ক্ষেতের কাজ না থাকলে নিজের ঘর-সংসারের উপরে সরকারি বাঁধ-রাস্তাটায় শুয়ে-বসে অলস সময় কাটায় মোমিন। তার মোবাইল ফোনটায় কিছু ভাটিয়ালি গান লোড করা আছে। সেই গান শুনে বেকারত্বের কষ্ট ভোলে, মনটাও চাঙ্গা থাকে। কিন্তু আজ গান শোনার সুখ তছনছ করতে ছাগলটা নিয়ে মাথার কাছে এসে দাঁড়ায় ঝগড়ি বউ।
দিনকাল যত খারাপই থাক, সংসারে কাজের বিরাম নেই ঝগড়ি মালেকার। পেটের দুই বাচ্চা ছাড়াও পোষা একটা ছাগল, পাঁচটা হাঁস ও বাচ্চাসহ দুটি মুরগি আছে। এগুলির সেবাযত্ন ছাড়াও রোজ চুলা জ্বালানো ও রান্নাবাড়ির ধকল, তার উপর ধান ও আলুর সিজনে স্বামীর সঙ্গে ক্ষেতে কামলাও খাটে। স্বামীর বেকার বসে থাকাটা তাই সহ্য হয় না মালেকার। স্ত্রীকে দেখেই গান বন্ধ করে মোমিন ছাগলটাকে ঘাসপাতা খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। দে মোকে, তোর ছাগলকে আইজ মজলিসি খাওয়া খাওয়ায় আনিম। খুশি হওয়ার বদলে মালেকার কণ্ঠের তেজ বাড়ে। আলসিয়া মরদ, ছাগল চরানো কি তোর কাম! মাছের রাজা তুই, যা নদীতে মাছ ধরতে। মাছ ধরতে যাওয়ার কঠোর আদেশটির কারণও সে ঝগড়ার সুরে ব্যাখ্যা করে। কয়েক বছর বিদেশে থেকে মেলা টাকার মানুষ হয়ে সম্প্রতি গ্রামে ফিরেছে বসির। নদীর দেশি মাছ খাওয়ার শখ হয়েছে প্রবাসী বসিরের। মালেকা তার কাছে মাছের আগাম দামও কিছু আদায় করেছে, অতএব এখনই জাল নিয়ে নদীতে যাক মোমিন।
মাছের নেশা বা আশায় একটুও উজ্জীবিত হতে পারে না মোমিন। বরং মরা নদীর মুখখানা মনে করে নিজের মুখও ম্লান দেখায়। তারপরও ঝগড়ি বউয়ের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য উঠে দাঁড়ায় সে। বাঁধের নিচে ঘরে গিয়ে পেলা জালখানা কাঁধে নেয়, মাছ পাবে না জেনেও খালইটাও ঝুলিয়ে নেয় জালের বাঁশে, তারপর নদীর দিকে একা হাঁটতে থাকে। মাছ ধরার কথা বলতে হয় না মোমিনকে। বর্ষা মওসুমে কাজ যখন বন্ধ থাকে, মাছের সন্ধানে পানিতে ঘুরে বেড়ায় দিনেরাতে। বান-বর্ষায় বাঁধের নয়ানজুলির ঘেরা মৎস্যখামার-ক্ষেত-প্রান্তর পানি উছলে নদীর সাথে একাকার হয়ে যায়। বাঁধের এপার-ওপার দুই পারের ক্ষেতি জমির সীমানা-আইল তলিয়ে যায় পানির নিচে, জলমগ্ন গ্রামটাকে মনে হয় নিজের রাজ্যপাঠ। আল্লার দেয়া প্রাকৃতিক পানির সব মাছই তার প্রজাতুল্য। যারা তাকে মাছের রাজা বলে ঠাট্টা করে, বান-বর্ষার সিজনে ঠাট্টাটাকেও সত্যি ভাবতে পারে মোমিন। কারণ খলবল করে পানি ভেঙে, কখনও-বা ভেলায় চেপে কি সাঁতার কেটে যেখানে খুশি সেখানেই, এমন কি শত্রুর জলে ডোবা ক্ষেতে নেমেও মাছ ধরতে পারে মোমিন।
