শিল্প ও সাহিত্য

এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার || আফসানা বেগম

তুমি জানতে চাইলে ‘বৈশাখ’ শব্দটা শুনলে কিরণের মাথায় সবচেয়ে প্রথমে কী আসে?মাটির দিকে তাকিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘রক্ত।’

‘রক্ত!কী আবোল-তাবোল বকছ? আমি বলতে চাচ্ছি বৈশাখের একটা চেহারা আছে না? মানে, বৈশাখ বৈশাখ গন্ধ?’

‘হুম। রক্তের গন্ধ।’ তুমি কৌতূহলী হয়ে কিরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে। তাকে উদাস আর অন্যমনস্ক দেখাল যেন যা বলার বলা হয়ে গেছে। রক্তের গন্ধের কোনো ব্যাখ্যা সে আর দেবে বলেও মনে হলো না। তোমারও আর জবরদস্তি জানতে চাইতে ইচ্ছে করল না। তোমার আশা ছিল, কিরণ বলবে বৈশাখ বললে তোমার কথা মনে হয়, কারণ কোনো এক বৈশাখেই তোমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তা না, কোত্থেকে এলো রক্ত! গন্ধের কথাই যদি বলবে তবে ইলিশ ভাজা আর পান্তাভাতের গন্ধের কথা তার মনে এলো না? কিরণের উপরে একটু মেজাজ খারাপ হলো তোমার। মনে মনে ভাবলে, আমি বলি বৈশাখ আর সে কিনা বলে রক্ত! আরে বাবা, কোরবানি ঈদের কথা বললেও না হয় চলত, কিন্তু বৈশাখ আর রক্ত? এই কিরণটা মাঝেমধ্যে বড্ড আবোল-তাবোল বকে। একরকম রাগ করেই তুমি বললে, ‘তোমার না খানিক মাথা খারাপ আছে, বুঝলা?’ কিরণ হেসে বলল, ‘ক্যান? কী করছি?’ তুমি বললে, ‘না, ঠিক খারাপ না, একটা স্ক্রু মিসিং আর কী।‘ কিরণ মুচকি হাসল। বলল, ‘স্ক্রুটা কই গেল বলো তো? তুমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিলে, ‘গেছে আর কী, ওই যে, রক্তে ভেসে গেছে।‘ তুমি ভেবেছিলে কিরণ হাসবে কিন্তু অবাক হয়ে দেখলে যে তার মুখটা খানিক গম্ভীর হয়ে গেল। ফরসা মুখের উপরে ভরদুপুরে যেন একটা গাঢ় ছায়া অযাচিত আসন গেড়ে বসল। তোমার মন্তব্যের শাস্তিস্বরূপ নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারটা পেরোনোর পর থেকে হোম ইকনমিক্স কলেজের গেট পর্যন্ত কিরণ আর একটাও কথা বলল না। পায়ের গতিও খানিকটা বেড়ে গেল। রাস্তার উল্টো দিক থেকে স্রোতের মতো আসা মানুষ, বাস আর রিকশা বাঁচিয়ে তাকে অনুসরণ করতে কষ্টই হচ্ছিল তোমার। তারপর কলেজের সামনে এসে কিরণ এমনভাবে গেট পেরিয়ে ঢুকে গেল যেন রাস্তায় বরাবর সে একাই ছিল, সঙ্গে যে ছিল সে অদৃশ্য। তুমি হা করে কিছুক্ষণ আধা খোলা গেটের ভিতরের দিকে তাকিয়ে থাকলে। কিরণ একবারও ফিরে তাকায়নি। লম্বা পথটা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা সাদা করিডোরে মিলিয়ে গেছে। তারপর কী আর করা, বৈশাখ আর রক্তের মধ্যে সম্পর্ক কিংবা পার্থক্য ভাবতে ভাবতে তুমি নিজের হলের দিকে রওনা দিলে। আসলে তোমার মনে বৈশাখ নিয়ে অনেক মজার মজার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল। তুমি ভেবেছিলে কিরণকে সেসব বলে খুব একচোট হাসাবে। কিন্তু সে তা হতে দিল না। অথচ ক্লাস শেষ হবার পরে বৈশাখের কথা উঠিয়েছিল কিরণই। তবে বছর দুয়েক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে আর আশেপাশে কিরণকে দেখতে দেখতে তার সম্পর্কে তোমার যথেষ্ট জানা হয়ে গেছে। কী কারণে হুট করে রেগে যায় বলা যায় না। তারপর পেটে হাতুড়ি মারলেও আর কথা বলবে না। রাগ পড়লে নিজেই এসে বিস্তারিত বিবরণসহ রাগের কারণ আর স্যরি-টরি বলবে। ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে কিরণ ছায়ানটে ভর্তি হয়েছিল। তাই চারটা সেমিস্টার শেষ হতে হতে ছায়ানটে সে উঠে গেল দ্বিতীয় বর্ষে। কলাভবনের পাশে শিশু গাছের ছায়ায় বসে প্রায়ই কিরণ গান ধরত। তোমরা অনেকে বসে শুনতে। তুমি প্রায়ই বলতে, ‘ওই গানটা ধরো না কিরণ, ওই যে-আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা, তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।’ সে কপট রাগ দেখিয়ে বলত, ‘একই গান বারবার শুনতে চাও অথচ প্রথম লাইনটা কিছুতেই মনে রাখতে পার না, এটা কেমন ব্যাপার, হুম? গানটা হলো-আজি বিজনঘরে নিশিথ রাতে আসবে যদি শূন্য হাতে, বুঝেছ?’ তুমি হেসে বলতে, ‘কী করব, কিরণ, আমি যে দুই লাইন মনে রেখেছি তার কাছে ওই ভদ্রলোকের ওই গানের তো বটেই, অন্য অনেক গানের হাজার লাইনও যে মার খেয়ে যায়, যায় না?’ কিরণ হেসে বলত, ‘তা যায় বটে।’ তারপর বলত, ‘জানো, কত দিন কত রাত ওই দুটো লাইন আমাকে কত হতাশা আর কান্না থেকে মুক্তি দিয়েছে!’ বলে নিয়ে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থাকত। তারপর ভিতরে ভিতরে নিজের মধ্যে ফিরে এসে গুনগুন করে গাইতে শুরু করত। ওই সঞ্চারি থেকেই গানটা আরম্ভ হতো কিরণের ঠোঁটে-আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ করা, তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা। কিরণের মুখে রক্ত শব্দটার গাম্ভীর্যতার কথা ভাবতে ভাবতে সেদিন তুমি হলে ফিরে এসেছিলে। এখনো তোমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন ক্লাস শেষ করে কিরণ খুশির চোটে বলতে গেলে উড়ে এসেছিল খবরটা দিতে, ‘শোনো, আমি না এবারে ছায়ানটের বৈশাখের অনুষ্ঠানে গাইব। মানে, আমাদের ক্লাস থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও সিলেক্ট করেছে!’ তুমি খুশি হয়েছিলে কিরণের উত্তেজনা দেখে। কিরণ এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছিল, ‘ছোটোবেলা থেকে টিভিতে আর নিউজ পেপারে যে অনুষ্ঠানের ছবি দেখেছি, এবারে আমি নিজেই সেই অনুষ্ঠানে গাইব, ভাবা যায়?’ তুমি হেসে বলেছিলে, ‘কেন ভাবা যাবে না, এত সুন্দর গাও তুমি! তোমাকে নেবে না তো কাকে নেবে?’ কিরণ নিজের প্রশংসায় আড়ষ্ট হয়েছিল। ঢোক গিলে বলেছিল, ‘না, মানে, আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না। যা হোক, তুমিআসবে তো?’ তুমি মাথা চুলকে বলেছিলে, ‘দেখি।’

‘দেখি মানে? তুমি বৈশাখের অনুষ্ঠান দেখতে রমনায় যাও না?’

