শিল্প ও সাহিত্য

রজনীগন্ধাপুর : চতুর্থ পর্ব

গাড়িতে আজ আমি আর অপু পাশাপাশি বসেছি। মিলিয়া আর মিতুয়া পিছনের সিটে। গাড়ি ছুটছে। আমি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে নিয়েছি। ওই তো সুগার ফ্রি তিন-চারটা বিস্কুট। তাতে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকবে। স্পটে পৌঁছে নাশতা করতে হবে। নাশতার আগে আমার ওষুধ আছে, তখনই খাবো। কোনও কোনও গতি মানুষকে স্মৃতির দিকে ঠেলে নেয়। আজ সকালে জামির গাড়ি আমাকে অবিরাম পেছন দিকে নিচ্ছিল। জীবনের পেছন দিক। ফেলে আসা জীবন। কতবার গাড়ি করে এইভাবে আমি, মায়া আর দিপু ঢাকার বাইরে গেছি। প্রথমে যেতাম চিটাগং, সেখানে একদিন কাটিয়ে কক্সবাজার। একবার কক্সবাজার থেকে গেলাম টেকনাফ। নাফ নদীর তীরে সুন্দর বাংলো। সেই বাংলোয় রাত কাটিয়ে সকালবেলা ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন। শীতকাল ছিল। সমুদ্র আপতদৃষ্টিতে পুকুরের মতো শান্ত। টেকনাফ আর সেন্টমার্টিনের মাঝ বরাবর এসে টের পেলাম সমুদ্রের প্রকৃত হাওয়া, কিছুটা ঢেউ। ট্রলারঅলা বলল, এটা কোনও ঢেউই না। সমুদ্রের ঢেউ হয় বর্ষাকালে, ঝড়বৃষ্টিতে। ওই অবস্থা আপনারা ভাবতেই পারবেন না। মায়া খুবই ভয় পাচ্ছিল। ভয় কিছুটা আমারও আছে। আমরা লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছি। দেখি দিপু একদমই ভয় পাচ্ছে না। খুবই এনজয় করছে সমুদ্রের ঢেউ। বিকেলবেলা ফেরার সময় ঢেউ কিছুটা বেড়েছে। কাগজের নৌকার মতো দুলছে ট্রলার। তাও দিপু ভয় পায় না। মজা পায়। সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওই অতগুলো সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে ভাঙল দিপু। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, কী দারুণ। এখান থেকে লাফ দিয়ে পড়লে কেমন হবে বাবা? মহেশখালিতে আদিনাথের মন্দির। মুসলমানরা মন্দিরের ভেতর ঢুকতে পারে না। দিপু ঢুকবেই। ওই বয়সেই পূজারির সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিল। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। কেন ঢুকতে দেবেন না? যেটুকু সাঁতার শিখেছে, ওই নিয়ে সমুদ্রে বেশিদূর যাওয়া যায় না। তাও বারো তেরো বছরের ছেলে। দিপু একবার অনেকটা দূর চলে গিয়েছিল। শ্রীমঙ্গলে গিয়ে চা বাগানে হারিয়ে গেল একবার। কোথায়, কোন ঝোঁপের আড়ালে যে গেল, আমরা খুঁজেই পাই না। জাফলং যাওয়ার কথা। সিলেটে গিয়ে হোটেলে উঠেছি। বর্ষাকাল। এমন বৃষ্টি সকাল থেকে। গাড়ি বসে আছে। মায়া বলল, এই অবস্থায় যাওয়া ঠিক হবে না। আমারও সেই মত। কিন্তু দিপু যাবেই। আমি তো ছেলে লাই দেওয়া বাপ। ওই বৃষ্টিতেই রওনা দিলাম। মায়া খুবই বিরক্ত। তখন বৃষ্টি আরও বেড়েছে। এমন অবস্থা, দশহাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। দিপু এই বৃষ্টি দেখেই মুগ্ধ। এমন বৃষ্টি ঢাকায় দেখা যেত, বলো বাবা? জাফলং দেখা হোক না হোক, এই বৃষ্টিটা তো দেখা হলো? জামির গাড়ি ছুটছে। আজ আবার আমার মনে হলো, দিপুকে একটু শাসন করা দরকার ছিল। তাহলে হয়তো... জামি ফোনে কথা বলছিল। দুতিনবারই নিজেদের অবস্থানের কথা জানালো। বুঝলাম, যে ভদ্রলোকের ওখানে যাচ্ছি তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। পেছনের সিটে মিতুয়ার কানে ইয়ার ফোন, কোলের ওপর আই ফোন। বুঝলাম মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে। মিলিয়াও তার