শিল্প ও সাহিত্য

বিশ্ববরেণ্য কবিদের প্রেমের কবিতা: প্রথম পর্ব

আলেক্সান্দার পুশকিন

 

লিলি, লিলি! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি

হতাশায় আর আশাহীনতার অভিশাপে।

আমি ছিন্নভিন্ন আর আমি মরে যাচ্ছি,

আর আমার আত্মা তার দ্যুতি হারাচ্ছে,

কিন্তু আমার ভালোবাসা কোনো করুণার আহ্বান করে না:

তুমি আমাকে বেচারাই ভাবতে পারো।

হেসে যাও: তুমি সুন্দর

এমনকি যখন সহানুভূতিহীন তখনও।

 

আলেক্সাজান্দার সের্গেইভ পুশকিন  রোমান্টিক যুগের রুশ কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। এই মহান কবিকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক বলা হয়। পনেরো বছর বয়সে তার কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় এবং কলেজে থাকাকালে সে কবি হিসেবে সবার নজর কাড়েন। জারের রাজনৈতিক পুলিশরা তার উপরে নজর রাখতো। এ সময়ই তিনি তার বিখ্যাত নাটক ‘বসি গুডোনভ’ রচনা করেন। তার উপন্যাস ‘ইউজিন অনেজিন’ কাব্যে লেখা। তার স্ত্রীকে ফুসলানোর চেষ্টা করলে পুশকিন একজন ফরাসি কর্মকর্তার সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মারাত্মক আহত হন।

 

শার্ল বোদলেয়ার

 

কাকে তুমি ভালোবাসো সবচেয়ে বেশি, হেয়ালি মানব? তোমার বাবা?

তোমার মা, তোমার বোন অথবা তোমার ভাই?

‘আমার না আছে বাবা, না আছে মা, না বোন, না ভাই’

‘তোমার বন্ধু?’

‘এখন তুমি এমন এক শব্দ ব্যবহার করছো যার অর্থ আমি এখন পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি।’

‘তোমার দেশ?’

‘আমি জানি না কোন অক্ষাংশে তা অবস্থিত।’

‘সৌন্দর্য?’

‘আমি সানন্দে তাকে ভালোবাসতে পারতাম, দেবী আর অমরত্ব।’

‘স্বর্ণ?’

‘আমি এটাকে ঘৃণা করি যেমন তুমি ঈশ্বরকে করো।’

‘আচ্ছা, তাহলে কী তুমি ভালোবাসো, অদ্ভুত আগন্তুক?’

‘আমি ভালোবাসি মেঘেদের... ভাসমান মেঘেদের... ওইখানে... ওই উঁচুতে... ওই বিস্ময়কর মেঘেদের!’

 

ফরাসি কবিতায় শার্ল বোদলেয়ার এক সাহসী সম্রাট। কবিতাকে দিয়েছেন তিনি নতুন চেহারা ও মাত্রা। তার লে ফুল দ্যু মাল (শয়তানের ফুল) উনিশ শতকের প্যারিসের শিল্প-কারখানার বদল যেমন তুলে ধরে তেমনি নবতর নন্দন ভাবনাকেও চিত্রিত করে। বোদলেয়ারের শক্তিশালী এবং মৌল চিন্তাভাবনা পল ভেলেরি, আর্তুর র‌্যারো, স্টিফেন মার্লার্মে তথা ফরাসি কবিতাকেই প্রভাবিত করেছে।  আজকের আধুনিক কবিতার বিশ্বব্যাপী বিস্তারে তার ভূমিকা অনন্য। এমনকি সাহিত্যে আধুনিক শব্দটির (modernité) আনুষ্ঠানিক ব্যবহার এবং আধুনিকতার চর্চাও তার হাত ধরে সূচিত হয়েছে। কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ ও শিল্প সমালোচনাও করেছেন এবং এডগার এলান পো’র বহু লেখা অনুবাদ করেছেন।

 

পাবলো নেরুদা

 

