শিল্প ও সাহিত্য

খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক: পাঠ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

মারুফ কামরুল: রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শুরু করি, ‘অন্তরের জিনিষকে বাহিরের, ভাবের জিনিষকে ভাষায়, নিজের জিনিষকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিষকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।’ তবে মনে রাখা দরকার এটাই সাহিত্যের একমাত্র সংজ্ঞা নয়। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শুরু করেছি এই জন্য যে, রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা সাহিত্যের নয় বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পের পুরোধা-পুরুষ। তাই রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথ দিয়ে আমি মোজাফ্‌ফর হোসেনের ‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’ বইতে প্রবেশ করা সহজ মনে করছি। রবীন্দ্রনাথের যে সংজ্ঞাটি উদ্ধৃত করলাম তা মূলত ছোটগল্পের নয়, সাহিত্যের। এবং বইটিকে প্রথমে সাহিত্য হিসেবে দেখতে চাইবো। 'খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক' পড়ে শেষ করলাম। গল্পগুলো আমাদের, দেখেছেন লেখক, তবে গল্প বলাবার ঢঙ লেখকের। প্রতিদিন খুন হচ্ছে মানুষ, এসব গল্প ঘটছে কিন্তু এই গল্পগুলোকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন গল্পকার তাঁর নিজস্ব ঢঙে। যেটাকে আমরা নির্মিতি বলে থাকি। প্রতিটি মূর্তির ভেতরে খড় থাকে এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি। খড় আর কাদামাটি হলো বাস্তবতা, আর বাকি সবটাই শিল্পী কল্পনার চোখে এঁকে নির্মাণ করেন। যার ফলে একই মাটি আর খড়ে তৈরি হয় বিভিন্ন দেব-দেবী। নির্মিতি বলে দেয় কাকে কীভাবে পূজা করতে হয়। নির্মাণ  জানা থাকলে কাদামাটি আর খড়ও শিল্প হয়ে উঠে এবং পূজনীয়ও হয়। লেখক তাঁর গ্রন্থের শুরুতে বলেছেন, কতটা বাস্তব আর কতটা তিনি নির্মাণ করেছেন। শিল্পের প্রয়োজনে শিল্পীকে নির্মাণ করতে হয়। অস্কার ওয়াইল্ডয়ের ভাষায় বলতে গেলে, ‘Literature (art) always anticipates life. It does not copy it, but molds it to its purpose.’ প্রথম গল্প, ‘স্মৃতির দরজা খুলে’ লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি নিয়ে লেখা। ভৌগোলিক ব্যাপারটা বাস্তব। বাকিটা নির্মাণ। পরের গল্পের চরিত্রটাও লেখকের দেখা কিন্তু ট্রাজেডি নির্মাণ করা। এভাবে তিনি নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করে তোলেন নির্মিতি দিয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথের বাক্য দিয়ে শুরু করলাম। এই গ্রন্থের তৃতীয় গল্প ‘অন্ধকারে বসে থাকেন বনসাই বাবা’ বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে যায়। গল্পে একজন বাবার পালাবদল নিয়ে খুব সুক্ষ্মভাবে শিল্পী এঁকেছেন একটি থমকে যাওয়া চিত্র। একজন যুবক-বাবা থেকে শিশু-বাবা হয়ে যাওয়া। বরং শিশু না বলে বলা যায় জড়তাখণ্ড। যেনো কথা বলা ঠিক হবে না, নুয়ে আসা গাড়, দৃষ্টিকে নত করা চোখ, খাটো হওয়া রথ, গম্ভীর হয়ে নিজের ভেতর নিজেকে লুকানো। যে বাবার পায়ের শব্দ শুনলেই আমাদের হাত থেকে অনেক কিছু পড়ে যেতো। সে বাবা নেই। যেনো বারবার কেটেছেটে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা বনসাই করা বাবা। বনসাই হয়ে বসে থাকে বাবা। 'বাবা কোথাও থাকলে সেখানে অন্যরা কথা বলার সুযোগ তেমন পেতেন না। সেই বাবা এখন শব্দহীন এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমি মানতে না পেরে উত্তেজিত কণ্ঠে শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করি, বাবা, তোমার সমস্যা কী? বাবা এবার মাথাটা একটু তোলেন। কিছু বলতে চান। আমি অপেক্ষা করি আগ্রহ নিয়ে।’ [অন্ধকারে বসে থাকে বনসাই বাবা] এখানেই গল্পের শেষ হলেও, পাঠকের ভাবনার শেষ হয় না। আরো ভাবতে চায় পাঠক। শুনতে চায় বাবার কথা। তবে গল্পটা আমাকে যতটা ভাবিয়েছে নামটা তাঁরচে’ বেশি ভাবিয়েছে। সার্থক নামকরণ। একটা বনসাই আমাদের ইচ্ছের বাইরে একটি নতুন পাতাও ধরে রাখতে পারে না। আমাদের ইচ্ছেয় ছোটখাটো হয়ে দূরের স্বাধীন বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় গর্জমান বাবা হয়ে যায় বনসাই গাছের মতো। লেখকের সচেতনতা এখানেই। তিনি উপমাটা যেমন যথাযথ দিয়েছেন তেমনি বনসাইকে গল্পের একটা উপকরণ হিসেবে সময় বুঝে ব্যবহার করেছেন। বাবাকে আর বনসাইকে মুখোমুখি বসিয়ে একটা গভীর বেদনার ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন। আমার মনে হয় দক্ষ হাতে কাজ করলে একটি চিত্রনাট্য হতে পারে। চমৎকার টিভি নাটক হবে। ছোটগল্পের প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী কথাটা মনে করা যাক, ‘ছোটগল্প ছোট এবং গল্প হওয়া চাই।’ তাহলে বইটির ‘চাকু’ ও ‘মুখোমুখি’ গল্পে চলুন। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন ‍অণুগল্পের ধাঁচে লেখক কীভাবে ছোটগল্প নির্মাণ করেছেন এবং চমৎকার গল্প ও আঙ্গিকও আছে। এবার ‍শিরোনামের গল্পের দিকে এগুতে চাই। ‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’ নামটা একটু ভালো করে দেখলে খেয়াল করবেন, ক্রিয়াকালটি চলমান বর্তমান। লেখক খুব কৌশলে এটি ব্যবহার করেছেন। এখানেই হলো লেখকের সচেতনতা। এখনো প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ খুন হচ্ছে, যাদের প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের সাদেক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে প্রথম স্তবকের পর কথকের মুখোশ পরে গল্প বয়ান করেছেন উপস্থিত জনতার সামনে। এই গল্পেও লেখক বয়ান-কৌশলে সাদেককে ‘আমাদের সাদেক’ করে তুললেন। এখানে লেখক পাঠকের খুব কাছাকাছি থেকে গল্প বয়ান করেছেন। গল্পগ্রন্থে ১৭টি গল্পই ভেতরে দাগ কেটে যায়। নতুন করে ভাবনা ও বোধের জায়গা তৈরি করে। এই গল্পগ্রন্থের  নামের দিকে আবারও লক্ষ্য করা যাক। প্রতিটি গল্পের শেষে আমাদের বোধ জানিয়ে যায় মানবতা খুন হলো কিংবা খুন হচ্ছে…। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নামকরণটাও বেশ চমৎকার এবং যুক্তিযুক্ত। গ্রন্থটিতে লেখক মোজাফ্ফর একটি চেইন মেনটেইন করে গল্পগুলো বলে গেছেন। একটা সময় তুলে ধরেছেন। বলা যায় সময়ের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে অনাগত কাউকে বলে যাচ্ছেন গল্প, এই গল্প পৃথিবীর এবং সকলের। গল্পগুলো এই ভূখণ্ডের হলেও লেখক তাঁর নির্মাণ-কৌশলে বিশ্ববাসীর গল্প করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের যে বাক্য দিয়ে শুরু করেছি, তাঁর সফলতা এখানেই। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য ১৫০ টাকা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৮/তারা