ফোন টেপাটিপি করছে। সামনের সিটে জামিও করছে একই কাণ্ড। দুজনে কি এসএমএস চালাচালি করছে? অপু আছে তার গেইমস নিয়ে। কদিন আগে দর্পণ ওকে একটা ‘জি এফ’ না কী যেন বলে ওই জিনিস কিনে দিয়েছে। আমার পাশে বসে অবিরাম ওতে গেমস খেলছে। অর্থাৎ সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। সঙ্গে থাকা বাতিল মানুষটি, আমি চলে যাচ্ছি স্মৃতির জগতে। টঙ্গী ব্রিজের কাছে এসে জামির গাড়ির চেয়েও দামি কালো রংয়ের একটা জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জামি ফোনে কথা বলল। আমাদের গাড়ি ওই গাড়ি ফলো করতে লাগল। বুঝলাম এটা ওই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের গাড়ি। দশটার মধ্যে স্পটে পৌঁছে গেলাম আমরা। মেইন রোড থেকে অনেক ভেতরে। তবে রাস্তা ভালো। গাড়ি এল অনায়াসে। গাছপালা ঘেরা একটা মাটির রাস্তায় গাড়ি থামলো। দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। প্রথমে ওই ভদ্রলোক নামলেন, তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়ে নামলো। দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটো সালাম দিয়ে বিনয়ে একেবারে ভেঙে পড়ছে। বুঝলাম এই দুজনেই জায়গার কেয়ারটেকার। বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে। আমরাও ততোক্ষণে নেমে গেছি। জামি আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ভদ্রলোক বিনয়ী ধরনের। একটু বেটে মতো। ছোটখাটো শরীর। ঝিমকালো গায়ের রং। চেহারা ভালই। মুখটা হাসি হাসি। নাম শওকত হোসেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী বেশ সুন্দরী। লম্বায় শওকত সাহেবের চেয়ে ইঞ্চিখানেক বেশি। সুন্দর ফিগার। ফর্সা কাটা কাটা চেহারা। হাসি খুব সুন্দর। তার নাম লিনা। ভদ্রলোকের মেয়েটি ছোট। অপুর বয়সি। সে মায়ের রূপটা পায়নি। পেয়েছে বাবার চেহারা, গায়ের রং। বয়স অপুর মতো। কিন্তু ছেলেটি ভারি সুন্দর। একুশ বাইশ বছর বয়স হবে। ছফিটের ওপর লম্বা। মায়ের মতো গায়ের রং, চেহারা। মাথার চুল খুব ঘন। মুখে দাড়িগোঁফ। একদম দেবদূতের মতো। এক কথায় তাকিয়ে থাকার মতো ছেলে। মেয়েটির নাম বৃষ্টি। ছেলেটির নাম অনন্য। মিতুয়াকে দেখছি অনন্যর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারছে না। অনন্যকে মনে হচ্ছে একটু লাজুক ধরনের। সে মিতুয়ার দিকে তেমন তাকাচ্ছে না।

 

গাছপালা ঘেরা একেবারে গ্রাম্য পথ দিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। তিন চার মিনিট পর একটা বাড়িতে ঢুকলাম। নতুন তিনটা মাটির ঘর পাশাপাশি। বারান্দা আছে প্রতিটা ঘরের। বারান্দায় প্লাস্টিকের সাদা চেয়ার পাতা, টেবিল পাতা। ঘরের সামনে সবুজ ঘাসের মাঠ আর গাছপালা। মাঠের ওপারে পাশাপাশি ওরকম মাটির চারটা ঘর, দুটো রান্নাচালা। ওইসব ঘর পুরনো। বোঝা গেল কেয়ারটেকারদের সংসার ওদিকে। তিনজন মহিলাকে দেখা গেল রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। দুজন মিলিয়াদের বয়সি, একটি মেয়ে অল্পবয়সি, যুবতী। চার পাঁচটা বিভিন্ন বয়সি বাচ্চাকাচ্চা দূর থেকে আমাদের দেখছে। কেউ কাছে আসছে না। মহিলাগুলোরও একই অবস্থা। দ্রুত হাতেই কাজটাজ তারা করছে। তবো মাথায় ঘোমটা। শুধু যুবতী মেয়েটার মাথায় ঘোমটা নেই। পুরুষ দুজনের সঙ্গে মিলেমিশে খাবার দাবার আনছিল। মেয়েটাকে আমি একটু লক্ষ করলাম। বোকা বোকা সরল নিরীহ ধরনের চেহারা। গায়ের রং কালো, শরীর স্বাস্থ্য