ক্ষেতের কামের জন্য যেমন কাস্তে-নিড়ানী-কোদাল, তেমনি মাছ শিকারের জন্য তার ছিপবড়শি ছাড়াও দুই রকমের জাল আছে। এই জাল দিয়ে গত বর্ষায় মোমিন যত মাছ ধরেছে, তেমনটি পেরেছে আর ক’জন? নিয়মিত খাওয়ার পরও বাঁধের বাজারে মোট বার শ টাকার মাছ বেচেছে মোমিন। জবরদস্তি করে ঠকিয়েছে অধিকাংশ ক্রেতা। ন্যায্য দাম পেলে মাছের উপার্জন দুই হাজার ছাড়িয়ে যেত অবশ্যই। মাছ শিকারে দক্ষতার জন্য মোমিনকে মাছুয়া-মাঝি কি মাছের রাজা বলে লোকে প্রশংসা, নিন্দা কিংবা হিংসা যাই করুক, মোমিনের মাছের নেশা তাতে বাড়ে বই কমে না। কিন্তু এখন খটখটে শুকনা মৌসুম। নিম্নভূমিতে বর্ষার সঞ্চিত পানি শুকিয়ে গেছে, আকাশেও নেই মেঘের চিহ্ন। ইরি ধান ক্ষেতের পানি পিপাসা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে চাষীরা। কতো যে শ্যালো মেশিন দিনেরাতে ধকধক করে মাটির তল থেকে পানি টেনে তুলছে। চরের আলু ও বাদাম ক্ষেতেও পানি সেচ দেয়ার জন্য শ্যালো মেশিন চালাচ্ছে মানুষ। গত বর্ষাতেও তিস্তায় পানি উছলে বাঁধ রাস্তা তথা মোমিনদের ঘরের দাওয়ায় ঠোকর দেয়। সেই বর্ষার পানি নদীর সোঁতা টেনে নিয়ে ভাটিতে চালান দিয়েও যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও বিস্তৃত বালুচর দ্রুত শুষে নিয়েছে। বাঁধের নিচের নয়ানজুলিও শুকিয়ে গেছে এবার। গভীর যেসব খাল-বিল ও পুকুরে পানি আছে এখনও, সেগুলি হয়ে উঠেছে মানুষের ব্যক্তিগত কিংবা সমিতিভুক্ত মৎস্যখামার। এ অবস্থায় একমাত্র নিজস্ব মৎস্যখামার ও সম্পত্তি হয়ে উঠতে পারে নদীটাই। মাছের জন্য দু’চার মাইল পথ ভাঙা মোমিনের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। নদীর সঙ্গে আজন্ম ঘনিষ্ঠতার কারণে দিনমান নদীতে গা ভাসিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মাছ কোথায়?
বাঁধের নিচের শুকনো খাল ও চাষাবাদের প্রান্তর পেরুলে তিস্তার পুরনো বড় সোঁতা। ল্যাংটা বুড়ির মতো কাপড় খুলে শুয়ে আছে যেন, খিদেয় চওড়া পেটের গর্তের বালু। শুকনো সোঁতা পেরুলেও ধুধু বালুচর। বর্ষা মৌসুমে সব সোঁতাই মূল নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হলে চর কোথাও বা দীপের মতো জেগে থাকে, কোথাও বা নদীর বুক দু’এক মাইল চওড়া হয়ে যায়। বড় পাগল আর রাক্ষুসে নদী এই তিস্তা। জমির ক্ষুধা তার যে কোনো জমিদারের চেয়েও বেশি। বাঁধের রাস্তার কাছেই ছিল একদা তার প্রমত্ত শরীর। তারপর কী মনে করে বিপরীত দিকের পাড় ভাঙতে ভাঙতে পশ্চিমে সরে যেতে শুরু করেছে। পশ্চিমে সরে গিয়ে দক্ষিণের সাগর পানে সারা বছর দুরন্ত বেগে ছুটতে থাকলে কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্তু প্রতি বছরই যখন উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামে, তিস্তা তার পুরনো চ্যানেলগুলিতেও দখলি সত্ত্ব বজায় রাখতে তীব্র স্রোতে পাঠিয়ে দিয়ে শিরা-উপশিরার মতো কতো যে সোঁতার সৃষ্টি করে। শুকনো মৌসুমে বালুচর হয়ে উঠতে থাকে তিস্তার এসব শাখা-প্রশাখা। কিছুদিন আগেও বুড়ি সোঁতার পরের গভীর সোঁতাটিতে মাছ ধরতে এসেছিল মোমিন। এখন সোঁতা স্রোতবিহীন। সোঁতার পাড়ে টনি জালের কাঠামো, লম্বা বাঁশে বাঁধা চারটা বাঁকানো কঞ্চি কঙ্কালের মতো ঝুলে আছে, টনি থেকে জাল খুলে নিয়েছে মাছুয়ারা। কারণ সোঁতার তিরতিরে অল্পপানির নিচে শুধুই বালু, মূল নদীর স্রোতে ও মাছের আনাগোনা বন্ধ হয়েছে এবারের মতো।
