শিল্প ও সাহিত্য

একচক্ষু হরিণীরা : ষষ্ঠ পর্ব

সুবিদ আলীর মনে আশঙ্কা জমা হলো। এই লোকটা যদি পারুলের কোনো ক্ষতি করতে আসে? তাকে না পেয়ে যদি মাহমুদ আলীর কিছু করে? কিংবা যদি পারুলকে লোক দিয়ে ধরে নিয়ে যায়? অন্য কোনো লোকও যে আবার চম্পা নাম দাবি করে আসবে না- তারই বা নিশ্চয়তা কী? এমন নানা প্রশ্ন সুবিদ আলীকে পর্যুদস্ত করে দেয়। তিনি ঠিক করলেন দোকান-টোকান বিক্রি করে অন্য কোনো শহরে চলে যাবেন। দূরের শহরে। সেখানে গিয়ে নতুন করে ব্যবসা শুরু করবেন। পান-সিগারেটেরই দোকান দেবেন না হয়। মাহমুদ আলী তো অন্য কোনো ব্যবসা পারবে না। এমন সময় ঘটল বড় অঘটনটি। পাশের তুলার দোকান থেকে একনাগাড়ে কয়েকটি দোকানে আগুন লাগল। মাঝখানে পড়ে সুবিদ আলীর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এই একটি দোকানই ছিল সুবিদ আলীর সর্বস্ব সম্পত্তি। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সামান্য কিছু সঞ্চয় ছিল, ভাবলেন আবার ধারদেনা করে দোকান ওঠাবেন। একদম নতুন জায়গায় শূন্য হাতে গিয়ে কিছুই করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত বদলালেন। না, তিনি এই শহরে থাকবেন না। আবার কে এসে পারুলকে দাবি করে বসে, তখন আবার নতুন ফ্যাসাদ। এই ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং শূন্য হাতেই শুরু করবেন।

পারুল আর মাহমুদকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে গেলেন তিনি। সম্পদ বলতে সামান্য সঞ্চয় আর বাউন্ডুলে থাকাকালীন শিক্ষা আর সাহস। ঠিক করলেন ছেলেকে নিয়ে পথে পথে খেলা দেখাবেন।

ছেলেকে শেখালেন অভিনয়। কামারের দোকানে গিয়ে বানিয়ে আনলেন পুরনো ধাঁচের একটি তলোয়ার। ঢাকার জাদুঘরে তিনি যেসব তলোয়ার দেখেছিলেন, মোটামুটি তার অবয়বে। তারপর শুরু করলেন পথে পথে খেলা দেখানো। শুরু হলো নতুন জীবন। আট

মাঝে মাঝেই আমি আর আহির বিভিন্ন জায়গায় হেঁটে বেড়াই। কখনো কখনো আহিরকে শ্যাওড়াপাড়ার বাসে উঠিয়ে দিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাই, কখনো কখনো হেঁটে হেঁটে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিই। তবে আহিরের বাসায় ঢুকিনি কখনো। আমার ধারণা আহিরের বাবা খুব রাগী ধরনের মানুষ। একবার মাত্র বাসার কাছে রাস্তায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আহির পরিচয় করয়ে দেয়, আব্বা, এর নাম মুকুল। আমার বন্ধু।

তিনি সামান্য হেসেছিলেন। তার হাসিতে মনে হলো প্রথম দর্শনেই তিনি আমায় অপছন্দ করে ফেলেছেন। কেমন যেন কাঠখোট্টা ভাষায় জানতে চাইলেন, আমি কী করি?

আমি জবাব দিলাম, এখনো কিছু করি না, কাজ খুঁজছি।

আহির তাড়াতাড়ি বলল, মুকুল কবিতা লেখে, বাবা। ওর বই আছে কবিতার।

ভদ্রলোক আবার হাসলেন। সেই হাসির মানে যেন আমার মনে হয়েছিল, তোমাকে অপছন্দ করে আমি ঠিকই করেছিলাম। তুমি পছন্দ করার পাবলিক নও। তিনি অবশ্য সেসব মনে মনে বলেছিলেন। আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, বাহ! কবিতা লেখা বুঝি কাজ নয়?