ভালো। মুখে আশ্চর্য এক বিষণ্নতা। যেন খুব বড় কোনও কষ্ট বেদনা চেপে আছে তার মনে। দুজন লোকের একজনকে শওকত সাহেব বললেন, এই মেয়েটা তোমার শ্যালিকা না, হাসেম? হাসেম নামের লোকটি বলল, জি স্যার। ওর নাম হালিমা। আমার শ্বশুর শাশুড়ি কেউ নাই। একজন সমন্ধি আছে। গরিব মানুষ। বোনরে খাওয়াইতে পরাইতে পারে না, এজন্য হালিম আমগো কাছে থাকে। অন্য লোকটির নাম কদম। হাসেমের তুলনায় তার বয়স কম। বলল, হালিমা খুব ভালো মাইয়া সাহেব। খুব কাজের। আমগো লগে মিলামিশা সবকিছু দেইখা রাখে। শওকত সাহেব আর কথা বললেন না। নাশতা খুবই ভালো হলো আমাদের। বহুদিন পর, মানে বহু বহু বছর পর একদম বিক্রমপুরের মানুষদের বাড়িতে মান্যগন্য অতিথি এলে যে ধরনের নাশতা দেওয়া হয় সে রকম নাশতা। দেশি মুরগি ঝোল করে রান্না, ভূনাও আছে। আর ছিটরুটি, চিতই পিঠা। তারপর গরুর দুধের ঘন চা। শওকত সাহেব বললেন, আমার ক্ষেতের ধান থেকে ঢেকিতে ছেটে চাউল করা হয়েছে। সেই চাউলের সবকিছু। মুরগিও নিজেদের পালা। জামি বলল, তা বোঝা যাচ্ছে। আজকাল দেশি মুরগি জোগাড় করাই মুশকিল। বয়লার মুরগি আর পাকিস্তানি কক না কী বলে, বিচ্ছিরি জিনিস ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যায় না। অবশ্য তাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার গ্রামে সবই খাঁটি জিনিস। হাইব্রিড ইত্যাদি নেই। একেবারে পুরনো দিনের বাংলাদেশের গ্রাম। সব কিছুই তখনকার মতো। বাচ্চাকাচ্চারা যে এসব খাবার পছন্দ করবে না সেই চিন্তাও ছিল শওকত সাহেবের। তাদের জন্য ঢাকা থেকেই নাশতা নিয়ে আসা হয়েছে। ব্রেড বাটার জ্যাম জেলি, স্যান্ডউইচ। কর্ণফ্লেস্ক আনা হয়েছে। মিল্ক তো এখানেই আছে। ওরা ওদের মতো নাশতা, নাশতা না বলে বলা উচিত ব্রেক ফাস্ট, ওরা ব্রেক ফাস্ট করল। আমি আমার মতো খাওয়ার আগের ওষুধ পরের ওষুধ খেয়ে নিয়েছি। মিলিয়া বলল, বাবা, আপনি আপনার মতো ঘুরে বেড়ান। আমরাও যে যার মতো ঘুরেটুরে বেড়াবো। শওকত সাহেব বললেন, জি আংকেল। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন, পুরো গ্রামটাই বলতে গেলে আমার। জমি যতটা হয়েছে, তারচেয়ে তিনগুণ বায়না করে রেখেছি। তিনমাস পর পর রেজিস্ট্রি করছি। আপনি ঘুরে ঘুরে দেখুন সবকিছু। আমরা লাঞ্চ করবো দেড়টা দুটোর দিকে। এখানকার রান্নাবান্নাও খুব ভালো। হাসেম, কদম দুজনের বউই ভালো রান্না করে। আমি বিনীত গলায় বললাম, জি, তার প্রমাণ পেয়েছি। লিনা বলল, দুপুরের মেনু কী? সাদা ভাত শাক সবজি আর নানারকমের মাছ। বাচ্চারা কি ওসব পছন্দ করবে? ওদের জন্য পোলাও মুরগি করা হয়েছে। তাহলে ঠিক আছে। আমি উঠলাম। মিলিয়া বলল, দেড়টা দুটোর মধ্যে চলে আসবেন বাবা। ঠিক আছে মা, ঠিক আছে। জামি বলল, আমরা ফিরবো শেষ বিকেলে অর্থাৎ সন্ধ্যার মুখে মুখে। আপনি চাইলে লাঞ্চের পর রেস্টও নিতে পারবেন আংকেল। ঘরগুলো মাটির কিন্তু ভেতরের অবস্থা ভাল। আমি দেখেছি বাবা। দরকার হলে রেস্ট নেব। ঠিক আছে, ঠিক আছে। অপুর দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই যাবি নাকি আমার সঙ্গে? অপু কথা বলবার আগেই শওকত সাহেবের মেয়ে বৃষ্টি বলল, না না। অপু আর আমি একসঙ্গে ঘুরবো। তাহলে মিতুয়া নিশ্চয় অনন্যর সঙ্গ ধরবে। মিলিয়া ধরবে জামির সঙ্গ। শওকত সাহেব থাকবেন স্ত্রীর সঙ্গে। তার মানে যে যার সঙ্গী ঠিক করে নিয়েছে। শুধু আমি একা।(চলবে) রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জানুয়ারি ২০১৭/তারা