শিল্প ও সাহিত্য

ফজল শাহাবুদ্দীন: কবিতায় সমর্পিত কাব্যপুরুষ

হাসান মাহামুদ : কিছু মানুষ শুধু সৃষ্টি বা হাতেখড়ি করেন না, তা ছড়িয়ে দেন দিকে দিকে। বাংলা কবিতার স্বর্ণযুগ বলা চলে পঞ্চাশের দশককে। বাংলাদেশে কবিতা আন্দোলন এবং কবিতা চর্চার পুরোধা পঞ্চাশের কবিরা। তাদের একনিষ্ঠতার কারণে বাংলাদেশের কবিতা একান্তই আমাদের কবিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিশে যায়নি পশ্চিমবঙ্গের কবিতার সঙ্গে। এই সময়ে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল মাহমুদ যেখানে নিসর্গ ও লোকসন্ধানী, শামসুর রাহমান সশব্দ নগরপ্রেমিক কিংবা ফজল শাহাবুদ্দীন আধ্যাত্মিক ও নিমগ্নচারী চেতনায় ছিলেন সক্রিয় এবং স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। ষাটের দশকের প্রথম দিকেই কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পান তিনি। বাংলাদেশের কবিতা ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যে পঞ্চপাণ্ডব তার একজন ফজল শাহাবুদ্দীন। তবে এর মধ্যে ফজল শাহাবুদ্দীনের একটি বৈশিষ্ট্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে, তা হলো- তিনি সমসাময়িক কবিদের জন্য প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলেন, পরবর্তীতে বাংলাদেশী কবিতার অনুষ্ঠানকে বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম ও একমাত্র কবিতা পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’ প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন তিনি। প্রথম দিকে তার সঙ্গে এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। কবিতার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায় সৃষ্ট কবিতা পত্রিকাটি দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তা পায়। বাংলা কিংবা কলকাতা নয়, কবিকণ্ঠে সামিল হন বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালি লেখক-কবিরাও। তবে নানা কারণে এই কবিতা পত্রিকার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। যদিও পত্রিকাটি অনিয়মিতভাবে এখনো প্রকাশ হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এ পত্রিকাকে ঘিরেই বর্তমানে দেশে ও দেশের বাইরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বসন্তকালীন কবিতা উৎসব। উৎসবের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। উৎসবে এখনো সামিল হচ্ছেন দেশ-বিদেশের সংস্কৃতিমনারা। নব্বইয়ের দশকে ‘এশিয়া কবিতা উৎসব’ আয়োজনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল ফজল শাহাবুদ্দীনের। এই কবিতা উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও। সেই এশিয়া কবিতা উৎসবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিশীল কবিদের জাগরণে দেশে ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হয় ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’। কবি সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ এই উদ্যোগে অংশ নেন। সেই থেকে এখনো প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দুদিনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে জাতীয় কবিতা উৎসব। এইতো দুদিন আগেই হয়ে গেল উৎসবটি। যদিও উদ্যোক্তা কবিদের অধিকাংশই এখন আর নেই। তবে কবিদের মিলনমেলায় কোনো ঘাটতি হচ্ছে না। স্বাধীন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রচলনে ফজল শাহাবুদ্দীনে পথিকৃৎ। এক সময়ের সাড়া জাগানো সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। পেশাগত জীবনে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তেও কাজ করেছেন। তবে ‘দৈনিক বাংলার’ সহকারী সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রধান পরিচয় তিনি কবি, কবিতা এবং বিধাতার কাছে সমর্পিত এক কাব্যপুরুষ। অন্যান্য কবিদের মতো জনপ্রিয়তার দৌড়ে শামিল হতে চাননি তিনি এবং সে কারণেই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, প্রকাশকদের চেম্বারে অথবা বইমেলায় তাঁর উপস্থিতি কমই ছিল। মঞ্চের চেয়ে লেখার টেবিলটি বেশি ভালোবাসা ফজল শাহাবুদ্দীনের সরব উপস্থিতি এখনো শুধু তার কবিতায়। কবিতায় নিমগ্ন থেকে তিনি পার করেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তগুলো। বসন্তকালীন কবিতা উৎসবের মাধ্যমে বাংলা এবং বাংলা কবিতাকে দেশে এবং দেশের বাইরে জনপ্রিয় ও পরিচিত করার পাশাপাশি কবিতা এবং কবিদের একত্রিত করার প্রয়াস সবসময় তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। কাব্যগ্রন্থটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। সর্বশেষ কবিতার বই ‘একজন কবি একাকি’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭টি। কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- তৃষ্ণার অগ্নিতে একা (১৯৬৫), অকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর (১৯৬৬), আততায়ী সূর্যাস্ত (১৯৭৫), অন্তরীক্ষে অরণ্য (১৯৮০), সান্নিধ্যের আর্তনাদ (১৯৮৩), আলোহীন অন্ধকারহীন (১৯৮৪), সনেটগুচ্ছ, অবনিশ্বর দরোজায়, আমার নির্বাচিত কবিতা, হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ, লংফেলোর নির্বাচিত কবিতা, দিকচিহ্নহীন, ছিন্নভিন্ন কয়েকজন, জখন জখম নাগমা, Selected Poems, Solitude, Towards the Earth বাতাসের কাছে, ছায়া ক্রমাগত, নিসর্গের সংলাপ, পৃথিবী আমার পৃথিবী, ক্রন্দনধ্বনি, ক্রমাগত হাহাকার, একজন কবি একাকি (২০১৩)। বরেণ্য এ কবি ১৯৩৬ সালের আজকের এই দিনে কুমিল্লা জেলার নবীনগর উপজেলাধীন নিজ বাড়ি শাহপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেওয়া এই কবি ফেব্রুয়ারিতেই মৃত্যুবরণ করেন। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হাসান/তারা