শিল্প ও সাহিত্য

যুদ্ধদিনের গল্প || লাল সোয়েটার

||হামিম কামাল||

একতলা টিনশেড বাড়ি। রোজার ঈদের আগের রাতে তার সামনের দেয়ালে রং লেপে ফুল লতাপাতার ইচ্ছেখুশি নকশা আঁকা হয়েছিল। রঙের সঙ্গে আঠার ভালো সখ্য জমে ওঠে নি। তাই গোটানো পাটির মতো উঠে আসছে। দেয়ালের ঠিক মধ্যখানে দরজা রেখে দুপাশে চৌকো জানালা কাটা। একটায় লোহার শিকের পেছনে কালো কাচে চালতা গাছের বিম্ব পড়েছে। অপরটার পেছনে বারান্দা, আয়তাকার। সেখানে গ্যাসের সংযোগ পাইপের সঙ্গে বাঁধা একটা সাইকেল। ভেতর থেকে আসা বাল্বের আলোয় তার লালরঙা লাস্যের কিছুটা ধরা পড়েছে। বারান্দার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে এগার বারো বছরের এক কিশোর। একপাশে সিঁথি, গোলগাল মুখ। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, বাঙ্ময়। তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তায়। ওখানে বৈদ্যুতিক থামে লাগোয়া টিউববাতির নীলসাদা আলোর নিচে তারই বয়েসী কয়েকটি কিশোর বিচিত্র এক কাজে নিবিষ্ট। ওদের ভেতর থেকে একজনই কেবল, থেকে থেকে মুখ তুলে অবরুদ্ধ কিশোরটির দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিচ্ছে। মরচে ধরা শিক কোমল দুটি মুঠোয় বন্দি। এক পা দিয়ে অপর পায়ের পেছনে চুলকে সঙ্কোচ কাটিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী করছ? 

কেউ তার কথার কোনো উত্তর দিলো না।

সরু গলি বলে বাইরের বড় যানবাহনের এখানে প্রবেশনিকেশ নেই। মাঝে মধ্যে একটা দুটো সাইকেল, রিকশা ওদের পাশ কাটিয়ে আগপিছ করছে। কাজে নিবিষ্ট ছেলেগুলোর আঙুল ভাতের আঠায় আঠাল। বাতাসে একটা সেদ্ধশর্করার ঘ্রাণ। দ্বিতীয় কিশোর খুলে পড়তে থাকা তার মাফলার কাজ থামিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে নিলো। সেই অবসরে ফের দৃষ্টিবিনিময়। বারান্দার কিশোর বলে উঠল আবার, কী করছ? হুম?

এবার অন্য ছেলেগুলোও মুখ তুলে তাকাল বারান্দার দিকে। দ্বিতীয় দফায় মাফলারওয়ালা কিশোরের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো, কথা যদি বলার হয় তো তাকেই বলতে হবে। এরপর সে ভাঙা গলায় বলে উঠল, পতাকা লাগাই। কাল বিজয় দিবস। তোমাদের ছাদের ওই কারেন্টের ডান্ডা আছে না? ওখানেও লাগাব। সুতো যাবে তোমাদের ওখান থেকে আমাদের বাসার ছাদে।

ছেলেটা আঙুল তুলে ঠিক অপরদিকের বাসার ছাদ দেখাল।

কেন পতাকা লাগাচ্ছ?

তুমি জানো না কাল ষোলই ডিসেম্বর? বিজয় দিবস?

তাই তো! কাল বিজয় দিবস!

একটা বড় ভারি চালতাপাতা পথের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। তার ওপর দিয়ে চলে গেল সাইকেলের একজোড়া চাকা। শব্দ হলো দুবার। আকুলকণ্ঠে প্রথম কিশোর বলে উঠল, আমি, আমি কি আসব তোমাদের সঙ্গে? আমাকে লাগাতে দেবে একটু?

