে তালা খোলে। ঘরে ঢোকে। নিশাত ওকে বলেছিল, ওরা সিলেটে বেড়াতে যাবে। গেছে হয়তো। নিশাত ওকে ফোন করেনি। রাগ করেছে কি? নাকি সুযোগ করতে পারেনি? মশিরুল রান্নাঘরে ঢুকে চারদিক দেখে। ঠিক আছে ঘরের সবটুকু। বারান্দায় মঈনের কাপড়-চোপড় ভাঁজ করে কাঠের তাকের ওপর রাখা আছে। ও বেশ শৌখিন ছেলে ছিল। নানা রঙের প্যান্ট-শার্ট, বিভিন্ন রকমের টি-শার্ট, এমনকি পাঁচ-সাত রকমের লুঙ্গিও ওর শখের ছিল। নিজের একটি স্যুটকেসে কাপড়গুলো যত্ম করে রাখবে বলে ঠিক করে। বেডরুমে ঢুকে চারদিকে তাকায়। সবই ঠিক আছে। ব্যাগটা এক কোনায় রেখে বাথরুমে ঢোকে ও। শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালে প্রবল শূন্যতা অনুভব করে। পানির ধারা গড়িয়ে পড়ে শরীরে। ভাবে, নতুন দিনের সূচনা করা যায় না? বেঁচে থাকার অন্যকিছু আবিষ্কার? যেখানে নিজের উপলব্ধিকে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হবে? বাবা ওকে লিখতে বলতেন। বলতেন, চিন্তা করতে শেখো। দেখবে, খুঁজে পাবে অন্য পৃথিবী। বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করত হয় বাবা।

 

সেই কৈশোরে বাবার স্বপ্নের জায়গা বুঝতে পারেনি ও। এখন মনে হয় অনেক সময় গড়িয়েছে। এবার একটা কিছু করা দরকার। ইতিহাসের পূর্ববঙ্গ- পূর্ববঙ্গে নদ-নদী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে একটি বড় বই লিখবে। তেমন প্রস্তুতি কি বুকের মধ্যে ছিল? হবে হয়তো। নইলে এই শাওয়ারের পানির নিচে দাঁড়িয়ে কেন বড় লেখার পটভূমি জেগে উঠছে মনে? ও শাওয়ার বন্ধ করে। গায়ের পানি মোছে। রান্নাঘরে গিয়ে চুলোয় ভাত বসায়। ডাল রান্না করবে। সঙ্গে ডিম ভাজি। আপাতত এ-ই চলবে। খেয়ে-দেয়ে বই নিয়ে বসবে।

 

ও এখন কাঁচের ঘরের মানুষ। কাঁচের দেয়ালে ভেসে উঠেছে ওর কৈশোরের একজন মানুষ। ছত্রিশ নম্বর অ্যালিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটি তার নিজের ছিল না, ছিল ভাড়া বাড়ি। সেদিন সূর্য ওঠার আগে ওই বাড়িতে এসেছিল পাকবাহিনীর ছাব্বিশ নম্বর ইউনিট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে। সেদিন পাক সেনা সদস্য তাকে পাঁচটি গুলিতে বিদ্ধ করেছিল। মশিরুল শুনতে পায় ডাক, দেখো আমাকে। আমি আপনাকে দেখছি শহীদ বীরযোদ্ধা। সেদিন আমি বলেছিলাম আমার সামনে আছে, একদফা। স্বাধীনতা, বাঙালির মুক্তির পথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ইতিহাসের এসব বিষয় জেনেছি বীরযোদ্ধা। হা হা করে হাসেন তিনি। হাসি থামিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পথ কঠিন। নির্মম। সাহসের। এবং বিজয়ের। এ সত্যও আমি বুঝেছি। তারপরও আমি আপনাকে খুঁজি। জানি আপনি ইতিহাসের পাতায় আছেন। তারপরও মনে হয় যদি আপনি কোথাও থাকেন, কোনো অদৃশ্যলোকে, আকাশে বা পাতালে। যদি আমি আপনার হাত ধরতে পারি।

 