এবার আমিও হাসলাম। এই হাসির মানে হলো, কবিতা লেখা যে কাজ- সেটা আপনি বুঝবেন- এমন ধারণা আমার ছিল না।

এরপর আর কোনো কথা হয়নি। ভদ্রলোক ভদ্রতা করেই আমায় একবার বাসায় যেতে বললেন। স্পষ্ট পড়তে পারছিলাম, তার চোখ বলছিল, তুমি বাসায় না আসলেই আমি খুশি হবো।

আমি আর কখনো আহিরের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করিনি।

আহিরকে একদিন কথাটা বলতেই আহির খেপে গিয়েছিল। আহির চাপাচাপি করছিল বাসায় যেতে, আমি বললাম যে তোমার বাবা যেতে বারণ করেছেন।

আহির অবাক হয়ে গেল, কবে? কী বলো এইসব?

আমি বলললাম, ঐ যে, যেদিন আমাদের দেখা হলো। তুমি ছিলে তো।

সেদিন তো এমন কিছু বাবা বলেননি। আহির আরও অবাক হয়। কখন বললেন?

বলেছেন মনে মনে। তুমি শোনোনি। মুখে হাসি লেগে থাকলেও ভিতরে ভিতরে উনি আসলে ভয়াবহ রাগী মানুষ। বোঝা যায়।

আহিরই ভয়াবহ রেগে যায় এবার। কিংবা কপট রেগে যাওয়ার ভান করেছিল। তুমি কীভাবে বুঝলে আমার বাবা রাগী মানুষ? শুধু শুধু ভালো মানুষটার বিরুদ্ধে বদনাম বলো!

আরে, আমি কি খারাপ বলেছি নাকি তাকে? রাগী বলেছি।

ঐ একই কথা। একবার মাত্র দেখা। তাতেই কীসব মিথ্যে বদনাম। আজ তোমাকে বাসায় যেতেই হবে। চলো। আহির আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়।

আমায় বাসায় নিয়ে বেচারি বিপদে পড়েছিল। সামান্য বিব্রতকর অভিজ্ঞতা ছিল সেটি।

আহিরের বাসাটা তিনতলায়। ছোট্ট একটা ডাইনিং রুমসহ ছোট ছোট দুইটা রুমের ফ্ল্যাট। এক রুমে তার ছোট ভাই আর বাবা থাকে। অন্য রুমটা আহিরের। বাবা-ভাই দুজনের কেউই বাসায় ছিলেন না। আমি ঢুকেই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ওর রাগী বাবা এলে না আমায় মেরেই ফেলে। অন্তত ভুল না বোঝে। অবশ্য ভুল বোঝার কথাও না। আমিই সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবছিলাম। আর আহির যে তেমন মেয়ে নয়, এতদিনে স্পষ্ট বুঝে গিয়েছি আমি। তার প্রতি কেউ সামান্য অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালে সেই চোখ তুলে ফেলতে পারি আমি। আমার চেয়ে এই ব্যাপারটা তারা নিশ্চয়ই ভালো বুঝবেন। রুমটুম ঘুরিয়ে দেখিয়ে আহির আমাকে তার বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় নিয়ে গেল। আহিরের রুমের সামনেই পাশাপাশি দুজন দাঁড়ানো যায় না, এমন প্রশস্তের ক্ষুদ্র বারান্দা। দুজনে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াই। একসারি টবে কয়েক জাতের ফুলও আছে। সব ফুল নীল রঙের। সেখানে দুইটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। গাঢ় হলুদ বর্ণের ডানা। মাঝখানে ফোঁটা ফোঁটা লাল, নীল আর কালো। দুটিই দেখতে হুবহু। মনে হচ্ছিল যেন জমজ। আহির জানাল, প্রজাপতি দুইটা তার পোষা। আমি হেসে ফেললাম। আহির ঠাট্টা করছে। যদিও সে দাঁড়িয়ে আছে বরাবরের মতো সিরিয়াস মুখ করে।

আমার হাসি শুনে আহির বলল, হাসছ কেন? আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। এই দুইটা প্রজাপতি আমার পোষা। এরা এখান থেকে কোথাও যায় না।

আমি বললাম, কদিন ধরে পুষছ?

