শিল্প ও সাহিত্য

একচক্ষু হরিণীরা : সূচনা পর্ব

||এক||

আমার মা গত বিশ বছর ধরে আমাকে বড় করেছেন আমার একটি সুস্থ চোখ নেবেন বিধায়। জন্মের পর আমাকে শালদুধ পান করানো থেকে আড়াই বছরের শেষতম দিন পর্যন্ত স্তন্যপান করানো, স্যাভলনগোলানো পানিতে গোসল করানো, দাঁত উঠতে শুরু করার পর ঝাল-মশলাবিহীন খিচুরি চটকে খাওয়ানো, প্রস্রাব-বাহ্যি পরিষ্কার করা, বিছানা ভেজালে নিজে সারারাত ভেজা অংশে শুয়ে থেকে আমাকে শুকনো পাশে শোয়ানো (বিছানায় প্রস্রাব করা ছাড়তে আমার দীর্ঘ এগারো বছর লেগেছিল। এ নিয়ে মাকে বড় যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে), কপালের ডানপাশে বড় করে কাজলের টিপ দেওয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত চোখে সুরমা লাগানো—সবকিছুর মূলে একটি উদ্দেশ্য—আমার একটি সুস্থ চোখ। আমার বাবা আমাকে এই তথ্য দিয়েছেন। চব্বিশ বছর বয়স তখন আমার। আমার মা কেন আমার চোখ চান, ঠিক জানা নেই। বাবা বলেননি। তিনি কারণটা জানেন না, তা একেবারেই মনে হয়নি আমার। অনেক জোরাজুরি করেছি আমি, জানার জন্য। বাবা বলেনইনি। একবার কিছু না বললে সেটাকে বাবা কখনো হাঁ বলেন না। তবে কারণটা ঠিক অজানা থাকার কথা নয়। যে কেউই আঁচ করতে পারবে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। এই তো, দু’বছর আগের দৃশ্যও মনে নেই, অথচ বিশ বছর আগেরও কিছু দৃশ্য স্পষ্ট গেঁথে আছে মাথায়। যেমন চার বছর বয়সে আমার পাশের বাড়ির চা-অলা কাকির বাচ্চা হয়েছিল। মা গিয়েছিলেন ধাইয়ের সাথে। আশপাশ থেকে অনেক মহিলারাই গিয়েছিল। মাটির কিছু হাড়ি-পাতিল দিয়ে রান্না-বাটি খেলায় বসিয়ে মা বললেন, আমি এক্ষুণি আসছি, তুই খেল। চকলেট নিয়া আসব তোর জন্য।

আমি ছিলাম অসম্ভব মা-ন্যাওটা। মাকে দেখতে না পেলেই মাথা খারাপ হয়ে যেত। কিছুক্ষণ একমনে খেলার পরেই হুট করে মনে পড়ল, মা আসছে না। চকলেট আনতে তো এতক্ষণ লাগার কথা না। আম্মা না থাকলেই আমি দৌড়ে আব্বার কাছে চলে যাই। মুখোমুখি কতগুলি ঘর দাঁড়িয়ে, মাঝখানে সরুতর রাস্তা। সামান্য হেঁটে গেলেই আব্বার দোকান পড়ে। পান সিগারেট বেচেন তিনি। আব্বার পান সিগারেট বিক্রির দৃশ্য আমার ভালো লাগে খুব। আব্বা অন্ধ, অথচ নিপুণ দক্ষতায় পান সাজিয়ে দেন। প্রথম কৌটা থেকে সুপুরি, দ্বিতীয় কৌটায় চুন, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ কৌটাগুলিতে এক এক ব্রান্ডের জর্দা, সপ্তম কৌটায় খয়ের... আব্বার মুখস্থ। সিগারেটও ব্রান্ড অনুযায়ী সাজানো। ট্রিপল ফাইভ, গোল্ড লিফ, সিজার... ডান পাশের একটা কৌটায় লজেন্স। তখন অবশ্য লজেন্সকেই আমরা ‘চকলেট’ বলি। আব্বার কাছে গেলেই তিনি আগে হাতে চকলেট দেন এক মুঠো, তারপরে কথা শুরু করেন। সেদিন হাতে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে আব্বা আমায় কাছে টেনে নিলেন। গালে হাত বোলাতে গিয়েই চমকে যাওয়ার ভান করে বললেন, আমার মুকুল আব্বার কী হলো? চোখে পানি নাকি?

আমি বললাম, আম্মা কই? তারে দেখি না।

আব্বা টেনে কোলে নিতে নিতে বললেন, তোমার আম্মা চা-অলা কাকির বাসায় গেছে। কাকির ঘরে একটা বাবু আসবে। তুমি আমার কাছে বসো।

আমি আব্বার কোল থেকে নেমে এলাম। হাত ছিটকে সরিয়ে দিলাম। আব্বা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না! নেমেই সোজা দৌড়ে চা-অলা কাকির বাসায়। পেছন থেকে আব্বার গলা শুনতে পেলাম, আরে ওদিকে যাস না। আমার কাছে থাক। আব্বার স্বর আস্তে আস্তে মিইয়ে যেতে থাকে।

আমার বাসার পর তিনটা বাসা ছাড়িয়েই চা-অলা কাকির ঘর। চা-অলা কাকির ঘরে আমি প্রায় রোজই একটা স্টিলের গ্লাস নিয়ে যাই। কাকির কাছে গিয়ে বসে থাকি। কাকি প্রায় সারাক্ষণ রান্নাঘরে চা বানান। চা বানানো হলে তার স্বামী, যাকে আমি মইদুল কাকা বলে ডাকি, তিনি ফ্লাস্ক ভরতি করে নিয়ে যান। একহাতে ফ্ল্যাস্ক আর অন্যহাতে একটি পানি ভর্তি বালতিতে ডোবানো কাপ নিয়ে মইদুল কাকা চেঁচান, ওই চা গ্রম। ওই চা গ্রম... স্টিলের গ্লাস নিয়ে বসলেই কাকি আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নেন। তারপর গ্লাস ভর্তি করে দুধ চা বানিয়ে দেন। চুলা থেকে দু’চারটি কাঠ বাইরে বের করে আগুনটা হালকা করে উঠে কাছে এসে বসেন। আমি চুলার কাছে যেতে চাইলে কাকি বারণ করেন, চুলার কাছে যাইবা না বাপ, আমার মতো কালা অইয়া যাবা।

কাকি বেজায় কালো ছিলেন। চা-অলা কাকির ঘরের ভেতরেই একটা ঘর আঁতুড়ঘর হিসেবে চালানো হচ্ছিল। মাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে চলে যাই। ঘরের ভেতর থেকে জোর চিৎকার শুনতে পেলাম। আমার ভয় হয়েছিল, আমার মা, যাকে আমি আম্মা বলে ডাকি, কেউ মারছে নাকি তাকে? আম্মার গলাই তো মনে হচ্ছে। চিৎকার আসছিল যে ঘর থেকে, দৌড়ে সেদিকে চলে যাই। দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছিলেন ফাহিমা কাকি, তার হাতে একটি ওলটানো ফানেল আকৃতির কাচের ল্যাম্প; তখন প্রত্যেক ঘরে এই ল্যাম্প আর হারিকেন ছিল; আমায় দেখে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বললেন, অ্যাই, অ্যাই, কই যাস? দাঁড়া, দাঁড়া! আমি সেদিকে কান না দিয়ে ঢুকে পড়ি সেই ঘরে, যেখান থেকে পাশবিক চিৎকার ভেসে আসছে। ঢুকে একটি ভয়ংকর দৃশ্য দেখি। ঐ দৃশ্য আমায় স্তম্ভিত করে দেয়। যন্ত্রণা দেয় বহুদিন । চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো ভেসেছে ঐ একটি দৃশ্য, বহুদিন।

... মিশমিশে কালো এক পৃথুলা নারী, যার চেহারা আমি তখন দেখতে পাইনি, দুই পা ফাঁক করে জবাই হওয়া গরুর মতো মুচড়ে মুচড়ে চেঁচাচ্ছেন। তাকে চেপে ধরে আছেন কয়েকজন নারী। সেই নারীদের সবাই আমার চেনা। একজন বাদে তাদের সবাইকেই আমি কাকি বলে ডাকি। আর একজন আমার মা। যাকে চেপে ধরে আছেন তার কুকড়ে যাওয়া মুখ দেখি আমি; চা-অলা কাকি। কাকির দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছে রক্ত।

এক মুহূর্তের একটি দৃশ্য। ঘরে ঢুকেই আবার আমি দৌড়ে বের হয়ে যাই। অথচ ঐ এক মুহূর্ত আমায় অনেকদিন ছিঁড়ে খেয়েছে। লাভ যা একটাই হয়েছে তা হলো, ঐদিন থেকে আমি জেনে যাই যে, এই সুন্দর সুন্দর বাচ্চারা আকাশ থেকে কিংবা বাগান থেকে আসে না। এরা আসে অন্যভাবে।

যা-ই হোক, যেজন্য এই ঘটনাটি বলা, আমি যেসব খুঁটিনাটি ঘটনা মাঝেমধ্যে বলব, তাতে কোনো সন্দেহ পোষণ না করেন যে মিথ্যে বলছি।

চা-অলা কাকিকে নিয়েও আমার আলাদা গল্প আছে, সেটা পরে কখনো বলা যাবে। আপাতত মূল জায়গায় আসি— আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করব? নাকি পানিতে ডুবে যাওয়ার ঘটনাটা বলব? নাকি আহিরের সঙ্গে আমার মায়ের প্রথম সাক্ষাতের বিষয়টা থেকে শুরু করব? কিংবা আমি যুবক হলে মা যে আমার একটি সুস্থ চোখ নেবেন, বাবার মুখ থেকে শোনা সেই গল্পটাও গুছিয়ে বলা যায়। এক জায়গা থেকে শুরু করলেই হলো। তারচে যখন যেভাবে মনে আসে, বলে যাই, আপনারাই নিজেদের মতো গুছিয়ে নেবেন। প্রথম স্কুলে যাওয়া থেকেই শুরু করি।

মায়ের হাত ধরে যেদিন স্কুলে ঢুকি, আমার বুক কাঁপছিল। মাকে ছেড়ে দীর্ঘ সময় দূরে থাকতে হবে, ভাবতেই কান্না আসছিল। তখন প্রাইমারি স্কুলে ঢুকতে ভর্তি পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে হতো না। মা আমাকে নিয়ে সোজা হেড মাস্টারের রুমে নিয়ে যান। হেডমাস্টারকে বলেন, স্যার, আমার ছেলেটারে ভর্তি করাতে চাই।

হেডমাস্টারের ভাবভঙ্গিতে আমার মনে হয়েছিল, তিনি মাকে আগে থেকেই চেনেন। আমায় তিনি কাছে ডেকে নিলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী তোমার?

আমি উত্তর দিচ্ছিলাম না। আম্মা বললেন, নাম বলো। আমি নাম বললাম, মুকুল।

বাবার নাম?

আমি নিশ্চুপ। মা বললেন, বাবার নাম বলো...

বললাম, মাহমুদ আলী।

স্কুলে ভর্তি হতে চাও?

আবারও চুপ। আম্মা সামান্য বিরক্ত হয়ে বললেন, কথা বলো না কেন? ঠিকমতো জবাব দাও।

আমি হেড স্যারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালাম, হুঁ।

পড়াশোনা কী পারো? স্বরে-অ, স্বরে-আ পড়তে পারো?

আমি আবারও চুপ। এবার আম্মা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকালাম মৃদু।

আচ্ছা, শোনাও তো।

আমি স্বরে-অ, স্বরে-আ শোনালাম। ব্যঞ্জনবর্ণ পড়ে শোনাতে হলো। একটা বই দিলেন, রিডিং পড়লাম, ‘মনারে মনা কোথায় যাস/ বিলের ধারে কাটব ঘাস...’। নামতা জিজ্ঞেস করলেন, বারো ঘরের নামতা পর্যন্ত আমি বলতে পারলাম। তারপর ইংরেজি বর্ণমালা। দুটি রাইম। হেডস্যার মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার মুগ্ধতার প্রকাশ ছিল, আমায় সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি করে দেওয়া।

প্রতিটি দৃশ্য আমার স্পষ্ট মনে আছে। পিয়নকে দিয়ে যখন আমাকে হেড স্যার ক্লাসে যেতে বললেন, আমি একা যেতে চাইনি। আম্মাকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না। শেষমেশ, এই শর্তে রাজি হলাম যে আম্মা পুরোটা সময় ক্লাসরুমের বাইরে বসে থাকবেন। স্যার পড়াচ্ছিলেন আর আমি বার বার বাইরে দেখছিলাম, আম্মা চলে গেলেন কি না। ক্লাস শেষ হলেই দৌড়ে আম্মার কাছে চলে যেতাম।

প্রথমদিন স্কুলে ঢুকেই আমাকে যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়, সেটি ছিল, ঐ, তোর কপালের মাঝখানে অতখানি কাটল কেমনে?

