শিল্প ও সাহিত্য

এসো হে বৈশাখ || আহসান হাবীব

সেদিন আমার এক পুরোনো বন্ধু এলো আমার কাছে। বলল, তোর সাথে জরুরি কথা আছে।

বলে ফেল।

কথাটা বৈশাখ নিয়ে, পয়লা বৈশাখ। তো! আমি সতর্ক চোখে তাকাই। সে যা বলল, তা হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে নাকি কোনো রহস্যময় কারণে তার পয়লা বৈশাখগুলোতে মোটেই আনন্দ হচ্ছে না। আনন্দ না হওয়ার কারণগুলো অদ্ভুত। যেমন একবার পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেতে গিয়ে গলায় ইলিশের কাঁটা ফুটে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে তাকে। আরেকবার রমনার বটমূলে গান শুনতে গিয়ে মানিব্যাগ হিপ পকেট থেকে পিক পকেট, পুরো মাসের বেতন হাওয়া, এবং শেষবার বৈশাখী মেলায় চরকিতে উঠে চক্কর খাওয়ার সময় চরকি ভেঙে তার কোমরের হাড়ে সিভিয়ার ফ্রাকচার, এখনো নাকি ভুগছে! আমার কাছে তুই ঠিক কি চাচ্ছিস? আমি জানতে চাই।

আমি চাই পয়লা বৈশাখে নির্ভেজাল আনন্দ। বন্ধুটি বলল।

তার মানে তুই হাসতে চাস?

হ্যাঁ চাই। তুই তো হাসিঠাট্টা বিষয়টা ভালোই বুঝিস। আমি বিশেষজ্ঞের মতো মাথা নাড়ি। তারপর বলি, সে ক্ষেত্রে তুই নিয়মিত চিনিচম্পা কলা খা ডেইলি দুটা করে, সকালে একটা রাতে একটা। আমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রেসক্রাইব করি। কি বলছিস! চিনিচম্পা কলা খেলে পয়লা বৈশাখে আনন্দ হবে? হাসি আসবে? অবশ্যই এখন থেকে নিয়মিত খেতে শুরু করলে দেখবি সামনের পয়লা বৈশাখে তোর মুখটা হাসি হাসি হয়ে উঠবে, তবে চিনিচম্পা খাবি আড়াআড়িভাবে একবারে। প্রিয় পাঠক, বন্ধুরা বন্ধুদের সাথে ঠাট্টা তামাশা করতেই পারে। কিন্তু আমার বন্ধুরা সব সময় সেটা গ্রহণ করতে পারে না। সে কারণে দ্রুতই আমার বন্ধু সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। যেমন আরেকটা উদাহরণ দিই, এটাও ওই বৈশাখ নিয়েই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা একবার ঠিক করল (কোনো এক) পয়লা বৈশাখে সবাই মিলে আনন্দ করা হবে। কোনো একটা দামি রেস্টুরেন্টে ব্যাপক খাওয়া দাওয়া হবে, সেই হোটেলে আবার বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশ নিয়ে নানা আয়োজন করেছে। বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই দেরাজ হাতে চাঁদা দিল। তারপর সেই পয়লা বৈশাখে সেই রেস্টুরেন্টে সবাই এক সাথে হলো। ছেলেদের কাউকে কাউকে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হলো। যেমন কেউ খাওয়া দাওয়া কী হবে, সেই দায়িত্বে। কেউ র‌্যাফল ড্রর গিফটের দায়িত্বে। কেউ জনসংযোগ...। আমার দায়িত্বে পড়ল ড্রাইভারদের খাওয়া দাওয়া তত্ত্বাবধান করা। মানে আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের গাড়িগুলোর ড্রাইভাররা ঠিকমতো খেতে বসেছে কি না, সেটা দেখভাল করা। যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো, মানে খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। আমি একটা ক্রুড ফান করলাম (হিউমারও বলা যায়)। ড্রাইভারদের দূরে আলাদা টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। আমি একজন বেয়ারার কানে কানে বললাম, লাল শার্ট, সাদা টাই পরা ওই ভদ্রলোককে (আমাদের এক বন্ধু যে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বউকে সঙ্গে করে এনেছে) গিয়ে বলুন ড্রাইভারদের সাথে বসতে। বেয়ারা আমার হুকুম পালন করল। আমার বন্ধু সুন্দরী স্ত্রীর পাশে বসে সবে মুচমুচে স্পেশাল ভাজা ইলিশে কামড় বসাতে যাবে, ঠিক তখন বেয়ারা গিয়ে বলল, আপনাকে ওই টেবিলে বসতে বলা হয়েছে। কেন এই টেবিলে সমস্যা কী?

ড্রাইভাররা সব ওই টেবিলে বসেছে কিনা।

বিষয়টা বুঝতে পেরে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমার বন্ধু (এখন অবশ্য ঘোরতর শত্রু) এবং তার স্ত্রী সেই যে গম্ভীর হয়ে গেল। এখনো সেই গাম্ভীর্য কাটেনি, আমার সঙ্গে দেখা হলেই তাদের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। পয়লা বৈশাখ বাঙালির চিরন্তন উৎসব। এই উৎসবে আনন্দ হবে, হাসি ঠাট্টা হবে। সেটাই স্বাভাবিক। এখন সেলফি, ফেসবুকের যুগ, এখন আনন্দ আরো বেশি, কারণ আনন্দের মুহূর্তগুলো সেলফি স্টিক বেয়ে মুহূর্তে ফেসবুকের ওয়ালে শটাশট সেঁটে যাচ্ছে। আরো দশ জনে দেখছে। আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে দশ দিকে। এই যখন অবস্থা তখন এক পয়লা বৈশাখে এক তরুণকে দেখা গেল মুখ গোমরা করে বসে আছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আজ পয়লা বৈশাখ এখনো ঘরে বসে আছিস যে? সবাই তো নতুন পাঞ্জাবি পরে বাইরে ঘুরতে বের হয়েছে, তুই যাবি না? ছেলে খিচিয়ে উঠল, যাবটা কীভাবে শুনি? কাল তো বুয়া সেলফি স্টিকে ঝাড়ু বেঁধে ঘরের ঝুল ঝাড়তে গিয়ে স্টিকটা ভেঙেছে! এখন বাইরে যাব কোন মুখে শুনি? ওই মা কি বলেছিলেন জানি না। তবে তারপরও আমরা বলি- এসো, এসো হে বৈশাখ! রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৭/তারা