যখন আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারি না

আমি তখন তোমার পা দেখি।

ধনুকের হাড়ের মতো তোমার পা,

তোমার শক্ত ছোট্ট পা।

আমি জানি ওরা তোমাকে অবলম্বন দেয়

এবং তোমার মিষ্টি ওজন

ওদের উপর দাঁড়িয়ে থাকে।

তোমার কোমর আর তোমার বুক

দোহারা বেগুনি

তোমার স্তনবৃন্ত

তোমার চোখের কোটর

যা এই মাত্র দূরে উড়ে গেলো,

তোমার প্রসারিত ফলের মতো মুখ,

তোমার লাল বিনুনি

আমার ছোট্ট দূর্গ।

কিন্তু আমি ভালোবাসি তোমার পা

কেবল এই কারণে যে ওরা হাঁটে

পৃথিবীর উপরে এবং

বাতাসের উপরে এবং জলের উপরে,

যতক্ষণ না আমাকে খুঁজে পায়।

 

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ভাষায় বলতে গেলে পাবলো নেরুদা হলেন ‘বিশ শতকের যে কোনো ভাষার মধ্যেই মহত্তম কবি।’ চিলির এই কবির আসল নাম হলো নেফতালি রিকার্ডো রেইয়ে বাসোআলতো। তিনি তার দেশের আরেক কবি জেন নেরুদা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের নাম পাবলো নেরুদা রাখেন। মজার বিষয় হলো, জেন নেরুদা তেমন পরিচিত বা সফল কবি নন। অথচ পাবলো নেরুদা তরুণকালেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে লেখা তার কাব্যগ্রন্থ ‘টোয়েন্টি লাভ পোয়েম আ সঙ অব ডিজেপায়ার’ পাঠকপ্রিয় হয়। তিনি সব সময় সবুজ কালি দিয়ে লিখতেন, বলতেন এটা তাকে প্রেরণা দেয়। অন্যদিকে তার কবিতাও চির সবুজের আশা-প্রেরণা-ভালোবাসা লক্ষ্যণীয়। ভালোবাসার কবিতা, পরাবাস্তব কবিতা, ঐতিহাসিক কিংবা রাজনৈতিক কবিতা- সকল ক্ষেত্রেই তিনি অসংখ্য সফল কবিতার জন্ম দিয়েছেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন, কূটনৈতিক হিসাবেও কাজ করেছেন। ‘দ্য হাইট অব মাচুপিচু’ ‘১০০ লাভ সনেট’ ‘দ্য বুক অব কোশ্চেন’ ‘দ্য ইয়েলো হার্ট’ ‘স্টোনস অব দ্য স্কাই’ ‘অন দ্য ব্লু শোর অব দ্য সাইলেন্স: পোয়েমস অব দ্য সী’ ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।

 

নিজার তৌফিক কাবানি

 

যখন একজন মানুষ প্রেমে পড়ে

তখন সে কী করে পুরনো শব্দগুলো ব্যবহার করবে?

একজন নারীর কি উচিত

প্রত্যাশা করা যে তার প্রেমিক

শুয়ে আছে

ব্যাকরণ আর ভাষাতত্ত্বে?

 

আমি কিছুই বলিনি

আমার ভালোবাসার নারীকে

কিন্তু জড়ো করেছিলাম

ভালোবাসার সব বিশেষণ একটা স্যুটকেসে

এবং তারপর ভাষা থেকে উড়াল দিয়েছিলাম।

 

নিজার তৌফিক কাবানি একই সঙ্গে সিরিয়ার একজন কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি এবং প্রকাশক। তার কবিতায় খুব সরলভাবে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা, নারীবাদ, ধর্ম এবং আরব জাতীয়তাবাদ উঠে আসে। বিংশ শতকের আরবী সাহিত্যে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। নিজার কাবানি’র বয়স যখন ১৫ তখন তার ২৫ বছরের বোন আত্মহত্যা করে। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে না-পারাই এর কারণ। বোনের জানাজায় দাঁড়িয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এ সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। তাকে বিপ্লবী বলা হলে তিনি বলেন: ‘‘আরব বিশ্বে ভালোবাসা হলো কারাবন্দী, আমি তাকে মুক্ত দেখতে চাই। আমি আমার কবিতা দিয়ে আরবের আত্মা, বোধ আর শরীরকে মুক্ত করতে চাই। আমাদের সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কটি স্বাস্থ্যকর নয়।’ তার সময়ের অন্যতম প্রাজ্ঞ এবং গভীর নারীবাদী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করেন কেউ কেউ। ১৯৬১ সালে আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ তাকে প্রভাবিত করে। তিনি তীব্র রাজনীতি সচেতন কবিতা লিখতে থাকেন।

 

সাফো

 

ভালোবাসা আমার হৃদয় ঝাকাচ্ছে,

যেমন পাহাড়ি বাতাস

যন্ত্রণা দিচ্ছে ওক গাছগুলোকে।

 

সমালোচকদের বিবেচনায় সাফো (৬৩০-৫৭০ খ্রিস্টপূর্ব) বিশ্বের প্রথম নারী কবি। কিন্তু তাকে বিচার করার এটিই প্রধান বিষয় নয়। বরং কবি হিসেবেই সাফো বিশ্ব কবিতায় এক বিশাল ব্যতিক্রম ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচ্য। গ্রীসের লেসবস দ্বীপে তার জন্ম। লেসবস সে সময় গ্রীসের জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র ছিলো। লেসবস দ্বীপের অধিবাসীদের লেসবিয়ান বলা হয়। সাফোর কারণেই পরবর্তী সময়ে ‘লেসবিয়ান’ শব্দটির ভিন্ন মানে দাঁড়ায়। নারী সমকামীকে লেসবিয়ান বলা হয়। সাফো তাই ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। তার কবিতাতেও নারীর প্রতি তীব্র প্রেম ও কামনা লক্ষ করা যায়।

 

এমিলি ডিকিনসন

হৃদয়, আমরা তাকে ভুলে যাবো

তুমি আর আমি, আজ রাত্রিতেই!

আমরা অবশ্যই ভুলে যাবো যে উষ্ণতা সে দিয়েছিলো

আমি ভুলে যাবো সেই আলো।

 

যখন তুমি প্রার্থনা করেছো বলো আমাকে,

তখন আমি, আমার ভাবনারা, ক্ষীণ হয়ে যাবে।

ত্বরা করো! অন্তত যখন তুমি ধীর হওয়া কিছুটা

আমি হয়তো মনে করবো তাকে।

 

পুরো মার্কিন সাম্রাজ্যে ওয়াল্ট হুইটম্যান আর এমিলি ডিকেনসনকে সবচেয়ে সেরা কবি মনে করা হয়। হুইটম্যানের মতো এমিলিও মার্কিন লেখক রাল্ফ এমার্সন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এছাড়া তার কবিতায় সতের শতকের ব্রিটিশ অধিবাস্তব (Metaphysical) কবিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যু, ভালোবাসা, প্রকৃতি- এসবই ছিলো তার কবিতার বিষয়াবলী। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গৃহস্থালি ভাষায় কাব্য রচনা করতেন তিনি। তার কবিতার সঙ্গে নিজের জীবনাচারের ঘনিষ্ঠ সহযোগ লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতায় বর্ণিত her own society-এর মতোই এমিলি আপন গহন জগতেই নিহিত থাকতেন। পরিবারের ঘনিষ্ঠ দুয়েকজন ছাড়া আর কারো সঙ্গে তাকে দেখাও যেতো না কখনো। ২৩ বছর বয়স থেকেই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন জীবন যাপন করতেন তিনি। এমনকি কবিতা ছাপানোর ব্যাপারেও তার মধ্যে কখনো কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। তার অধিকাংশ কবিতাই শিরোনামহীন। কবিতার প্রথম লাইন থেকেই শিরোনাম গ্রহণ করা হয়েছে।

 

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস

 

ভালোবাসা যমজ, সে একাকি নয়,

সোনা আর রূপা একত্রে মেশানো,

মিলেছে আসক্তি আর বেদনায়

ঝলমল করে চিরকাল সাজানো।

 

ঠিক বেদনা এটা নয়; হয়তোবা কিছুটা করুণা,

আকস্মিক যন্ত্রণা, সেও মরে যায় কিংবা পালায়

আসক্তি এটা নয়, অন্যায় কিছু কিংবা যথার্থই দৃঢ়তা

একজন তাৎক্ষণিক জন্মায়, আরেকজন তাৎক্ষণিক মরে যায়।

 

ভালোবাসা সে তো যমজ, সে তো একাকি নয়,

সোনা আর রূপা মিলেমিশে একত্রে রয়,

মিলে সে আসক্তি আর বেদনায়

ঝলমল করে চিরকাল সাজানো শয্যায়।

 

আধুনিক এবং চিত্রবাদী মার্কিন কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়াম কবিতার পাশাপাশি চিত্রকলাকেও গুরুত্ব সহকারে চর্চা করেছেন। তার কবিতায় চিত্রকলার প্রভাব পাওয়া যায়। তিনি কবিতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন, ইউনাইটেড স্টেটস পোয়েট লরিয়েট সম্মানও পেয়েছেন।

           

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা