শিল্প ও সাহিত্য

অনতিক্রম্য হুমায়ূন আহমেদ

অজয় দাশগুপ্ত: বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। কাঁচা বয়সে আমি তাঁর দুটো উপন্যাস পড়েছিলাম। তখন আমার বয়স ষোল কি সতের। দুর্বল ছাপায় মুদ্রিত বই ‘নন্দিত নরকে’ আমাকে কাঁদালেও পরেরটি আমাকে বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল কয়েকদিন। ‘শঙ্খনীল কারাগার’র সেই হুমায়ূন আহমেদকে পরবর্তী কালে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে দেখলেও তাঁকে এই নীল কারাগারের বাইরে যেতে দেখিনি। কী ছিলেন না তিনি? যখন নাটক মানে পাড়ার বা ক্লাবের নাটকের পর্দায় ভেসে ওঠা তখন তিনি এসেছিলেন অসামান্য সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে। ‘এইসব দিনরাত্রি’ বা ‘বহুব্রীহি’ বা ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল আর কখনো নির্মিত হবে এমনটা ধারণা করি না। তবে এ কথাও মানি অতঃপর তিনি আমাদের জনপ্রিয়তার চাপে এমন সব নাটক উপহার দিতেন যার মাথামুণ্ডু বোঝা দায়। শেষের দিকে এটা তাঁর দায় হয়ে উঠলেও তিনি তা এড়াতে পারেননি। বলছিলাম লেখার কথা। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বিশাল বাজার। সরস্বতী ওখানে থাকলেও তাদের লক্ষ্মীর বসত ঢাকাকেন্দ্রিক। যে কোনো অনুষ্ঠানে উৎসবে আমরা বই উপহার দেবার কথা ভাবলেই সামনে চলে আসতেন শংকর, সুনীল, সমরেশ কিংবা মুস্তাফা সিরাজের কথা। সে জায়গাটা বদলে দিয়েছিলেন তিনি। গোড়াতে সবাই তাঁকে তরুণ-তরুণীদের লেখক ভাবলেও, একসময় বাংলাদেশের সব বয়সের মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া হুমায়ূন আহমেদ প্রিয়তা হারিয়েছিলেন নিছক ব্যক্তিগত কারণে। আমার কিছু পরিচিতজন এবং বন্ধুদের জানি যারা সে ঘটনার পর তাঁর বই, নাটক সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ভাগ্যিস সে আমলে ফেইসবুক ছিলো না। ছিলো না ইমো ইত্যাদি। কারণ এই বন্ধুদের আমি এখন ডাকি ‘গ্রীণ সিগন্যাল’ বলে। সারারাত তাদের সবুজ বাতি জ্বলে। যখন তাদের প্রিয়তমা পত্নী নাক ডেকে ঘুমায় তখনো জ্বলে। এরা নিশ্চয়ই রাতের পর রাত জেগে গবেষণা করেন না। বা সামাজিক, রাজনৈতিক কাজও করেন না। যা তারা করেন বলে ধারণা করি হুমায়ূন আহমেদ সে কাজটি আইনীভাবে, সামাজিকভাবে করার পরও এদের চোখে নিন্দিত! বহুবিবাহ সমাজ, আইন ও ধর্মস্বীকৃত। সেদিক থেকে তিনি অন্যায় করেননি। আর মন খারাপ করা বা মানা, না-মানার অধিকার তো গুলতেকিনের। তাঁর মেয়েদের বা ছেলের, সেখানে সমাজশুদ্ধ মানুষের ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো দরকার ছিলো না।  সমাজের চারদিকে অসভ্য বর্বর আর নারীলোভীদের আক্রমণের পরও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে পেরেছিলেন আজীবন। আমাদের মিডিয়ার বড় গুণ- যার দিকে তাকায় তার দিকে অপলক। আর যখন কাউকে তোলে তখন কতটা উঠালে পড়বে না সেটাও বোঝে না। হুমায়ূন আহমেদের বেলায় সেটা ঘটলেও টেকেনি। কারণ তিনি ছিলেন বহুপ্রজ। বহুপ্রজ মানুষের বড় গুণ তারা সতত সচল। সে কারণে তাদের পুকুরে কচুরীপানা বা ময়লা জমে না। আবার এটাও ঠিক তাদের সৃষ্টির বেশীরভাগই স্বল্পমেয়াদের আয়ু নিয়ে জন্মায়। সময়ের চাহিদা পূরণে আসা মানুষের এটাই নিয়তি। কিন্তু এর ভেতরেও তিনি কেমন করে জানি অপূর্ব কিছু কিছু বিষয় তৈরি করতে পারতেন। তাঁর জীবন আদর্শ বা জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংঘর্ষ না থাকলেও তাঁর অনুজ জাফর ইকবালের মতো কমিটমেন্ট নেই। ছিলোও না। নিজেই বলতেন, বাবা শহীদ আর নানা ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আরো অনেক ঘটনা আছে যা নিয়ে বিতর্ক ছিলো। তারপরও তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন ‘তুই রাজাকার’ বলতে। সেই প্রথম রাজাকার শব্দটি গালিতে পরিণত হয়। যা এদেশের চেতনাপ্রবণ মানুষের জীবনে সারাজীবন টনিকের কাজ করবে। মধ্যপন্থীরূপে পরিচিত হবার পরও তিনিই তা করে গেছেন। আমাদের সমাজে সাহিত্যের কোনো চরিত্র বা নাটকের কোনো চরিত্র সত্য বলে ভাবা সহজ না। তিনি বহুকাল পর মানুষকে সিনেমার বাইরে মানে দৃশ্যমান জগতের বাইরের কাউকে এমন বিষয় সত্য বলে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। বাকের ভাই যেমন, হিমুও তেমনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, যে বিষয়টি তিনি আমাদের দিয়ে গেলে বা চর্চা করলে সমাজ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতো তিনি তা করেননি। অসাম্প্রদায়িকতা ও উদারতার বিষয়গুলো তিনি বললে তারুণ্য আরো দৃঢ়ভাবে নিতে পারতো। হিমুতেই তার ঈঙ্গিত আছে।হিন্দু মুসলমানের মিলিত আদলের নাম হতে পারতো হিমু। এবং সেটা কালজয়ী তো বটেই, হয়ে উঠতে পারতো বাঙালির মনোজগতের হিরো। এমন অনেক সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছে তাঁকে ঘিরে থাকা মিডিয়া ও মানুষদের কারণে। জনপ্রিয়তার বড় অভিশাপ একা হয়ে যাওয়া। সে অভিশাপ তাঁকেও ঘিরে রেখেছিল। যে কারণে হয়তো অনেক বিষয় টের পেতেন না। তবে তা ধুয়ে দিয়ে যায় এইসব মৃত্যূ। মৃত্যু অমোঘ নিয়তি। কিন্তু সেই সাধারণ বাক্যবন্ধ কিভাবে ভুলি? 