আহির জানাল, মাস দুয়েক হলো।

আমি বললাম, ধ্যাত, এটা হতেই পারে না। প্রজাপতি অতদিন বাঁচেই না। একটা প্রজাপতি বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক বাঁচে।

আহির মুখচোখ বড় বড় করে বলল, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এরা মাস দুয়েক ধরে আছে। এই দুটিই। দিন পনেরো আগে আমি ছবি তুলেছিলাম। তুমি মিলিয়ে দেখতে পারো। দাঁড়াও, মোবাইলে ছবি আছে, দেখাচ্ছি।

আহির মোবাইল বের করে প্রজাপতির ছবি দেখায়। নানা অ্যাঙ্গেলে তোলা। কড়া রোদ পড়ে ডানা আরও চেয়েও তোলা ছবি যেন বেশি সুন্দর, জীবন্ত।

আহির বলতে থাকে, আমি নিজে প্রজাপতি নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি। কিছু কিছু প্রজাপতি দু বছরও বাঁচে। এই দুইটা হয়তো সেই জাতেরই।

কী জানি। তবে প্রজাপতি দুইটা...

...সুন্দর বলতে গিয়েও আটকে গেলাম মুহূর্তের জন্য। আমার চোখ চলে গেল বারান্দার গ্রিলে। সেখানে আহিরের কাপড়চোপড় নাড়া ছিল শুকানোর জন্য। লাল রঙের একটা অন্তর্বাসে চোখ আটকে গেল আমার। উড়ছে হাওয়ায়। একই সময়ে আহিরের চোখও গেল বোধ হয়। সে চট করে অন্তর্বাসের উপরে একটা জামা টেনে দিতে গেল। ফলে যেটা হলো, তাড়াহুড়ায় অন্তর্বাসটার উপরে জামা তো ঠিকমতো রাখা গেলই না, বরং সেটা বারান্দার মেঝেতে পড়ে যেন আমাদের দুজনের দিকেই কটমট করে তাকিয়ে রইল। আহিরের দিকে তাকিয়ে দেখি তার গাল অন্তর্বাসের লালের চেয়েও অধিক রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। এমন পরিবেশ কীভাবে সহজ করতে হয় আমার জানা নেই। এমনিতেই আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। বলতে পারি না দেখেই লিখি। কেউ খারাপ কিছু বললেও চুপ করে থাকি। মনে মনে জবাব খুঁজি। মোক্ষম একটা জবাব পেতে পেতে হয়তো সে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

আমারই এই অবস্থা, আহিরের কথা আর কী বলব। চট করে কিছু খুঁজে না পেয়ে আহির বলল, চা খাবে?

আমি মাথা নাড়লাম। আহির চা বানাতে চলে গেল।

অন্তর্বাসের এই ঘটনাটি এমন কিছু অশ্লীল বিষয় নয় এখন। নিউমার্কেট আর গুলিস্তানের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমি অসংখ্য মেয়েকে দেখেছি অন্তর্বাস কিনতে। আজকাল মেয়েদের জামার ভেতর থেকেই অন্তর্বাসের রঙ বোঝা যায়। অনেকেরই ঘাড়ের কাছ দিয়ে ফিতে বের হয়ে থাকে। এই নিয়ে কারও কোনো বিকার নেই। এমনকি আমারও ছিল না। কিন্তু সমস্যাটা হলো, মেয়েটা ছিল আহির। পৃথিবীর পবিত্রতম নারী। লাজুকতম নারী। শুধু আমার সাথেই তার ঘুরতে, কথা বলতে, সিনেমা দেখতে কিংবা একলা বাসায় আসতে কোনো কুণ্ঠা দেখিনি আমি। দেখিনি শ্লাঘা।

আমি একদিন অবাক হয়ে আহিরকে বলেছিলাম, তোমাকে দেখে ধারণাই করিনি, তুমি এতটা ইনট্রোভার্ট একটা মেয়ে। অথচ আমায় দেখে কীভাবে অমন সেধে কথা বলতে এসেছিলে?

আহির বলেছিল, তোমাকে প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিল, একে চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়। বিশ্বাস করেছিলাম।

কথাটা শুনে আমার বড় মায়া হয়েছিল আহিরের প্রতি। আমাকে দেখে কেউ কীভাবে প্রথম দর্শনেই সিদ্ধান্তে আসতে পারে, একে বিশ্বাস করা যায়! আমি চোখ দেওয়ার ভয়ে স্বার্থপরের মতো আমার বাবা-মাকে ছেড়ে একলা শহরে পড়ে রয়েছি। মাঝেমধ্যে মদ খাই। আবাসিক হোটেলে মেয়ে গিয়ে উঠেছি অনেকবার। আমার বাসাতেই নিতাম, কিন্তু অমন জরাজীর্ণ বাসায় এরা যাবে না। বরং হোটেল খরচটাও বেশিরভাগ নারী নিজেই দেন। এই দেওয়ায় এক ধরনের আনন্দ পান তারা। এছাড়াও এমনকি দুবার ব্রথেলেও গিয়েছি আমি। ব্রথেল মানে পতিতাপল্লী। কবি সাহিত্যিকরা এই জায়গাকে ব্রথেল বলে একটা অভিজাত-অভিজাত ভাব দিতে চায়। উপাসনাগার-উপাসনাগার একটা রং লাগানো যায় বোধ হয় তাতে।  যা-ই হোক, আহির এসব জানে না। জানানোর সাহস আমার হয়নি। আহিরের মুখের দিকে তাকালেই এক ধরনের ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যাই আমি। হারিয়ে ফেলার ভয়।

ঐদিন চা খেয়ে চলে আসার পর আর আহিরের বাসায় যাই না আমি। নয়

‘বাঁপাশে সমুদ্র আর ডানপাশে মরুভূমি, হায়!

একচক্ষু হরিণীরা তবু কেন মরে পিপাসায়?’

‘ভাইসকল, এই প্রশ্নের উত্তরটা কেউ দিতে পারবেন আপনেরা? বলেন, কেন মরুভূমি আর সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণীরা পিপাসায় মারা যায়? আপনারা বুদ্ধিমান। এই প্রশ্নের উত্তর আপনেরা পারবেন। আমার মতো কমবুদ্ধির মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর কখনো পায় নাই। এখন আপনেরা ভরসা।’

বলতে বলতে সুবিদ আলী তার মূল খেলা শুরু করে দেন-‘ভাইসকল, এই যে দেখতেছেন, আমার পোলারে আমি দুধসাদা কাপড় দিয়া ঢাইকা দিলাম। বলতে পারেন, কাফনের কাপড়ে মোড়াইলাম। আর কিছুক্ষণ পরেই কবর হইব। এই যে দেখেন, আমার পোলায় এখনো বাঁইচা আছে। আপনেগো চউখের সামনেই তো অরে বাঁধলাম। বান্ধন মনে হইতেছে শক্ত হয় নাই। নড়তেছে।... ঐ, চুপ কর! নড়বি না একদম। খাঁড়া, তোর নড়নচড়ন বন্ধ করতেছি। আর কিছুক্ষণ। এই যে টিপু সুলতানের তলোয়ার। এই তলোয়ার দিয়া আইজ তোরে কতল করব।

‘ভাইসাহেবরা, আর একটু অপেক্ষা করেন। রায় হয়া গেছে, এখন কার্য সম্পাদন হইব। সামান্য কিছুক্ষণ। তার আগে আপনেগোরে নতুন কিছু তথ্য জানাই। এই যে, আমার হাতে লম্বা, পুলসিরাতের মতো ধারালো তলোয়ার দেখতেছেন, এইটা মহামতি টিপু সুলতান ব্যবহার করছেন। টিপু সুলতানরে তো আপনেরা সবাই চেনেন। টিপু সুলতানের ইতিহাস নিচ্চয়ই জানেন। মহামতি টিপু সুলতান। মহাবীর টিপু সুলতান। এই তলোয়ারখান দিয়াই তিনি ইংরাজগো বিরুদ্ধে খাড়াইছিলেন। সেই মহান বীরের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়া আসেন, আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’ এক মিনিট নীরবতা পালিত হলো। তিনি পুনরায় শুরু করলেন- ‘টিপু সুলতানের এই তলোয়ার আপনেরা দেখতেছেন, এইটা যে আপনাদের কত বড় সৌভাগ্য, সেইটা আপনেগো ধারণায়ও নাই। যাই হউক, আরেকখান প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আমি রাস্তার ফকির। রাস্তায় রাস্তায় জাদু দেখাই। আপনারা দুইটা-চাইরটা পয়সা দেন, তাই দিয়া পেটে দুইটা অন্ন দিতে পারি। আমি টিপু সুলতানের তলোয়ার কই পামু? ভণ্ড ভাবতেছেন হয়ত! আমার মতন রাস্তার পিঁপড়া, যারে আঙ্গুলের একখান টিপে না মাইরা আপনারা বাঁচায়া রাখছেন, সেইটা আমার সাতকপাল। তাহলে এমন মিছা গল্প মারি কোন সাহসে?

‘ভাইসব, আমি মিছা কথা বলি না। আসল কথা হইল, আমরা টিপু সুলতানের বংশধর। মাতুল গোত্রে, মানে টিপু সুলতানের মায়ের দিক দিয়া। আইজ ভাইগ্যের ফেরে আমাগো রাজত্ব নাই। পথে পথে মানুষরে মজা দিয়া, আনন্দ দিয়া, ভেল্কি দেখাইয়া পয়সা উপার্জন করি। কিন্তু ভাই, বিশ্বাস করেন, এই যে আমার হাতের তলোয়ার, রাজরানীর দাঁতের মতন চকচকা তলোয়ার, এইটা দিয়া টিপু সুলতান স্বয়ং যুদ্ধ করছেন। এই বাঁটে শক্ত কইরা হাত রাইখা ইংরাজগো লাল প্যান্ট ভিজায়া দিছেন।

‘যাই হউক, দেখেন, এই তলোয়ার এখন সোজা আমার পোলার পেটে ঢুকায়া দিমু। ও অপরাধী। ভয়ংকর অপরাধী। অর শাস্তি প্রাপ্য। এই যে দেখেন, দিলাম ঢুকায়া টিপু সুলতানের তলোয়ার-’ সুবিদ আলী ঘ্যাঁচ করে সাদা কাপড়ের উপর দিয়ে আন্দাজ করে তলোয়ার চালালেন। পরপর দুবার। মুহূর্তেই সাদা চাদর লাল টকটকে হয়ে উঠল। কাপড়ে মোড়ানো দশ-এগারো বছরের বালকটি ছটফট করতে লাগল কাটা মুরগীর মতো।

তৃতীয়বার তলোয়ার চালানোর পর সুবিদ আলী জনতার দিকে তাকালেন। সবার মুখ ফ্যাকাসে এবং সাদা। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সবাই। দু-চারজনকে অবশ্য অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক দেখা গেল। সুবিদ আলী ‘নিশ্চিত’ যে এরা এই ম্যাজিক আগেও কোথাও না কোথাও দেখেছে। নইলে এত শক্ত কলিজা এই দেশে কারো থাকার কথা না। কিংবা কে জানে, মানুষ ক্রমাগত পিশাচ হয়ে যাচ্ছে কি না। পাঁচ বছর আগের সেই পৈশাচিকতা যারা দেখেছে তারা কেউ কি মানসিকভাবে সুস্থ আছে? থাকা সম্ভব?