হ্যাঁ, আমার কপালে একটি বড় কাটা দাগ ছিল। আমার মায়ের কপালেও ছিল। ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্টের গল্প বলি এখন। আমাদের দোতলা কাঠের ঘর। রান্নাঘর দূরে। কাঠের ঘরে দূরে রান্নাঘর থাকাই নিরাপদ। তো আমাকে দোতলায় ঘুম পাড়িয়ে এসে আম্মা বাইরে রান্না করছিলেন। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। সম্ভবত শীতকাল ছিল। বাবাও আমার পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। আমি কাঁথা সরিয়ে চুপি চুপি উঠে এলাম। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি রান্নাঘরে ধোঁয়া উড়ছে। তার মানে মা রান্না করছেন। দোতলা সিঁড়ি দিয়ে একা একা নামতে গেলাম। তখন ঘটল অ্যাকসিডেন্ট। কীভাবে কীভাবে আছাড় খেলাম মনে নেই। গড়াতে গড়াতে একদম নিচে। একবার শুধু ‘আম্মা’ বলে চিৎকার দিতে পেরেছিলাম। আমিও একটা চিৎকার শুনেছিলাম। রান্নাঘর থেকে মা চিৎকার করে উঠলেন, কী হয়েছে মুকুল?

জ্ঞান হারাবার আগমুহূর্তে আমার শুধু মনে আছে মুখের উপর ঝুঁকে থাকা একটি স্নেহশীল মুখ। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামছে অশ্রু, আর কপাল বেয়ে রক্ত। আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসতে গিয়ে মা রান্নাঘরের চৌকাঠের সঙ্গে বাড়ি খান। তার কপালও ফেটে যায়। তিনি সেসব টের পাননি। তিনি আঁচলে চেপে আছেন আমার কপাল। আমি খুব বলতে চাচ্ছিলাম, আম্মা, তোমার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। বলা হয়নি। মায়েদের কত কিছুই তো বলা হয় না সারাজীবনে।

পানিতে ডুবে মরার মতো দশা হলো আমার, সেবারও আমার মুখের উপর ঝুঁকে ছিল আম্মার মুখ।

বাসার কাছেই ছিল নদী। আর কী একটা গাছ ছিল, নদীর পাড়েই, নাম ভুলে গেছি, অদ্ভুত এক ফুল হতো তাতে। সেই ফুলের নিচের একটা অংশ ব্লেড দিয়ে কেটে পানিভর্তি প্লেটে রাতে ডুবিয়ে রাখলে পরদিন ভোরে উঠে দেখতাম ফুল ছড়িয়ে ফুটে আছে ঘাগড়ার মতো। সূক্ষ্ম পাপড়িগুলো একটানে সরিয়ে ফেললে ভেতরে জমে থাকত মধু। এক চুমুকে সেই মধু খেয়ে ফেলতাম। আমি তখন সেই গাছে উঠতে পারি। ছোট গাছ, বেয়ে ওঠা খুব সহজ ছিল।

এক বর্ষায় গাছে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো নদীতে একটু সাঁতার কেটে আসলে মন্দ হয় না। যদিও তখন সাঁতার জানি না আমি। আস্তে আস্তে নদীতে নেমে যাই। আর বর্ষাকালের ভরা নদী টেনে নেয় আমায়। ভাগ্যিস গোসল করতে আসা একজন দেখে ফেলেছিল, সে এসে আমায় উদ্ধার করে। সেবারও জ্ঞান হারানোর আগমুহূর্তে আমার মুখের সামনে ঝুঁকে ছিল অশ্রুভরা আম্মার মুখ। আম্মাদের মুখ এমনিতেই সবসময় অশ্রুভরা হয়। আমাকে আমার মা তার পরদিন থেকেই সাঁতার শেখাতে শুরু করেন। সাঁতার শিখতে তিনদিন লেগেছিল আমার। আচ্ছা, সাঁতার শেখানোর সাথে কি সুস্থ চোখের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? অবশ্য ছোটবেলায় কে যেন বলেছিল, পানিতে ডুব দিয়ে তাকিয়ে থাকলে চোখের জ্যোতি বাড়ে। জ্যোতি বাড়ানোর লোভে শৈশবে প্রতিদিন আমি আধঘন্টা নদীতে ডুবাতাম। ডুব দিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতাম, দেখতাম সবুজ রঙের পানি। ||দুই||

আকাশের অবস্থা স্বস্তিজনক নয়। কদিন ধরে ভ্যাপসা গরম। ঢাকা শহরের সবাই চাতক হয়ে উঠছে। এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য গুমরে মরছে। অথচ আজ যখন বৃষ্টি মোটামুটি নিশ্চিত, সবাই বাস ধরার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেছে। একেকটা বাস আসছে কানায় কানায় ভর্তি হয়ে। তাও কীভাকে কীভাবে দুয়েকজন দৌড়ে দরজার হাতল ধরে ঝুলে পড়ে বাদুড়ের মতন।

তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা উচিত। ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টিতেও ভেজার ইচ্ছে নেই আমার। তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। আকাশ মোটামুটি নিশ্চয়তা দিচ্ছে ঘণ্টা দুয়েক স্থায়ীত্বের বৃষ্টির। এ অবস্থায় কোনো একটা বাসের হাতল ধরে ঝুলে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ইচ্ছে করছে না। কোনো একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়া যায়, তাও ইচ্ছে করছে না। মাঝে মাঝে এমন হয়, কিছু ইচ্ছে করতেই ইচ্ছে করে না।

বাস ধরব, না চায়ের দোকানে ঢুকব—এমন একটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। ঝমঝমিয়ে নামাই বলা যায়। এই দালানকোঠাময় শহরে বৃষ্টির নিজে চাইলেও ঝমঝমিয়ে নামার কোনো সুযোগ নেই। এই জায়গাটিতে সম্ভবত বৃষ্টি সে সুযোগ পায়।

দাঁড়িয়ে ছিলাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে। সম্মেলন কেন্দ্রের দীর্ঘ ছাদ টিনের। বৃষ্টি এলে সেতারের শব্দ ওঠে। একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। দীর্ঘ ছাদের এক দিক থেকে বৃষ্টি দৌড়ে আসছে পাগল মোষের মতো। না, মনে হচ্ছে এক ভিড় মানুষের মাঝখানে একটি পাগলা ষাঁড় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে দৌড়ে আসছে। মানুষজন সব ভয়ে একদিকে ছুটে যাচ্ছে। তাদের জুতা লোহার কাঁটাঅলা। আর রাস্তা টিনের।  ও-মাথা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এ-মাথা ছাড়িয়ে গেল তারা মুহূর্তে। আর শুধু শব্দ উঠতে লাগল, ঝম ঝম ঝম ঝম ঝম...

চট করে পাশের চায়ের দোকানে ঢুকে গেলাম।

দুটি কাঠের বেঞ্চে ঠেসেঠুসে লোক বসা। ছোট্ট একটা ছাউনি। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সেখানে এসে একরাশ মানুষ ভিড় করেছে। একেকজন পারলে অন্যজনের শরীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও যে রাস্তায় মানুষের মিছিল হচ্ছিল বলা যায়, এখন তা ফাঁকা। ভরা বাস চলে যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে। দুয়েকটা দাঁড়ালে ছাউনি থেকে জনাআটেক লোক দৌড়ে বাসের কাছে চলে যায়, জনাছয়েক ফেরত আসে। অমন ভরা বাসে কী করে যে আরও দুজন ঝুলে-কসরত করে জায়গা করে নেয়, সেটা একটা রহস্য।

একটা পনেরো নম্বর আসতেই কয়েকজন দৌড় দিল সেটা ধরতে। একজন বেঞ্চ ছেড়েছে, আমি সুড়ুৎ করে বসে পড়লাম। চায়ের দোকানদার লোকটির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আরে ভাই, কই যান? চায়ের দাম না দিয়া কই যান?

সেসব শুনবে কেন লোকটা! শোনার উপায়ই বা কই? সে বাসে ঝুলে পড়েছে। দোকানদার নোংরা একটা গালি দিল। আমি জাঁকিয়ে বসতে বসতে বললাম, ভাই, কড়া একটা লাল চা লাগান তো।

দোকানদার মনে হলো বিরক্ত হয়েছে। চা চাইতেই কপাল কেমন কুঁচকে গেছে তার। একটা পান বানাতে বানাতে বলল, আগে ছয় টেকা দেন ভাইজান, চায়ের দাম। বাস আসলেই আপনিও দৌড় দেবেন।

রাগ উঠে গেল আমার। দোকানদারকে কড়া একটা কথা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। ভিড়ের মধ্যে এক কোনায় আকাশী শাড়ি পরা এক নারী দাঁড়ানো। কাঁধের কাছে ভেজা। চুলে চিকচিক করছে বৃষ্টির ছাঁট। জোড়া ভ্রু। মাঝারি লম্বা। মেয়েটার মুখ পরিচিত মনে হচ্ছে। কই যেন দেখেছি, কই যেন দেখেছি... মনে পড়ছে না। (চলবে) রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুলাই ২০১৭/তারা