লম্বা এক পাটের দড়ির সবটাজুড়ে পতাকার একপাশ আঠায় সাঁটা হয়ে গেছে। আরো অনেক দড়ি পড়ে আছে তখনো। মাথায় উলের টুপি পরা একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝাড়ল বারকয়েক। এরপর বারান্দার দিকে তাকিয়ে অলস কণ্ঠে বলল, চলে এসো। এখনো অনেক সুতা বাকি। এই যে দেখছ পুরো রোড? আমরা পতাকা লাগিয়ে একেবারে ভরে ফেলব। ছেয়ে ফেলব। চলে এসো।

মাফলারওয়ালা কিশোরও বলল তখন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে এসো। বারান্দার ছেলেটাকে মিনিটখানেক আর দেখা গেল না। হঠাৎ ধাতব দরজার পেছনে ঢড়ং করে একটা শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। দেখল, ছেলেটা বেরিয়ে এসেছে।

পরনে হাফহাতা শার্টের ওপর একটা লাল সোয়েটার। কালো প্যান্টের ওপর একটা সবুজ টেনিস বল অ্যামবুশ করা। মাফলারওয়ালা সেদিকে এগিয়ে ওই অ্যামবুশটা ধরে দেখল। কিছু বলল না।

ছেলেটাকে কাছে ডেকে উলের টুপি পরা ছেলেটা আবার হাঁটু ভেঙে বসে একটা পাটের দড়ি হাতে নিলো। আঠার রূপালি হাড়িটা এগিয়ে নিয়ে এলো কাছে। বলল, এই এভাবে একপাশে আঠা নিয়ে রশির ওপর ঘুরিয়ে লাগিয়ে দেবে। সব দড়ি হয়ে গেলে শুরু হবে আমাদের আসল কাজ।

ফুল আঁকা ফুলহাতা গেঞ্জি পরা একটা ছেলে মুখ তুলে প্রতিবাদ করে উঠল। ঝোলানো বুঝি আসল কাজ? এটা লাগানো আসল কাজ তারচেয়ে! ঝোলাতে কি আর কোনো কষ্ট আছে? লাগাতেই তো আসল কষ্ট!

উলের টুপি পরা ছেলেটা হাল ছাড়ল না। ঠোঁট উল্টে বলল, কী বলছিস আবোল তাবোল। এই সব গ্রিল ধরে ঝুলে ঝুলে টাঙাতে হবে, সোজা ব্যাপার? এটায় শুধু আঠা লাগছে হাতে। আর তো কিছু না। এটা নিয়ে ছাদে ওঠো, টাঙাও। পাগল তুই!

বারান্দার সেই লাল সোয়েটারের কিশোর এরই মধ্যে বেশ চৌকস হয়ে উঠেছে। সবাই মিলে হাত লাগানোয় কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত পাটের দড়িতে পতাকা লাগানো হয়ে গেল। এবার ঝুলিয়ে দেওয়ার পালা।

বাতাসে হিম। চোখে চশমা পরা একটা ছেলের হঠাৎ বিষম কাশি শুরু হয়ে গেল। গলায় মশা ঢুকেছে! হাসতে হাসতে বলল ছেলেটা। কাশির দমকে চশমাটা চোখের ওপর থেকে নাকের ডগার দিকে নেমে এসেছে।

বারান্দার ছেলেটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে জমে ওঠা হাত-পা চালিয়ে রক্তচলাচল বাড়িয়ে নিচ্ছিল। মাফলারওয়ালা কিশোর তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আগে কোথায় থাকতে তোমরা?

মিল্কভিটার ঢাল। দ্রুত উত্তর দিলো ছেলেটা। তাকাতে থাকল বাকিদের মুখের দিকে, যেন আরো প্রশ্ন শুনতে উৎসুক। তার দেওয়া উত্তর শুনে চশমাপরা ছেলেটা মুখ তুলে বলল, ওখানে আমার মামাও থাকে। বন্যার সময় নাকি গেছে। আর আসে নাই। ওখানে তো পানি ওঠে না। তুমি ওখানেই পড়ো?

এমন সময় একটা রিকশা এসে ছোট ওই জটলার সামনে থামল। তুলে দেওয়া হুডের আড়াল থেকে দীর্ঘদেহী এক মানুষ নেমে এলো। মাথায় কালোর ওপর সাদা ছোপ দেওয়া মখমলের টুপি। উঁচু এবং পুরু। সাদা কাবুলি জামার পকেট হাতড়ানোর ফাঁকে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কিশোর মুখগুলো দেখতে থাকল লোকটা। টাকার ব্যাগটা পাওয়ায় দৃষ্টিনিক্ষেপে পড়ল ছেদ। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে লোকটা আবার তাকাল কিশোর মুখগুলোর দিকে।

লাল সোয়েটার পরা ছেলেটার চোখে অস্বস্তি। তার ওপর চোখ পড়ামাত্র লোকটার গম্ভীর, মসৃণ কণ্ঠ সচল হয়ে উঠল।

তুমি এখানে কী করছ? এই রাতের বেলা! চলো, ঘরে চলো আব্বু। ঠান্ডা বাইরে। খুব ঠান্ডা।

জানি তো ঠান্ডা! সে জন্যেই তো সোয়েটার পরে নেমেছি।

আসন্ন বিচ্ছেদ অনুমান করে ছেলেটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। পিছিয়ে গেল এক পা। তা দেখে চোখজোড়া সতর্ক হয়ে উঠল লোকটার। চকিতে তাকিয়ে দেখল অন্য কিশোরদের চোখের দিকে। এরপর ছেলেটার দিকে ফিরে বলল, হ্যাঁ, তা পরেছ বাবা। কিন্তু এরপরও চলো ভেতরে? নয়ত বাবা রাগ করব যে!

বিমর্ষ হয়ে ওঠা ছেলেটা আর তর্ক করল না। বারান্দায় ওর মা এসে দাঁড়িয়েছে তখন। দরজা ঠেলে বাবা আর ছেলে চলে গেল ভেতরে। ঘরে ঢোকার আগে লোকটা একবার পেছন ফিরে তাকাল। সঙ্গীবিচ্ছেদের বেদনায় কিশোরদের আর্ত মনে হলো না। তবে ওরা কৌতূহলী। ওদের সেই কৌতূহলী চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, তোমরাও ঘরে চলে যাও। দেখছ না কেমন শীত! যাও। আর পড়াশোনাও তো আছে।

গায়ে কালো বুশ জ্যাকেট পরা একটা ছেলে প্রথমবারের মতো মুখ খুলল। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা তো শেষ।

লোকটা আর কথা বাড়াল না। দরজা ভিড়িয়ে নিঃশব্দে ছিটকিনি আটকে ভেতরে চলে গেল। কাচের জানালাওয়ালা ঘরটায় আলো জ্বলে উঠল এবার। চালতাপাতার বিম্ব পড়া ওই কাচের কাছে দাঁড়ালে ভেতরের আলাপ কিছুটা শোনা যায়। ছেলেগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে জড়ো হলো ওখানটায়। শুনতে থাকল কথা।

কেন গেছ বাবা বাইরে?

এসময় একটা নারী কণ্ঠ এলো ওদের কানে। আমি বলেছিলাম, তোমার বাবা রাগ করবে। বলি নি তোমাকে?

ছেলেটা ধরা গলায় প্রতিবাদ করে উঠতে গিয়ে কী একটা অসমাপ্ত বাক্য একবার আউড়ে চুপ করে গেল। আর কোনো কথা শোনা গেল না। বাতি নিভে গেল সে ঘরের।

মাথায় উলের টুপি পরা ছেলেটা বলল, চল চল, অনেক কাজ। আসল কাজই বাকি আমাদের। দুই

জানালায় একটা আগুনে সকাল টের পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল রাতের লাল সোয়েটার। জানালার পর্দা ভেদ করে আম গাছের চিরলপাতার ছায়া এসে সাদা লেপের ওপর পড়েছে। বিছানার পাশেই পড়ার টেবিল। তার এক কোণে মসজিদের আকৃতি নিয়ে একটা অ্যালার্ম ঘড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখা গেল, ন’টা পেরিয়েছে সকাল।

মশারি তুলে ঠান্ডা মেঝেতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে রাতের কথা মনে পড়তেই ছুটল বারান্দায়। ঠান্ডা শিক ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছেলেটা অবাক হয়ে গেল।

মাথার ওপর ঠান্ডা হাওয়ায় তিরিতিরি দুলছে সবুজের জমিনে লাল টিপ পতাকার সারি। এ ছাদ থেকে ও ছাদ, ও ছাদ থেকে সে ছাদ। আর দূরে কোথাও পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে বাজছে। বাজছে আরো অনেক সুর। কোথাও মাইকের কাছে মুখ নিয়ে কেউ কবিতা আবৃত্তি করছে। আবৃত্তির পেছনে বাজছে বাঁশির সুর। ছেলেটা মুখ হাসিতে ভরে উঠল। চোখ নামিয়ে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। হঠাৎ, ভাবনার ভাগ আর কাউকে দেবে না এমন ঢঙে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল ভেতরের ঘরে।

ধাতব দরজা খোলার ঢড়ং শব্দে চমকে লাফিয়ে সরে গেল শুকনো কালো এক কুকুর। কপাট ফাঁক করে বেরিয়ে এলো ছেলেটা, পরনে রাতের লাল সোয়েটার। হাঁটতে গিয়ে টের পেল হুড়োতাড়ায় পায়ের পাটি গুলিয়ে ফেলেছে। দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। বলল, বদলে পরে নাও। সাবধানে যেও! গাড়ি দেখে! কুকুরটা জুলুজুলু চোখে ছেলেটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকল।

রাস্তার মাথায় পৌঁছে একটা মুদির দোকানের সামনে গিয়ে থামল লাল সোয়েটার।

এই যে ভাই, পতাকা আছে না?

সায় জানিয়ে বলল দোকানি, কয়টা দেবো বাবু? লোকের উরুর ফাঁক গলে মাথা ঢোকানো বালকের ফোলা দুটো গাল দেখে তার চোখে মায়া তরঙ্গিত। 

ওই যে, এক বান্ডিল! ক’টা থাকে? কত টাকা?

একশটা থাকে। এই নাও।

কত টাকা? বলতে বলতেই ছেলেটা পায়ের পাতা উঁচিয়ে দোকানের ঘের পেরিয়ে দোকানির হাতে তুলে দিলো ছোট একটা নোট। দোকানি হেসে বলল, আর লাগবে না থাক, যাও। ছেলেটা দোকানের সামনে থেকে সরে এসে একটা ছোট বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে গুনতে লেগে গেল, এক দুই তিন! সত্যিই একশটা পতাকা পেয়ে তার বিপুল হয়ে ওঠা মনটা চোখের আলোয় ধরা পড়ল। হেলে দুলে হেঁটে রাতের লাল সোয়েটার পৌঁছে গেল তার বাড়িতে। রান্নাঘরের দেরাজ খুলে একটা সবুজ টিউব পাওয়া গেল, অব্যবহৃত, যেন তার জন্যেই এনে রাখা। এরপর রাতের বন্ধুদের শেখানো পন্থায় আঠা লাগিয়ে দরজা জানালার চৌকাঠ থেকে শুরু করে খাটের রেলিঙে, বড় বোনের ঘরের বন্ধ দরজার গায়, রান্নাঘরের কপাটহীন জানালা শিকে, বারান্দার গ্যাস সংযোগের ধাতব শরীরে, বেঁধে রাখা সাইকেলের বারে, যেখানে পারল এবং কল্পনা করে ভালো লাগল সেখানেই পতাকার একপ্রান্তে আঠা লাগিয়ে সেঁটে দিলো। কোথাও বিছানার ওপর উঠতে হলো, কোথাও চেয়ার দরকার হলো। কোথাও আবার কেবল আঙুলের ওপর দাঁড়িয়েই কাজ হলো সারা। গোটা সময়টা মা ঠোঁটে হাসি আর ভুরুতে উদ্বেগ নিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে তার উচ্ছ্বাস দেখে গেল, কিছু বলল না।

পতাকার যোগানে যখন টান পড়ল, তখনই কেবল নিরস্ত হলো কিশোর। বাসার সামনে দিয়ে তখন এক সচল তিনচাকার যানে রেকর্ড বাজছে- জয় বাংলা, বাংলার জয়! এসময় সামনের ঘরের পর্দার ফাঁক গলে দেখা গেল, বাইরে, রাস্তায়, রাতের সেই মাফলারওয়ালা ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। লাল সোয়েটার তখন দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ডাকল তাকে। এই! এই! দেখবে আমি কী করেছি? দেখবে?

মজার একটা কিছুর আভাস পেয়ে ভুরুতে কৌতূহল নিয়ে ছেলেটা এগিয়ে এলো। কাছে এসে কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কাল মেরেছে?