এমন জীবন হবে করিতে গঠন

মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। আমাদের ভুবন যদি হয় বাংলাদেশ তো তাঁর মৃত্যুতে সত্যি কেঁদেছিল এদেশের মাটি ও মানুষ। তার কিছুদিন আগে সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন সিডনিতে। তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দাদা বলেছিলেন, আপনারা সবাই হুমায়ূনের জন্য আশীর্বাদ ও শুভকামনা রাখবেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে তখনই বলে রেখেছিল- ‘দাদা, আমি চোখের সামনে দরজায় দাঁড়ানো আজরাইলকে দেখছি’। এই ঘটনার অল্প ক’দিন বা মাসখানেকের ভেতরই মারা যান তিনি। এই অতিপ্রাকৃত চিন্তা, অলৌকিক ঘটনা তাঁর জীবনে একাধিকবার এসেছিল। অনেকগুলো চমকে ওঠার মতোও বটে। তবে সবচেয়ে বড় চমক তার আগমন ও চলে যাওয়া। আমি নিশ্চিত আরো বহুকাল বাংলাদেশের সাহিত্য, নাটক ও শিল্পজগত হুমায়ূন আহমেদের কারণে অচলায়তনে থাকবে। আর কিছু কিছু বিষয় ও বৈচিত্রে তাঁকে অতিক্রম করা যাবে না কোনো দিন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৭/তারা