নিজেকেও পিশাচের বাইরে ভাবে না সুবিদ আলী। নইলে মাহমুদকে নিয়ে, নিজের কলিজাসম পুত্রকে নিয়ে কোনো মানুষ এসব বিপজ্জনক খেলা দেখাতে পারে!

মিনিটখানেক পর পুত্রের ছটফটানি কমে এল। চতুর্থ মিনিটের মাথায় নিস্তেজ হয়ে গেল সম্পূর্ণ। এখন একটা দলার মতো পড়ে আছে লাল-সাদা চাদরে মোড়া বালকটি।

একটু সময় নিয়ে সুবিদ আলী আবার শুরু করলেন- ‘ভাইসকল, আপনেরা দেখলেন আমি নিজ হাতে আমার পুত্ররে হত্যা করলাম। বড় সাধের পোলা আছিল। কিন্তুক কী করব, আপনেরাই বলেন। পাপ ! ভয়ংকর পাপ করছে। কী পাপ, কেউ জিজ্ঞেস কইরেন না। আমি বাপ হয়া পোলার এই পাপের কথা আপনেগো সামনে উচ্চারণ করতে পারব না।

‘কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারেন, পাপ করছে ভাল কথা। এখন তো রাষ্ট্র স্বাধীন। রাষ্ট্র শাস্তি দিবে। তুমি শাস্তি দিবার কে? এর যৌক্তিক কোনো উত্তর আমার কাছে নাই। তবে উত্তর একখান আছে।

‘আমার এই পোলা বহু মানতের ফল। মহান আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি কইরা আমার বউ অরে কোলে ধরছে। সেই পোলারে আমি কীভাবে অন্যের হাতে তুইলা দিই মারার জন্য? কইলজা পুড়ে। যা-ই হউক, পাপ করছে, শাস্তি তো পাইবই। এই মৃত্যুই তার শাস্তি। এবার আপনেগো প্রতি কিছু প্রশ্ন আছে আমার তরফ থেইকা। আপনেরা জ্ঞানী-গুনী মানুষ, আপনেরাই পারবেন সঠিক উত্তর দিতে। আমার মতো মূর্খ মানুষের আপনেরাই ভরসা।

‘আছিলাম টিপু সুলতানের বংশধর, এখন কপালদোষে ভেল্কিবাজ। আপনেরাই দেখেন এইটা কোনো ভেল্কি কি না! আপনেগো চোখের সামনে আমার পোলাডারে হত্যা করলাম। তলোয়ার এখনো পেটে ঢুইকা আছে। আপনেরাই দেখতেছেন। এইটা কি ভেল্কি? এইটারে ভেল্কি বলবেন? আপনেরা চাইলে লাশ ছুঁইয়া দেখতে পারেন-’ তিনি পুত্রের নিথর দেহ তুলে নিলেন দুই হাতে। শরীরের নিচের ঘাসগুলি সামান্য থেঁতলে আছে। রক্তে টইটম্বুর। কাপড়ে মোড়া লাশের কপাল বরাবর একটি চুমু খেলেন। তারপর চক্কর কাটতে লাগলেন বৃত্তাকার ভঙ্গিতে দাঁড়ানো জনতার সামনে, ধীরে ধীরে। জানতে চাইল কেউ ছুঁয়ে দেখতে আগ্রহী কি না। কাউকেই আগ্রহী দেখা গেল না। সবাই ভয় পেয়েছে।

সবার সামনে একবার ঘুরিয়ে এনে আবার আগের জায়গায় শুইয়ে দিলেন সুবিদ আলী, তার বালকপুত্রকে। নিথর। পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন- ‘আপনেরা কিন্তু ভুলে গেছেন যে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাইছিলাম। যা-ই হউক, প্রশ্ন শুরু করি। ধরেন কোনো মানুষের অপরাধের বিচার হইল। শাস্তিও সম্পাদন করা হইল। এখন কি ঐ লোকরে আর অপরাধী বলা যাইব। সে তো শাস্তি পাইছে। আপনেগো বিবেক কী বলে?... চুপ কইরা আছেন কেন? যাইব তারে অপরাধী বলা? বলেন-’

ভিড়ের মধ্যে থেকে ক্ষীণ সাড়া পাওয়া গেল, ‘না।’

‘তাইলে আপনেগো বিচারেই আমার পোলার পাপ কাটা গেল। শাস্তি হইছে, আমার পোলা এখন পুরা নিরপরাধ। কী বলেন?’

এবারো সবাই সপক্ষেই রায় দিল।

‘হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। এখন যদি কোনোভাবে আমার পোলায় তাঁরই কোন ইশারায় বাঁইচা ওঠে তাইলে আর পুরান পাপের ভার কালা মেঘের লাহান মাথায় নিয়া তারে ঘুরতে হইব না। কী বলেন আপনেরা?’

এবারও সপক্ষে রায়। আস্তে আস্তে জোরালো হচ্ছে আওয়াজ। সবার ভয় কেটে যাচ্ছে। ক্ষত থেকে বের হওয়া রক্তের মতো বেড়ে উঠছে কৌতূহল। এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে আগের কথার খেই ধরলেন সুবিদ আলী- ‘ভাইসব, আমরা গরীব মানুষ। একবেলার খাবার জোটাইতেই কষ্ট হয়। পেটে পাথর বাইন্ধা পইড়া থাকি। পোলারে খাওন দিতে পারি না। এইভাবে বাঁচার চাইতে মইরা যাওয়াই ভাল। তয় আপনেরা যদি দুই-চাইর টাকা দয়া কইরা দেন, আমার পোলার পেটে দুইটা ভাত যাইব। পোলা আমার বাঁইচা থাকার আনন্দ পাইব। এখন সব আপনেগো উপরে। আপনেরা যদি চান যে ও আবার বাঁচব, হাসব, খেলব- যদি চান আবার চঞ্চল হইয়া, ছটফট কইরা আমার পোলাটা ছুটাছুটি করব তাইলে যে যা পারেন কিছু দেন। দুই আনা, চাইর আনা, দশ পয়সা, এক ট্যাকা-যে যা পারেন।’ সবাই তাকিয়ে আছে। কেউই খুব আগ্রহ প্রকাশ করছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ একটা পাঁচ পয়সার কয়েন কেউ ছুড়ে দিল ভিড়ের মধ্য থেকে। কয়েনটা মুহূর্তের জন্য ঝিক করে এসে নিথর দেহের পাশেই পড়ল। পরমুহূর্তেই তুমুল আগ্রহে টাকা-পয়সা ছুড়ে মারতে লাগল মানুষ। দেখতে দেখতে পয়সা আর টাকায় ঝলমল করতে লাগল ঘাস। আনন্দিত মুখে সব জড়ো করে একটি পুঁটলিতে বাঁধলেন সুবিদ আলী।

‘আপনেগো মুখের দিকে তাকায়া আবার বাঁচাইতে মন চাইতেছে পোলাটারে। কিন্তুক আমি তো বাঁচানোর কেউ না। বাঁচানোর মালিক ওই যে, তিনি। আপনেরা সবাই একমনে দোয়া করতে থাকেন আমার পোলাডার জন্য। দেইখেন, আপনেগো দোয়ার জোরেই সর্বশক্তিমান আল্লাহপাক দয়া করবেন,’- বলতে বলতে হ্যাঁচকা টানে তলোয়ারটি উঠিয়ে আনলেন তিনি- মাঝখান থেকে ডগা পর্যন্ত টকটকে লাল রক্ত।

সবাই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত প্রার্থনা করছে। দেড় মিনিটের মাথায় নড়ে উঠল লাল-সাদা কাপড়। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল তার আট-দশ বছরের পুত্র। সবার সামনেই সুবিদ আলী শক্তভাবে বেঁধেছিলেন পুত্রকে। হাত-পায়ের সেই বাঁধন নিজে নিজেই যেন কীভাবে খুলে ফেলেছে পুত্র। জনতার মধ্যে একটা হর্ষধ্বনি বয়ে গেল। সবাই খুব হাততালি দিতে লাগল।

সুবিদ আলীর মন চলে গেল বাড়িতে। সকালে বের হওয়ার আগে দেখে এসেছে পারুল কচুশাক তুলে আনছে। চাল কিনে নিতে হবে। রান্নাবান্না সুবিদ আলী নিজেই করেন। স্ত্রী বেঁচে নেই। একটা সন্তান হতে তুলে দিয়ে মারা গেছেন। সেই সন্তান ছ বছর বয়স থেকে অন্ধ।

পারুলের বয়সও দশ-এগারো বছর। বছর দুয়েক আগে সুবিদ আলী তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সেই থেকে পারুল তার কাছেই থাকে। পারুলকে নিয়ে মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটে রেখেছেন তিনি। আর বছর আষ্টেক পরে মাহমুদ আলীর সাথে পারুলের বিয়ে দিয়ে দেবেন। পারুলকে তিনি গড়ছেনই এমনভাবে, যাতে মাহমুদের উপরে পারুলের ভালোবাসা তৈরি হয়। নইলে অন্ধ ছেলের জন্য ভালো একটি মেয়ে কই পাবেন তিনি? কে স্ত্রী হয়েও মাতৃস্নেহ ঢেলে দেবে অন্ধ মাহমুদের উপরে?

অন্যকে কৌশল দেখাতে দেখাতে সুবিদ আলী হারিয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। স্বপ্নে স্পষ্ট গরম ভাত। ভাবছেন সাহস করে একটা পাঙাস মাছ কিনে ফেলবে কি না।

গরম গরম ভাত। মাড় ফুটছে। ঢাকনা সরে গেল। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সাদা মাড়। পাশেই লাফাচ্ছে জ্যান্ত পাঙাস মাছ। নদীর মাছ।... বালক তখন টলছে। তার সাদা গেঞ্জি ভিজে আছে রক্তে। রক্ত ঝরছে তীব্র স্রোতের মতো। সবাই খুব উপভোগ করেছে। হাসছে। এটাকে এখন তারা খেলা হিসেবে নিয়েছে। তাদের হাসি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল।

বালক টলছে। মুহূর্তেই স্বপ্ন উবে গেল সুবিদ আলীর। সবকিছু ছকমতো হচ্ছে না। কোথাও একটা সুতা কেটে গেছে। কিছু একটা আন্দাজ করলেন তিনি। আর তখনই ভেল্কিবাজের মুখোশ মুখ থেকে আছড়ে পড়ল তার।

এক লাফে গিয়ে পুত্রকে যে ভঙ্গিতে ধরলেন সেটি কোনো ভেল্কিবাজের ভঙ্গি নয়, স্রেফ এক পিতার ভঙ্গি। চারপাশের ভিড় হাসছে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতে তখনো ঝিকঝিক করছে বিখ্যাত টিপু সুলতানের তলোয়ার।

...মাথার মধ্যে স্পষ্ট হাসির শব্দ নিয়ে জেগে উঠলেন অন্ধ মাহমুদ আলী। অনেকদিন বাদে এমন স্পষ্ট স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন দেখা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে যা দুয়েকটা স্বপ্ন তিনি দেখেন- সেসব অন্ধকারের স্বপ্ন। অন্য এক জগত। সে জগত শব্দময়। সেখানে দৃশ্যের কোনো স্থান নেই। অনেকদিন বাদে বাবাকেও দেখলেন। মৃত মানুষকে স্বপ্ন দেখায় আনন্দ বোধ করার কিছু নেই। এর সহজ একটা মানে যে মন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এখন শরীরকেও প্রস্তুত করো। মাহমুদ আলী শরীরকে প্রস্তুত করার প্রস্তুতি নিলেন। (চলবে) রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৭/তারা