আবার প্রবল হাসিতে চৌচির হয় কাঁচের দেয়াল। মশিরুলের সামনে আর একটি অন্যরকম দৃশ্য তৈরি হয়। দেখতে পায় তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। পেছনে সারিবদ্ধ সেইসব নতমুখ মানুষ যারা স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত। মশিরুল বড় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস  ছাড়ে। সেই বিশ্বাস যুক্ত হয় স্বাধীনতার স্বপ্নের সেই সব নিখোঁজ মানুষে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দের সঙ্গে। ও নিজের রান্না করা খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। কিন্তু খেতে পারে না। মঈনের জন্য চোখের পানি গড়ায়। বলে, এমন করে তোকে মরতে হবে তা আমার স্বপ্নে অতীত ছিল রে মঈন। ভাত খান স্যার। আপনার খিদে পেয়েছে। না, আমার খিদে পায়নি।

 

সামনে আপনার অনেক কাজ। ভাত না খেলে কেমন করে করবেন। ভাত খান স্যার। তুই বলছিস?হ্যাঁ বলছি। আপনি খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত বলতেই থাকব। মশিরুল ঘরের চরদিকে তাকায়। কোথাও কেউ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ইলেকট্রিক তারের ওপর বসে আছে তিনটি কাক। মশিরুল কয়ে চামচ ভাত প্লেটে করে এনে বারান্দার কোণায় ঢেলে দেয়। কাকগুলো উড়ে আসে। মশিরুল ডাইনিং টেবিলে ফিরে আসে। শুনতে পায় কাকদের ডাক, পাখা ঝাপটানি, এমনকি ভাতের মাঝে ঠোঁটের শব্দ। ও ভাত খেতে পারে না। আনমনা হয়ে বসে থাকে। টের পায় একসময় ভাত খাওয়া শেষ করে কাকেরা উড়ে যায়। দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়েছে।বেশ সময় কেটে যায়। ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না। প্লেট-বাটি-গ্লাস গুছিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসে। বারান্দা ঝাড়ু দেয়। কাকেরা ভাতগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেয়েছে। পুরো বারান্দুজুড়ে ভাতের দানা পড়ে আছে। মন খারাপ হয় ওর। ঝাড়ু শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর আর একজন মঈন দরকার। কোথায় পাবে? না, মঈন পাবে না। পাবে অন্য কাউকে, সালাম বা ইদ্রিস। ওদের সঙ্গে প্রাণের টানের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আবার মঈনের ভাবনা বুকের সমতলে পলিমাটি ভরে দেয়। ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। দুপুরের পর থেকে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে মনে পড়ে। স্মৃতির বয়স কম ছিল না যে তার চেহারা ভুলে যাবে। কৈশোরের সেই বয়সে দেখা মানুষটিকে খুব মনে পড়ছে। বাবার প্রতিবেশী শুধু ছিলেন না, বন্ধুত্বও ছিল দুজনের। নানা গল্প হতো। দেশের রাজনীতি বিষয়ে বেশি। তখন অনেক কিছু বোঝার বয়স ওর ছিল না। এখন অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করতে পারে। কৈশোরের স্মৃতিকে জড়িয়ে জাগিয়ে তোলার জন্য পড়ার ঘরে আসে। যেসব বই পড়ে সেগুলো পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওর টেবিলে থাকে। সঙ্গে থাকে বই থেকে উল্লেযোগ্য কিছু পয়েন্ট নোট করার জন্য কাগজ-কলম। ঘরের লাইট অন করে। আবার ভেসে ওঠে কাঁচের দেয়াল।

 

বয়ে যাচ্ছে নদী? নিজের নাম বলো।আমি আগুনমুখা। তোমার নাম নীহাররঞ্জন রায়ের বইয়ে নেই আগুনমুখা। আমি তোমার স্মৃতিতে আছি। তুমি আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবার সঙ্গে লালদিয়ার চরে গিয়েছিলে। হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে। এখন তোমার কলকল ধ্বনি শুনতে আমার খুব ভালোলাগছে। তোমার নামটি খুব সুন্দর। মশিরুলের মনে হয় নদীর প্রবাহ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ওর ঘরের ভেতরে এই মুহূর্তে নদীর কল্লোল ছাড়া আর কিছু নাই। ‘বাঙালীর ইতিহাস’- বইয়ের পাতা উল্টে ‘দেশ-পরিচয়’ অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠায় এসে থমকে যায় ও। ও পড়তে থাকে- ‘কিন্তু গৌড় নাম লইয়া বাংলায় সমস্ত জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই। সেই সৌভাগ্যলাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, এবং যে-বঙ্গ-নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু, সমস্ত বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই, তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হইল। ইংরেজ আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, যদিও আজিকার বাংলাদেশ আকবরী সুবা বাংলা অপেক্ষা খর্বীকৃত।’

 

বইয়ের এই অধ্যায় এখানেই শেষ। এই অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয় মোয়াজ্জেম হোসেনের স্মৃতি। সময়ের ইতিহাস বিকশিত হয় মাথায়। গৌড় থেকে বঙ্গ হয়েছে এটাই বাঙালির শক্তি। বঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়েছে এটাও বাঙালির শক্তি। ও বঙ্গ বঙ্গ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি মোয়াজ্জেম হোসেন। আমার কিশোরবেলায় দেখা আপনি এখন বুকটান করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মানুষ। ইতিহাসবিদ সুবা বাংলাকে খর্বীকৃত বলেছেন। আপনার জীবনদান স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশাল আকৃতি দিয়েছে। ইতিহাসের অনেক মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ দেখেনি। আপনার রক্তের বিনিময়ের স্বাধীনতা আমাকে খর্ব আকারে ডুবিয়ে রাখে না। আপনি আমার কাছে নিখোঁজ মানুষ নন।

 

মশিরুল ওর প্রিয় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় ছেলেরা বল নিয়ে খেলার জন্য জড়ো হচ্ছে। ওদের চিৎকার-উচ্ছ্বাস ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। ওর কানের তটে এসেও পড়ছে সে ধ্বনি। ধ্বনি ওর সামনে মেঘনা নদী। সন্দ্বীপ হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বাবা বলতেন, নদীর ইতিহাস আমাকে খুব আনন্দ দেয়। তোরা তো জানিস না যে নদীর ইতিহাস পড়তে পড়তে আমি মগ্ন হয়ে যাই। পড়া একবারে শেষ করি না। আবার পেছনে রেখে যাওয়া পৃষ্ঠায় ফিরে আসি। পড়ার সময় নদী আমার বুকের ভেতর থাকে।

 

বাবার এমন কথা শুনলে ওর খুব হাসি পেতো। ও জোরে জোরে হাসলে রেগে যেতো ওর বাবা। ধমক দিয়ে বলতো, গাধা একটা।বড় হওয়ার পরে ও ভেবে দেখছে যে, বাবার আনন্দের সঙ্গে ওর আনন্দ এক নয়। ওর জীবনে নদীর সঙ্গে মানুষ দেখার আনন্দ আছে। বাবা নদী দেখেছেন। মানুষ দেখেননি। মানুষের জীবন বাবাকে ভাবায়নি। ও মানুষের কথা ভেবেছে: রিয়াল লিভিং ইন লিভিং ফর আদার্স- এই ব্রতকে ও সত্য মেনেছে। মঈনের লাশ কবরে নামিয়েছে; মনপুরায় হাফিজা খাতুন, অতল জলদাসকে দেখেছে, যে নিশাত পারিবারিক নির্যাতনে দিন কাটাতে কাটাতে অবৈধ সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাদের জীবনের সঙ্গে যোগ হবে পূর্ববঙ্গ তারপর বাংলাদেশ। মশিরুল টেবিলে এসে বসে। কাগজ-কলম টেনে নেয়। লিখিত হতে থাকে জীবনের জলছবি। ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসে গড়ায় চলমান স্রোত।নাজমা আখতার ডাকে, বাবা ঘুমুবি না?আর একটু পরে মা। তুমি ঘুমিয়ে পড়।অনেক রাত হয়েছে বাবা।মাগো, তুমিতো জানো আমার কাছে রাতদিন সমান। জানি, জানি। তুইতো আমার একমাত্র সন্তান যে আমার কলজেটা ভরিয়ে দিয়েছে। আমি চাই না তোর কোনো অসুখ করুক। মাগো, আমি ভালোই অছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোর জন্য দোয়া করি। মশিরুল চারদিকে তাকায়। আবার কাগজের ওপর মগ্ন হয়। রচিত হচ্ছে একটি ভূখণ্ডের হয়ে ওঠার লেখা- নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক। গল্প লেখা হচ্ছে ভাঙাগড়ার জীবনের। যেখানে যুদ্ধ আছে, মৃত্যু আছে, শহীদের ত্যাগ আছে- বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই আছে।

 

আকস্মিকভাবে ও খেয়াল করে ঘরের কাঁচের দেয়ালে ভেসে উঠেছে কোটি কোটি মানুষ। যারা একর মধ্যে অনেক- একের মধ্যে অর্জন। নাম বদলায়, ঠিকানা বদলায় কিন্তু জলপ্রপাতের মতো ধারাবাহিক মানুষের স্রোতে বয়ে যায়। কেন মায়ের ডাক ওর কানে এলো? আসলে ও ঘোরের ভেতর ঢুকেছে। চরিত্র হয়ে ফিরে আসছে ফেলে আসা মানুষের ছায়া। জীবনের জলছবিতে রঙ লাগছে। মশিরুলে সামনে থেকে রাতের হিসেব মুছে যায়। ও ভুলে যায় যে ও মধ্যখানে এসে কাগজের ওপর ঝুঁকে আছে। 

 

৪.আমি এখন জনস্রোতে মিশে থাকা আরিফুর রহমান। একের ভেতর অনেক জীবন কাটিয়েছি। দেখেছি বেঁচে থাকার রূপ কত বিচিত্র। আমি আর সুষমা এখন একসঙ্গে থাকি। আমাদের জীবনে ভালোবাসার নদীর বিস্তার ঘটেছে। আমার যে সত্তাটি মশিরুলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সেখানে মর্মঘাতী বেদনা আছে। ও আমাকে বলেছে, আমি তোমার কাছে একটি সন্তান চেয়েছিলাম, দাওনি। আমি একজন মৃত নারী। শরীফ আমাকে সিলেটে বেড়াতে নিয়ে হোটেলের ঘরে গলা চেপে মেরে ফেলেছে। আমি চেঁচিয়ে ডাকি, নিশাত! আমি আমার লেখার মগ্নতা ধরে রাখতে পারি না। বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দেখতে পাই বিদ্যুৎহীন পুরো শহর। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। জনস্রোতে মিশে গেলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখি নিশাতকে- মৃত এবং রক্তাক্ত।

 

জুয়েলকে আমি কাছে টেনেছি। জন্ম পরিচয়হীন ধর্মহীন মানুষ হয়ে ও আমার চেতনায় আলো ফেলেছে। বেঁচে থাকা প্রকৃত সত্যটিকে ও আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি ওর কাছে আমার ভেতরের ওসমানকে তুলে ধরেছিলাম। ও হা হা করে হেসে বলেছিল, আমিই ওসমান। আমার শৈশব নাই। আমিই ওসমান। আমার মেধা আছে। আমিই ওসমান। আমাকে অন্যায় মৃত্যুর শিকার হতে হয়। আমিই ওসমান। আমি সারা দেশে আছি। হা হা করে হাসে জুয়েল। আমি বলি, জুয়েল তুই আমার শিক্ষক। তোর ভেতরে আমি ওসমানকে দেখি। মশিরুলকে দেখি। আমি আরিফুর রহমান শুরু করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের নায়ক হয়ে যায় জুয়েল- ওর সামনে ফুটে থাকে নদীমাতৃক দেশটি- মানুষ এবং নদীর স্রোতের মতো মানুষের জীবন।-সমাপ্ত

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ আগস্ট ২০১৬/সাইফ/তারা