না মারে নি। শুধু বকেছে। দেখবে আমি কী করেছি? তুমি দেখতে চাও?

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখতে চাই। মারে নি বলছ!

না না! আজকে সকালে আমি একটা কাজ করেছি। এসো। এসো।

সশব্দে দরজা খুলে মাফলারওয়ালা ছেলেটাকে আহ্বান করল লাল সোয়েটার। ছেলেটা ঘরে ঢোকার আগমুহূর্তে অদূরে রাতের কানটুপিকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকল। সোয়েটারের দিকে তাকিয়ে বলল, দাঁড়াও। আমার বন্ধুও দেখবে কী করেছ!

ঘরের ভেতরে ঢোকার পর মাফলার আর কানটুপির মুগ্ধতাঝরা চোখগুলো দেখে লাল সোয়েটার বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। কানটুপি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, তুমি একা করেছ!

হ্যাঁ, একা।

ধাতব দরজায় আঙুল দিয়ে ছন্দিত টোকার শব্দ পাওয়া গেল এসময়। টোকার বিশেষ এই রীতি ছেলেটার চেনা।

মাফলারওয়ালা বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করল তাকে, তুমি বাইরে যাবে? আমাদের সঙ্গে? চলো, আমরা পুরো রূপনগর ঘুরে ঘুরে দেখব। অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। দেখবে? তোমাদের আগের ওখানে কি হতো এমন?

লাল সোয়েটার ওর কথার উত্তর দিতে পারল না। ওর সজীব মুখে একটা ভীতির ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াটা সে ঢাকতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আর আগতদের চোখেও তা ধরা পড়ল। লাল সোয়েটার আঙুল তুলে ধসে যাওয়া ফোমের সোফা দেখিয়ে বলল, তোমরা বসো। যেও না কিন্তু।

কথাটা শুনে ঘাড় কাত করল বটে মাফলার, তার দেখাদেখি কানটুপিও, কিন্তু ভরসা পেল না। ওরা ভীত চোখে দরজার দিকে তাকাতে থাকল।

ভেতর থেকে মা বলল, কী হলো, খুলে দাও? তোমার বাবা!

দরজা খোলার পর রাতের সেই দীর্ঘদেহী লোকটা ঘরে এসে ঢুকল। চোখে আলো নেই। নবীন কিশোর দুটিকে দেখে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না প্রথমে। এরপর হাসির মতো একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। দরজা খোলা পেয়ে ছেলে দুটো বেরিয়ে গেল তখনই। লাল সোয়েটার একবার ওদিকে, আরেকবার লোকটার দিকে সন্ত্রস্ত চোখে বারকয়েক তাকিয়ে স্নায়ুর যুদ্ধে হার মানল। দ্রুতপায়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। বিছানায় উঠে কোলে একটা বালিশ নিয়ে বসে থাকল জানালাটার কাছে। দেখল, উঠোনে এক কাণ্ড ঘটে গেছে। কুয়োয় পড়ে যাওয়া একটা বেড়ালকে বালতি ফেলে তুলে এনেছে তার বোন। বোনের ঝলমলে হাসি দেখে লাল সোয়েটার মুহূর্তের জন্যে পাশের ঘর ভুলে গেল।

সূর্যের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে বোনের লালচে কালো চুল। বেড়ালটা থর থর করে কাঁপল কিছুক্ষণ। এরপর শরীরটা ঝাড়া দিয়ে বারকয়েক, হেঁটে আমগাছের গোড়ায় রোদে গিয়ে শরীর গুটিয়ে বসে পড়ল। ছেলেটার চোখেমুখে সকালে উচ্ছ্বাস ফিরে এসেছে। উচ্চকিত কণ্ঠে বলল, আপু, আপনি দেখেছেন ঘর? আপনার দরজায়?

হ্যাঁ, দেখেছি ভাইয়া, সব দেখেছি। খুব সুন্দর! খুব সুন্দর! 

পাশের ঘরে সোফায় বসে লোকটা চারদিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ চোখে পতাকা দেখছিল। অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস  ফেলে সোফায় পিঠ এলিয়ে ছাদের দিকে তাকালে দেখতে পেল, জানালাখোলা হাওয়ায় এপার ওপার করে দুলছে ঝুলন্ত দেখনশোভার নকল ক’গাছি ফুল। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা