শিল্প ও সাহিত্য

শহীদ কাদরীর প্রয়াণে ৩ কবির প্রতিক্রিয়া

অলাত এহ্সান : শহীদ কাদরীকে দশ ও দশকের গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় না। পঞ্চাশের দশকের তিন দিকপাল কবির একজন হয়েও তিনি সব দশকের; বাংলাদেশের হয়েও তিনি সমকালীন বিশ্বের। বাংলা কবিতার উত্তুঙ্গ সময় ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ‘বইঘর’ প্রকাশনী থেকে বের হয় শামসুর রাহমানের তৃতীয় কাব্যগ্রস্থ ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, আল মাহমুদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কালস’ এবং শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রস্থ ‘উত্তরাধিকার’। যা বাংলা কবিতার তিন মেরুকরণ।

 

‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশের মাধ্যমে শহীদ কাদরী দ্রুত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যদিও কবিতার আঙিনায় তার পদচারণা আরো আগে থেকেই। এবং অনেক আগে থেকেই তার এই পাঠকপ্রিয়তা। তারপরও তিনি কবিতার সংখ্যা রেখেছেন আশ্চর্য সীমিত। তাই ১২৬টি কবিতা নিয়ে তার চারটি কাব্যগ্রন্থ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিক ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের পরই তিনি কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

শহীদ কাদরী ৭৩ বছরের জীবনের যবনীকা টানলেন গত ২৮ আগস্ট, নিউ ইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এই ৬ যুগের আয়ুষ্কালে প্রায় ৬ দশকই তার সৃষ্টির কাল। তবে খসড়া কবিতার সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে সম্পন্ন কবিতায় সীমিত থেকেছে তার সাহিত্য।সত্তর দশকের শেষ বছর দেশ ছাড়ার পর গত ৩৭ বছর কলকাতা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের  বোস্টন ও পরে নিউ ইয়র্কে থিতু হয়েছিলেন শহীদ কাদরী। মাঝে একবার ঢাকায়ও ছিলেন কয়েক মাসের জন্য।

 

তুমুল আড্ডাপ্রাণ এই কবি। কিন্তু কী এক অভিমানে একুশে পদক নিতে দেশে আসেননি কবি, তা আর আজ সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। অথচ প্রবাস থেকে ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ শীর্ষক সাহিত্যে সুতীব্র চুম্বন পাঠিয়েছেন। এবার তিনি নিজেই এলেন। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শায়িত করা হয়। স্বদেশে ও বিদেশে শহীদ কাদরীর সান্নিদ্ধ পেয়েছেন কবি সাযযাদ কাদির ও ফকির ইলিয়াস। দূর থেকে তাকে জেনেছেন মলয় রায়চৌধুরী। কবির প্রয়াণে এই তিন কবি স্মৃতি ও শোকে স্মরণ করছেন শহীদ কাদরীকে। তাদের কথা এখানে গ্রন্থণা করেছেন অলাত এহ্সান।

 

মলয় রায়চৌধুরী : ষাটের দশকে কলকাতায় যখন মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিতায় হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট শুরু করেন। তখন এদের অনুকরণে ঢাকায় আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ প্রমুখ শুরু করেন স্যাড জেনারেশন মুভমেন্ট। এদের সবার সঙ্গে কলকাতার সংগ্রামীদের যোগাযোগ ছিল না। এই স্যাড জেনারেশনের অন্যতম আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের সুবাদে শহীদ কাদরীও যুক্ত হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। কিন্তু যুক্ত হয়েও বিযুক্ত থেকেছেন তার কবিতায়। যদিও খুব গভীরভাবে তাকে পড়া হয়নি। যেটুকু বলছি তা ইন্টারনেট থেকে তার কবিতা পড়ে। কবির প্রয়াণে ব্যথিত হয়েছি। আমার মনে হয় বাংলাদেশের কবিতার যে জলবিভাজক প্রজন্ম ছিল, উনি তাদের অন্যতম।

 