হাঁটু পানির বড় সোঁতাটি পেরিয়ে বেশ খানিকটা বালুচর ভেঙে সামনে এগোয় মোমিন। ভেজা বালুচরে এক জোড়া মাছরাঙা আর একটি সাদা বক মাছ খুঁজছিল বোধহয়। মোমিনের উপস্থিতি টের পেয়ে এক সঙ্গে উড়াল দেয় তারা। ভেজা বালুর উপর পায়ের ছাপ ফেলে হাঁটার সময়, ধু-ধু চরের বুকেও নিজের হারানো বাড়িভিটা ও গ্রামের সবুজ রেখাটি যেন দেখতে পায় মোমিন। বাঁধের রাস্তায় আশ্রিত চরুয়া ভাটিয়া ছেলেটিরও যে আনন্দময় অতীত ছিল, ধুধু বালুচরে দিগ্বিদিক হাঁটতে গিয়ে মনে পড়ে মোমিনের। শৈশবে-কৈশোরে গরমের দিনে নদীতেই কাটত অনেকটা সময়। পাড়ার হিন্দু জালুয়া মাঝিদের সঙ্গে একাকার একাত্ম হয়ে মাছ ধরত ছোটবেলা থেকেই। মাছ ধরা ছাড়াও খেলার জায়গা ছিল নদী এবং নদীর পাড়। শুকনো মৌসুমে নদীর ভেজা বালুতে আঁকিবুঁকি দিয়ে কতো কী এঁকেছে। একবার মানুষের ছবি আঁকতে গিয়ে তার নিতম্বখানা হাতির মতো বিশাল করেছিল মোমিন। তাই দেখে কী হাসাহাসি করেছে সবাই। নরম ও ভেজা বালুর আরাম এবং শুকনো বালুর সুড়সুড়ি খেয়েই পৌরুষ জাগ্রত হতো চরের ছেলেদের। শরীরের বালু ঝেড়ে ফেলতে নদীর পানিতে ধুপধুপ করে লাফিয়ে নামত সবাই।
কিন্তু কোথায় হারাল আজ মোমিনের সেই চেনা নদী? এতক্ষণে তো তার মূল তিস্তায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। নাকি সোঁতা মনে করে আজ হাঁটু পানির সোঁতা পেরিয়ে এল, সেটাই এখন মূল নদী? ধুধু বালুচরে কোথায় মুখ লুকাল সে? চারদিকে তাকিয়ে মোমিন পরিচিত নদী খুঁজে পায় না আজ। অন্তহীন এক মরুভূমির মাঝে একা দাঁড়ানো সে। অনেক দূরের ডাঙা ও জনবসতির সবুজ রেখা দেখেও কোনো পরিচিত গ্রাম নির্দিষ্ট করতে পারে না। দুপুরের বেলার দিকে তাকিয়েও পুব পশ্চিম ঠাহর হয় না আজ। আনমনে বালুচর ভেঙে দিকভ্রান্ত মোমিনকে বটগাছের আশ্রিত জিন কি বাতাসের বেগে মোমিনকে অচেনা কোনো মরুভূমিতে পৌঁছে দিয়ে গেল? চরের এ জায়গাটায় বালুর পরিমাণ এত বেশি, হাঁটতে গেলে বালুতে পায়ের পাতা ডুবে যায়। কাঁধের পেলা জালখানা বালুতে নামিয়ে, জালের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মোমিন পরিচিত নিশানা খোঁজে। মরা নদী ও তার সকল শিরা-উপশিরা বালুতে ঢেকে গেছে। অন্তহীন বালুচরে মাথার উপরে আকাশটাও যেন ছাতার মতো নিচে নেমে আসছে মোমিনকে চেপে ধরতে। চারদিকে জনপ্রাণী না দেখে ভয় জাগানো একাকিত্ব বোধ বুকের ভিতরে শিরশির করে জেগে উঠতে থাকে মোমিনের। নদীর এমন ভয়ঙ্কর কঙ্কাল চেহারা আগে দেখেনি কখনো, এমন ভীতিও অনুভব করেনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে চেঁচিয়ে আল্লাকে ডেকে নিজেকেই নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।
প্রতি বছর বেশি রোজগারের আশায় গাঁয়ের অন্যান্য বেকার কামলাদের মতো চট্রগ্রাম কি সিলেট জেলায় কাজ করতে যায় মোমিনও। বউ-বাচ্চা ছেড়ে বিদেশে থাকার একাকিত্ব, আর ধু-ধু নির্জন চরের বুক কাঁপানো একাকিত্ব ঠিক এক নয়। নদী খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট আর মাছ শিকারের ব্যর্থতা নিয়ে ঘরে ফিরলে ঝগড়ি বউ রাতে সত্যই তাকে খেতে দেবে না নির্ঘাৎ। বিদেশে দু’এক মাস একা থাকার পর যখন হাজার তিন-চার টাকা নিয়ে মোমিন ঘরে ফেরে, বউ-বাচ্চাদের কাছে তার কদর বাড়ে, সংসারে সুখও বাড়ে। গতবার স্বামীর বিদেশ-খাটা রোজগার থেকে দুই হাজার টাকা বাপকে করজ দিয়েছে মালেকা। শ্বশুর সেই টাকাটা শোধ করলে রোজগারশূন্য বর্তমানে ভাতের চিন্তা করতে হতো না মোমিনকে, এবারের বিদেশ যাত্রায় গাড়িভাড়ার টাকার জন্য হাত পাততে হবে না বউয়ের কাছে। হারানো নদী খুঁজে পাওয়ার কষ্টের মধ্যে নিজের হারানো টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা বুকে খানিকটা বল যোগায়। বালুতে ডোবা পা টেনে টেনে এগুতে থাকে মোমিন।
অনেকটা সময় মরা নদীর কঙ্কাল ভেঙে, বিকেল বেলা শুকনো জাল ও শূন্য খালই নিয়ে ঘরে ফেরে মোমিন। মাছ না পাওয়ায় ঝগড়ি বউয়ের গোলাবারুদ হজম করার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু ঘরে ওঠার আগেই তার হাসির আওয়াজ শোনার কথা স্বপ্নেও ভাবে নাই। একা নয়, কথা শুনে ঘরের মেহমানকে শনাক্ত করে বিস্ময় বাড়ে মোমিনের। বাঁধের ভূমিহীন মানুষের বসতির ঘরে এসেছে ইটালি-বসির, এ গাঁয়ের সবচেয়ে আলোচিত মানুষ। যাকে দেখতে ও যার কথা বথা শুনতে ডাকাতের দোকানে ভিড় হয় রোজ। বসিরও দূরে বসে ইটালি বসিরের গল্প শুনেছে কয়েকবার। স্ত্রীর কাছেও শুনেছে তার মেলা গল্প। পড়শি সুবাদে সে মালেকার পূর্ব পরিচিত এবং ভাই হতে পারে, কিন্তু এমন দামিনামি বিদেশি সম্বন্ধী মোমিনের ঘরে আসে কেন? দরকারই-বা কী? ঘরে ঠিক নয়, ঘরের দাওয়ায় উঁচু পিড়িতে বসতে দিয়ে মেহমানের সঙ্গে গল্প করছিল মালেকা। বসির ভাইয়ের কী কথা! মোর মতো সোন্দর পাত্রী খোঁজেন! ঝগড়ি বলিয়া গ্রামের মানুষ মোর কতো বদনাম করে। ডাকাইতের বেটি দুলালিও মোর চাইতে উপেগুণে টসটসা, তাকেই বিয়া করি বিদেশ নিয়া যান তো। মোমিন দেখেও অতিথিকে না-দেখার ভান করে জালখানা ঘরের বেড়ায় রাখে। বসির জানতে চায়, কী রে মাছ পাইস নাই? নদী নাই তো মাছ আইসে কোণ্ঠে থাকিয়া? মাছ না পাওয়ার ব্যর্থতা ঢাকতে মোমিন ছেলেকে খোঁজে, টুকু গেল কই? দোকান থাকিয়া চা-বিস্কুট আনিয়া দিলেও হয়।