‘নাহ্, মানে, অ্যাত্ত সকালে উঠে খামোখা এত ভিড় ঠেলে... পরে তো টিভিতেই দেখা যায়।’

‘আশ্চর্য, ঢাকার মানুষ হয়েও ওই অনুষ্ঠান মিস কর কী করে? আমি তো ছোটোকাল থেকে টিভিতে দেখতাম আর ভাবতাম কবে ঢাকায় পড়তে আসব আর সামনে বসে ওই অনুষ্ঠানটা দেখব।’

‘দূরে ছিলে তো তাই এমন মনে হতো। ধীরে ধীরে দেখবে তুমিও আর যাবে না, ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকবে।’

‘কখনো না। অসম্ভব!’

‘অসম্ভব না, কিরণ। কক্সবাজারে থাকে এরকম বহু মানুষ আছে যারা হয়ত গত দশ বছরে একবারও সমুদ্রের তীরে যায়নি। আবার ধরো বৃষ্টিতে গোসলের বাতিকঅলা কিছু মানুষও কোনো একসময় ঘরে শুয়ে-বসে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনতে পায়, বাতাসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি টের পায় কিন্তু উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখে না।’ কিরণের সঙ্গে বলা প্রায় পনেরো বছর আগের এই সমস্ত কথা তোমার হয়ত মনেই পড়ত না যদি আজ ভোর রাতে ঝড়ের শব্দে ঘুম না ভাঙত। পাশ ফিরতে গিয়ে চোখটা হালকা খুলে গেল। আর সরু করে চোখ মেলতেই তোমার মস্তিষ্ক হালকামতো কাজ করতে শুরু করল। তোমার মনে হলো তেপান্তরের মাঠের এক প্রান্তে তুমি ঘুমিয়ে আছ আর তোমার শরীরের উপর দিয়ে বাতাসের প্রলয় বয়ে যাচ্ছে। চোখটা ভালোমতো খুলতেই দেখলে হাজার ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতোতীব্র আলো আর পরমুহূর্তে ঘরঘুটি অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পালা। বুঝতে পারলে, কোনো মাঠ-ঘাট নয়, তুমি আছ তোমার ঘরে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। বিজলির উজ্জ্বল আলোয় নিজের মাথার উপরে আর চারপাশে ফিনফিনে পর্দাগুলো উড়তে দেখলে; যেন কেউ উড়ে চলেছে, দেখা যাচ্ছে কেবল উড়ন্ত পাখা। মনে পড়ল, কাল রাতে বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাস ছিল। শরীর জুড়িয়ে দেয়া বাতাস তুমি উপেক্ষা করতে পারনি, তাই শোয়ার আগে জানালাগুলো খুলে কেবল নেটের কপাটগুলো লাগিয়ে রেখেছিলে। বিছানায় উঠে বসলে তুমি। পায়ের দিকের তোষকটা ভিজে গেছে প্রায়। বৃষ্টির এলোমেলো ছাঁট আসছে, কোনদিক থেকে আসছে আর কোনদিক থেকে আসছে না তা বুঝতে বুঝতে তোমার ঘুম পুরোপুরি ছুটেই গেল। জানালার কাচগুলো টেনে লাগাতে ঘরে বাতাসের প্রলয় বন্ধ হলো ঠিকই কিন্তু বাইরের শোঁ শোঁ শব্দ চলতে থাকল। শব্দের তালে তালে হাজার স্মৃতির ঢেউ তোমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। কিছুতেই আর ঘুমাতে দিল না। বৈশাখের আগে আগে আসা এই ঝড়কে বলে কালবৈশাখী- প্রাইমারি স্কুলে অর্জিত জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে স্মৃতির পরত একে একে খুলে যেতে লাগল। খুলতে খুলতে এসে ঠেকল কিরণের মুখের উপরে। সেই কিরণ যে কোনোদিন তোমার সবসময়ের সঙ্গী ছিল অথচ যাকে তুমি প্রায় দশ বছর দেখনি। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা তোমার কাছে এতঅস্বাভাবিক লাগল! একই শহরে থেকে কী করে তুমি কিরণের সঙ্গে এতদিন যোগাযোগ করোনি? বন্ধুরা কতবার এর-ওর বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছে, নানান ব্যস্ততার অজুহাতে তুমি যাওনি। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে অফিস আর বিয়ের পর থেকে বিয়ের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে গত বছর দশেক তুমি আর কারো কথাই ভাবোনি। অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস, এই চক্রে কে জানে কত কাল তুমি আটকে আছ! উথালপাতাল ঝড়ের শব্দ আর ভেজা ভেজা তোষকের স্পর্শে হঠাৎ তোমার অসহায় লাগল। বাচ্চা হবে বলে বউ মায়ের বাড়িতে চলে গেছে মাস দুয়েক আগে, আর আজ এতদিন পরে ভোর রাতে কালবৈশাখীর ঝড়ের টানে তুমি আবিষ্কার করলে যে তুমি কত একা! তোমার কোথাও কোনো শূন্যতা ছিল না, যদি থেকেও থাকে তবে বলতে গেলে এতটুকু একাকিত্ব ছিল না যে তুমি তোমার শূন্যতা নিয়ে ভাববে। ভরপুর বাড়ি আর অফিসের মাঝখানে ঘণ্টা দুয়েকের ট্রাফিক জ্যামপূর্ণ রাস্তায় তুমি বসে বসে অজানা আর অচেনা মানুষের জীবন আর যাপন নিয়ে ব্যস্ত থাকো। কে কী খায়, কার কী দর্শন, কে কোথায় বেড়াতে যায়, কে কোথায় প্রতারিত হয়- হাতের ফোনের উপরে এই সমস্ত গালগল্পের আড্ডা দেখতে দেখতে হয় তোমার অফিস এসে পড়ে নয়তো বাসা। কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়ে আসা ভোরে বিছানার উপরে একাকী বসে তোমার মনে হলো, কতদিন যেন তুমি সত্যিকারের মানুষের সংস্পর্শ পাওনি! কিরণ কিরণ... কিরণের নামটা হঠাৎ তোমার মাথার মধ্যে কিরকির করে উঠল। ঘড়িতে জ্বলজ্বলে রেডিয়ামে সময় দেখলে সাড়ে ছয়। ফোনে দেখে নিলে, হ্যাঁ, কিরণের একটা ফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে বটে। কবে, কার কাছে নেয়া হয়েছিল মনে পড়ল না। কোনোদিন ফোন করা হয়েছিল কি না তা মনে করতেও মাথা সায় দিলো না। সে যাই হোক, এই সাত সকালে হুট করে কাউকে ফোন করা যায় না। তাই বেলা বাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলে তুমি। কেন যেন কিরণকে লাগেইনি এত বছর যাকে ছাড়া কোনো একসময় একটা দিনও চলত না তোমার। কিরণের সঙ্গে শেষ দেখার দিন বা ক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলে তুমি। কিন্তু মাথার ভিতরে কালবৈশাখীর মতো ঝড় বইয়ে দিয়েও মনে করতে পারলে না। হয়ত যোগাযোগ কমতে কমতে কোনোদিন সুমধুর গান ধীর লয়ে ফুরিয়ে যাবার মতো তার সঙ্গে সম্পর্কটা কোথাও মিলিয়ে গেছে, তোমরা কেউই তা মনে রাখোনি। শেষ পর্যন্ত ভালোমতো সকাল না হওয়া অব্দি মূর্তির মতো বিছানাতেই বসে থাকলে তুমি। কখনোবা একটু গড়িয়ে নিলে। কিন্তু কিরণের ভাবনা ছাড়ল না। অন্য কোনো বন্ধু বা জুনিয়র কারো কাছে কি কিরণের খোঁজ থাকতে পারে? তুমি ভাবতে থাকলে। ফ্যানের বাতাসে মাঝেমধ্যে পর্দা সামান্য নড়ে উঠলে তুমি বাইরে আলো ফোটার আভাস দেখলে। ঝড়ের উত্তাল শব্দ আর নেই। ধীরে ধীরে পর্দা সরাতেই বাইরের লন্ডভন্ড দৃশ্য দেখতে পেলে। বাড়ির সামনের রাস্তায় পাতার বিছানা হয়ে গেছে। কিছু ডালপালাও পড়ে আছে। ডালগুলো এখানকার গাছের নয়। নিশ্চয় দূর থেকে ভাঙা ডাল উড়ে এসেছে। ভালো করে দেখার জন্য বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে। আশ্চর্য! পুরো এলাকাটাই অন্যরকম লাগছে। রাস্তার মোড়ের দিকে তাকাতেই দুমড়ানো মোচড়ানো কতকগুলো জং ধরা টিন পড়ে থাকতে দেখা গেল। মনে হলো, শুধু ডাল নয়, কোনো বাড়ির চাল-ও উড়ে এসেছে। আর ওই পরিস্থিতি দেখে প্রথমেই মনে পড়ল তোমার বউয়ের কথা। ছুটে এসে ফোন করলে তাকে। নাহ্ সিলেটের দিকে তেমন কোনো ঝড়-টড় হয়নি। বউ বলল, ‘ছুটির দিনে বাড়িতে একা একা করবেটা কী? হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে গিয়ে কফি শপে বসে নাস্তা সেরে আসো গে যাও।’ আসলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমিও তেমনটাই ভাবছিলে, ওদিকের রাস্তাঘাটের অবস্থাটা কী দেখা দরকার। একবার গিয়ে ঘুরে আসলে হয়। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। এত সকালে বলে নাকি রাস্তায় প্রচুর গাছের ডাল পড়ে আছে বলে তুমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলে না। শীতকাল গেছে সেই কবে, অথচ বাতাসে শীত শীত গন্ধ। ফুলহাতা টি-শার্ট গলে তোমার চামড়ায় হুল ফোটানোর মতো ছুঁয়ে গেল কয়েকবার। শীতলতাটা তুমি ভালোই উপভোগ করলে। ভাবলে বউয়ের কথামতো কফিশপে গিয়ে নাস্তাকরলেই ভালো। এই বাতাস গায়ে মেখে তারপর ধোঁয়া ওঠা কফি পেলে বেশ হয়। তোমার বাড়ির গলিটা ছাড়তেই মোড়ে একটা বাড়ির পাঁচিল পড়ে গেছে। পুরোনো ছিল অবশ্য। সেই আগেকার যুগের বাগানওলা দোতলা বাড়ি। এখনো রিয়েল এস্টেটের লোকেরা হয়তো ওখানে সুবিধা করতে পারেনি। তবে পারবে। ঝড়ের যা ফল দেখা গেল, তার পরে আর বাড়িটা থাকবে বলে মনে হলো না। বাড়িটার শেষ মাথায় প্রাচীন এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে বরাবর তোমার চোখ ওই গাছটার দিকে যায়। বিশেষ করে ওটাতে যখন রং লাগে। আগের দিনেও তুমি লক্ষ করেছিলে কী ভীষণ আগুন লাগার মতো লালচে কমলা কৃষ্ণচূড়ায় ভরে আছে গাছটা। ফুলগুলো এতটাই ঘন হয়ে ফুটেছে যে দূর থেকে দেখলে একটা আস্ত গোলাপের মতো দেখায়। আজ সেই ফুলের বেশিরভাগটা পড়ে আছে রাস্তায়; প্রচুর পাতাও। শীত শীত অনুভূতিটা ঠেকাতে তুমি পকেটের মধ্যে হাতদুটো গুটিয়ে নিলে। তারপর রাস্তায় পা ফেলতেই দেখলে নীলচে পিচের উপরে লাল বা কমলা পাপড়ি, কোথাও আবার ফুল পড়ে আছে। একের পর এক ভেজা পাপড়ির উপরে কিংবা তাদের বাঁচিয়ে পা