সাযযাদ কাদির : শহীদ কাদরীর সঙ্গে মধ্য ষাটে রফিক আজাদের মাধ্যমে আমার পরিচয়। সাহিত্য চর্চার সময় বিবেচনায় উত্তর প্রজন্মের হলেও আমাদের অন্তরঙ্গতা ছিল। তখন তিনি থাকতেন গোপীবাগে, বড় ভাই শাহেদ কাদরীর পরিবারের একজন হয়ে। ওই সময় ঢাকা টেলিভিশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বাসায়ই থাকতেন বেশির ভাগ সময়। প্রায় সারারাত জেগে পড়তেন, লিখতেন, ঘুম থেকে উঠতেন দুপুর বারোটার দিকে। সন্ধ্যার দিকে কোনো-কোনো দিন বেরোতেন আড্ডা দিতে। কিছু দিন অনিয়মিতভাবে নবাবপুরের ঢাকা হোটেলে আড্ডা দিয়েছেন, পরে প্রায় নিয়মিত বসতেন গুলিস্তান এলাকার রেকস রেস্তরাঁয়। রফিক আজাদ, ফরহাদ মজহার প্রমুখের সঙ্গে আড্ডা দিতে কখনও আসতেন ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল)-এ, আমার ও রাজীব আহসান চৌধুরীর সঙ্গে অনেক দিন এসেছেন মুহসীন হল, শরীফ মিঞার ক্যানটিন, নিউ মার্কেটের মোনিকোতে আড্ডা দিতে। তখন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ (১৯৬৭)-এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; কোন কবিতা রাখবেন, কোনটা রাখবেন না- এ নিয়ে ভুগছিলেন চরম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। ফাঁকে ফাঁকে নতুন কবিতাও লিখছিলেন একটি, দু’টি। শেষ পর্যন্ত প্রকাশকের চাপে পাণ্ডুলিপি জমা দেন তিনি অনেক দেরি করে।

 

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকর্মীদের আগুনে ঢাকা হোটেল ভস্মীভূত হলে শহীদ স্থায়ী হন রেকস-এর আড্ডায়। ওই সময় তিনি যোগ দেন সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা নভোস্তি নিউজ এজেন্সি (এপিএন)-তে; টেলিগ্রাফ এজেন্সি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন (তাস)-এর জন্যও সম্ভবত কাজ করেছেন পাশাপাশি। এর কিছু দিন পর ফরহাদ মজহারের সৌজন্যে তার স্ত্রী সাকী’র বান্ধবী পিয়ারি’র সঙ্গে বিয়ে হয়ে শহীদের। ফলে তার সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছরের নিয়মিত আড্ডার অবসান ঘটে আমাদের।

 

আবার তার সঙ্গে নিয়মিত আড্ডায় যুক্ত হই ১৯৭৬-৭৮ সালে। তখন তার স্ত্রী জার্মানিতে, পুত্র লোবিদকে নিয়ে তিনি থাকেন পুরানা পল্টনে শ্বশুরবাড়ি। লোয়ার ব্যাক পেইন-এলবিপিতে আক্রান্ত হয়ে শহীদ কাদরীর তখন প্রায় হাঁটাচলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এরপর শহীদের সঙ্গে ক’দিনের জন্য দেখা ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে। তখন বিটিভিতে ‘তাৎক্ষণিক’ নামে এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান রচনা ও পরিচালনায় যুক্ত আমি। ওই অনুষ্ঠানের জন্য তার সাক্ষাৎকার নিতে অনেক খুঁজে তাকে বের করি বাংলা মটরের এক আত্মীয়ের বাসায়। সেই শেষ। এরপর গত ৩৭ বছরে কোনো যোগাযোগ ঘটেনি তার সঙ্গে আমার। যোগাযোগ না থাক, স্মৃতিগুলো তো মুছবার নয়। তার সঙ্গে ষাট-সত্তর দশকের অনেক স্মৃতি আমার। সে সব নিয়ে কখনও লিখতে পারবো কি না, লেখা উচিত হবে কি না- ঠিক বলতে পারছি না এই মুহূর্তে।

 

ফকির ইলিয়াস : কবি শহীদ কাদরীর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯০ সালে। তখন তিনি বোস্টনে থাকতেন। নিউ ইয়র্কে তাকে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে এনেছিলাম আমরা। তখন তিনি সাহিত্যবিমুখ। বলতেন, আরে কবিতা দিয়ে কি হবে! কিন্তু আমাদের, মানে তরুণদের চাওয়া ছিল, তিনি কবিতায় ফিরে আসুন। আমার জানামতে, আমিই একমাত্র তরুণ কাব্যকর্মী যার ৫০তম জন্মদিন পালন উপলক্ষে তিনি নিজ হাতে লিখে আমাকে উইশ করেছিলেন।

 

২০০৬ সালে তিনি বাড়ি বদল করে নিউ ইয়র্কে স্থায়ী হন। এরপর তার নেতৃত্বে আমরা ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’ নামে একটি ত্রৈমাসিক অনুষ্ঠান শুরু করি। যা প্রায় ৫ বছর ধরে চলছিল। ওই অনুষ্ঠানে তিনি সেরা বাংলা কবিতাগুলো পড়াতেন। আবৃত্তি করাতেন অনেক তরুণের কবিতা। অনুষ্ঠানটির প্রেস এন্ড মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। কবির প্রয়াণে আমি খুবই বিপর্যস্ত। তাকে নিয়ে কয়েকটি গদ্য লিখছি আমি।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/তারা