ছেলেকে খোঁজার কথা বলে মোমিন আবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাঁধের রাস্তায় উঠে, মেহেমানদারি করার দায়ে ডাকাতের দোকানে যাওয়ার গরজ একটুও বোধ করে না সে। নিজের পেটের খিদের কথা ভেবেই হয়তো স্ত্রীকে ডাকাতের দোকানের চা-বিস্কুট আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু স্বামীর খিদে মেটানোর জন্য ভাতের ব্যবস্থা করার বদলে অবাঞ্ছিত মেহমানকে নিয়ে বউয়ের হাসি-ঠাট্টার ঘটকালি মোমিনের মতো ঠাণ্ডা মানুষের মেজাজটাও বড় খিচড়ে দেয়। পকেটে নগদ টাকা থাকলেও পাকা রাস্তার দোকানে সদাই কিনতে কিংবা চা খেতে যায় না সে। আজ মেহমানের জন্য বাকিতে চা আনার কথা ভাবতেও পারে না। যার জন্য চা-পান আনবে, ঘরে তার উপস্থিতির খবর জানলেও হয়তো লোকে নানা কথা বলবে। এমনিতেই ঝগড়ি বউয়ের চরিত্র নিয়েও আকার-ইঙ্গিতে মেলা কথা শুনতে হয় মোমিনকে। কামে গিয়ে প্রতি বছর যখন দুই-তিন মাসের জন্য বাড়ি ছাড়া থাকে, স্বামীশূন্য সংসার ঝগড়ি মালেকার স্বাধীনতা বাড়ায়। মহির মেম্বার বাঁধের বস্তিতে বেড়াতে আসলে মালেকার ঘরেই বসে প্রথম। মহির মেম্বার ছাড়াও বাপের বাড়ির গাঁয়ের লোকজনকে মালেকা যে খাতির-সম্মান দেখায়, তার মূলে নিজের সংসার সচল রাখার ধান্ধাটাই কাজ করে সন্দেহ নাই। কিন্তু ঝগড়ি বউয়ের চরিত্র নিয়েও লোকজন আকথা কুকথা বলে কেন? নিন্দুকদের মনের হিংসা বোঝে বলেই বউয়ের বদনামি কানে তোলে না মোমিন। কিন্তু আজ বিদেশখাটা বসিরকে ঘরে দেখে বুক চিনচিন করে কেন?
বাঁধের নির্জনতায় একা বসে থাকে মোমিন। ঘরের অশান্তির কথা ভাবতে গিয়ে পেটের খিদেটাও চড়বড় করে বাড়তে থাকে। মোবাইলটাও সঙ্গে নাই যে, গান কি ওয়াজ শুনে মন শান্ত রাখবে। অগত্যা মেহমানকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর মতো মেজাজ নিয়ে সন্ধ্যার মুখে ঘরে ফেরে মোমিন। মেহমান তখন চলে গেছে। মালেকা চুলা জ্বালায়নি এখনো, যথারীতি তার ছাগল-হাস-মুরগির তত্ত্বতালাশ নিয়ে ব্যস্ত। ঝগড়ি মেজাজও ফিরে পেয়েছে। বসির ভাইয়ের জন্য চা-বিস্কুট আনার কথা কয়া ইঁদুরটা কোন গর্ত্তে গিয়া সোন্দায় আছিল? খিদায় পেট জ্বলে মোর, তোর নাঙের জন্য চা-বিস্কুট কেনার জন্য টাকা পামু কই হারামজাদি? নিচেটু মরদ হামার। এত বড় দুনিয়ায় কামাইরুজির পথ পায় না! সারাটা দিন জাল নিয়া নদীতে কাটায় আসিল, একটা বালিয়া মাছও পায় নাই। বসির ভাইকে বড় গলায় কথা দিছিনু নদীর মাছ খাওয়াইম। আইজ কী ব্যভারটা করিল তার সাথে! ভাতের বদলে বউয়ের গু খাইয়া থাকিস ভাটিয়ার বাচ্চা। স্বামীর কামাই নাই দেইখা বিদেশি কামাইরুজির ভাগ বসাইতে আইজ ফোরটুয়েন্টি বসিরকেও ঘরে আনছিলি। আর আমার বিদেশ খাটা টাকা তোর বাপকে ধার দিলি, হউরের পো হউর সেই টাকা শোধ করে না ক্যা রে? শোধ না করার কারণ শুনবু? শোন তবে, বিয়ার আগে তোর গপ্পু নানায় কইছিল ...
ঝগড়া করে বউকে পরাস্ত করবে, এমন আশা রাগের মাথাতেও করতে পারে না মোমিন। কিন্তু আজ লেলিহান রাগ-ক্ষোভ নিজের নিয়ন্ত্রণেও রাখতে পারে না আর। উপযুক্ত কথার অবলম্বন না পেয়ে বেড়ায় রাখা জালাখানা হাতে তুলে নেয়। সেই জাল দিয়ে জুতমতো ঝগড়িকে পেটাতে না পেরে, ঝগড়াসহ বউকে আজ জাল দিয়েই চেপে ধরে সর্বশক্তিতে।
ছোট মাছও যে জাল থেকে এক লাফে বেরিয়ে যায়, সেই জাল দিয়ে ঝগড়ি মালেকার মতো দজ্জাল বউকে আটকে রাখা কি সহজ কাজ? মালেকা এক ঝটকাতেই জালমুক্ত হয়। তখন জালের ডান্ডা দিয়েও বউকে পেটায় মোমেন। বেকায়দায় এক বাড়ি খেয়েই কোমর বেঁকিয়ে মাটিতে বসে পড়ে মালেকা। তখন জাল ছুড়ে দিয়ে চুলার পাড় থেকে বাঁশের চোংটা কুড়িয়ে নেয়। বউয়ের আগুন জ্বালানো চোং দিয়ে বউকেই আজ জুতমতো পেটাতে থাকে মোমিন, পেটানোর কারণটাও সংক্ষেপে ব্যক্ত করে, তোর রাঁধা ভাত খাইতাম না আমি। আমার রুজির টাকা তোর বাপের কাছ থিকা লইয়া আয় অক্ষুনি।
স্বামীর প্রহার খেতে অভ্যস্ত নয় মালেকা। আশ্চর্য যে, আজ মার খেয়েও তার ঝগড়ি মেজাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে না আগের মতো। উল্টো মারের যন্ত্রণায় কোঁকায় সে। কান্না নিয়ে আহত শরীর টেনে ঘরে ঢোকে মালেকা। তারপর লুকিয়ে রাখা কিছু টাকা ঘরের দাওয়ায় ছুড়ে দিয়ে কান্নাকাতর কণ্ঠে ঘোষণা দেয়, যা, টাকা নিয়া তফাত যা, তোর ভাত আর না খাইম মুই।
স্বামীর ভাত না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা এবং ঘর ভাঙার দুঃখ পাড়াপড়শিকে শোনাতে মালেকা এবার ঘরের দাওয়ায় বসে গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার ভাষা ক্রমে ঝগড়া হয়ে ওঠার আগে, টাকাটা কুড়িয়ে নেয় মোমিন। ঘরে ঢুকে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে গামছায় বাঁধে ঝটপট, লুকিয়ে রাখা মোবাইলটাও বের করে কোমরে গোঁজে। ছেলেমেয়েরা ঘরে ফেরার আগেই চুপচাপ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
পাকা রাস্তার মোড়ে ভটভটি গাড়িতে উঠে বসলে গন্তব্য জানতে চায় পরিচিত একজন। জবাব দেয় না মোমিন। যে নদী একদা তার ভিটেমাটি গিলে খেয়েছে, শুকনো মৌসুমে নিজেই সে মরে গিয়ে মোমিনের মাছুয়া পেশাও অচল করেছে। এখন ঝগড়ি বউয়ের কারণে যদি সরকারি জায়গার অস্থায়ী ঘরসংসারও ভেঙে যায়, আল্লার এত বড় দুনিয়ায় যাওয়ার কিংবা থাকার মতো জায়গার অভাব হবে তার? নিজেকে শোনানো এ সান্ত্বনা-বাণী নিজেও ভাল মতো শুনতে পায় না মোমিন, কারণ বিকট আওয়াজ আর ধোঁয়া ছেড়ে ভটভটি গাড়িখানা তখন চলতে শুরু করেছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৬/তারা