ফেলতে ফেলতে তুমি তোমারই অজান্তে অতীতের এক রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলে। ‘ধরো, অনেকদিন আগে কোনো এপ্রিলে কৃষ্ণচূড়ার কোনো পথ ধরে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম। কালবৈশাখীর পরে ভেজা লাল-কমলা পাপড়িগুলো মাড়িয়ে, ধরো, বহুদূর হেঁটেছিলাম আমরা। মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে, কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে- গুনগুনিয়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। জানো তো, কাছাকাছি না থাকাটা তখন ছিল কেবলই ফ্যান্টাসি। ধরো, আরো অনেকদিন পরে গাঢ় নীল পিচের ব্যাকগ্রাউন্ডে লালচে সে পাপড়িগুলো আবার আমাদের দলতে ইচ্ছে হলো। একটা-দুটো পাপড়িতে কেমন ছোপ দেখেছ? এমন ছবি দেখোনি কচুরিপানার ফুলে কি ময়ূরের পালকে? ধরো, দুটো পাপড়ি তুমি কুড়িয়ে রাখলে; পকেটে নাকি মনে? স্যুভেনির কি? ধরো আরো বহুবছর পরে আরেক বৈশাখে একই রাস্তায় আমরা হেঁটে গেলাম। কৃষ্ণচূড়ার ডালপালার ফাঁকে মেঘশূন্য আকাশে চোখ রেখে ভাবলাম, বহুবছর আগে এই পথ ধরে আমরা হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।’ আশ্চর্য, কথাগুলো তুমি স্পষ্ট কিরণের গলায় শুনতে পেলে। এ কী করে সম্ভব! এতদিনে একটা শব্দও ভোলোনি অথচ আস্ত কিরণটাকেই ভুলে ছিলে? কথাগুলো আরেকবার আওড়াবে নাকি ভাবতে ভাবতে তোমার পায়ের গতি ধীর হয়ে এল। দাঁড়িয়েই পড়লে শেষে। তারপর খানিকটা নিচু হয়ে রাস্তা থেকে একটা ফুল তুলে নিলে। একটা পাপড়িতে লাল-সাদা-কমলা ছোপ, বাকিগুলো লালচে। কিরণ ঠিক বলেছিল, ময়ূরের পালকে এমনটাই আছে। নিজের অজান্তেই কি না কে জানে, পাপড়ি উঠিয়ে তুমি পকেটে চালান করলে। পকেট আর হাতটা খানিক ভিজে গেল। তারপর কিরণের কণ্ঠস্বর ধাওয়া করতে করতে তুমি আবারো হাঁটতে শুরু করলে। সে বহু আগেকার কথা। ক্লাসের কয়েকজন মিলে তোমরা সাভার বেড়াতে গিয়েছিলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৃষ্ণচূড়ায় লাল। বিকেল নাগাদ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলে তোমরা। তারপর প্রান্তিকের মোড় থেকে লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়েছিলে। ঝড়ের পরে ঠিক এমনই শান্ত আর শীতল পরিবেশ ঘিরে ছিল তোমাদের। ভেজা রাস্তায় চ্যাপ্টা হয়ে লেগে ছিল অসংখ্যা পাপড়ি আর ফুল আর পাতা। পরিবেশটাই ছিল আনন্দে পাগল হবার মতো, কিরণ ওড়না উড়িয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। তারপর হঠাৎ বলেছিল, ‘একটা গান শুনেছ কেউ? মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে, কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে... শুনেছ?’ বেশিরভাগই ঠোঁট উল্টেছিল। তাই দেখে কিরণ গানটা গাইতে শুরু করেছিল। তোমার তখন মনে হয়েছিল এর আগে এত সুন্দর গান তুমি কোনোদিন শোনোনি। কিরণকে বলাতে সে অবশ্য বলেছিল, ‘পরিবেশ, বুঝলে? পরিবেশ। এইখানটাতে এই সময়ে যদি না শুনতে তবে কি আর এত ভালো লাগত?’ তুমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে। আসলেই কি তাই? কিরণ তখন হেসে বলেছিল, ‘আজকের পরে এ গানটা যদি কখনো শোনো, তোমার ঠিকআজকের এই বিকেলটার কথা মনে পড়বে। মানে, আজকের বিকেলের এই কৃষ্ণচূড়ার রাস্তাটার সঙ্গে সুমন কল্যাণপুরের এই গানটাকে আচ্ছামতো বেঁধে দিলাম,’ বলে জোরে জোরে হেসেছিল কিরণ। তারপর ঢাকায় ফিরে পরদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে গাছের নিচে বসে বলেছিল, ‘কয়েকটা লাইন শুনবে?’ তুমি জানতে চেয়েছিলে, ‘কীসের লাইন? কার?’ সে লাজুক হেসে বলেছিল, ‘এই তো, আমারই। কাল রাতে লিখেছি।’ তারপর বইয়ের ভিতর থেকে ভাঁজ করা কাগজ খুলে পড়তে শুরু করেছিল, ‘ধরো অনেকদিন আগে কোনো এপ্রিলে কৃষ্ণচূড়ার কোনো পথ ধরে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম। কালবৈশাখীর পরে ভেজা লাল-কমলা পাপড়িগুলো মাড়িয়ে, ধরো, বহুদূর হেঁটেছিলাম আমরা...’ পড়া শেষ হলে তোমার মুগ্ধতা কাটতে সময় লেগেছিল। তারপর একসময় তুমি বলেছিলে, ‘কিরণ, তুমি তো কবি!’ কিরণ হেসেছিল। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছিল কিছুটা লজ্জিত, আবার গর্বিতও। ওর হাত থেকে কাগজটা টেনে নিয়ে তুমি কয়েকবার পড়েছিলে লাইনগুলো। পড়তে পড়তে একসময় না দেখেই আবৃত্তি করতে শুরু করলে। কিরণ তখন সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কোনোদিন ওই গানটা তুমি শোনোনি। এই ক’বছরে গানইবা শুনেছিলে কবে তেমন। কিন্তু কিরণ যে সময়টাকে ওই গানটার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল, তা কি সেই গানটা শোনেনি বলেই ভুলে ছিলে? তবে তুমি নিশ্চিত যে তুমি কিছুই ভুলে যাওনি, ভুলে ছিলে কেবল। ততক্ষণে ধীরে ধীরে বেশ কিছু মানুষ বেরিয়ে এলো রাস্তায়। বড় রাস্তার দিকে বাসও দেখা গেল। চারদিকে ভরে উঠল হর্ন আর রিকশার বেলের শব্দে। কিছু লোক নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে রাস্তা থেকে ডালপালা সরাতে লেগে গেল। কোথাও কোথাও তুমিও একটু হাত লাগালে। এই করতে করতে বড় রাস্তার নতুন কফিশপের সামনে চলে এলে। মাত্র দরজা খুলছে তারা তখন। কফি পেতে নিশ্চয় সময় লাগবে। একলা ছুটির দিনে তোমার সময়ের অভাব নেই। কোণের একটা টেবিলে বসে কাচের ঘেরাটোপের বাইরে রাস্তার চলাচলের দিকে চোখ রেখে বসে থাকলে তুমি। হঠাৎ মনে হলো, কেমন ছিল সেই গানটা? পকেট থেকে ফোন বের করে ইউটিউবে খুঁজতে লাগলে। বাহ্, খুবই জনপ্রিয় গান তো! পুরোনো ধাঁচের মিউজিক কম্পোজিশন অথচ একটানে সেদিনের সেই বিকেলে নিয়ে যেতে অব্যর্থ। ঠিক কিরণের প্রতিজ্ঞামতো, সে বলেছিল, গানটাকে আজকের বিকেলের সঙ্গে বেঁধে দিলাম। নাহ্, যত সকালই হোক, কিরণও নিশ্চয় ঝড় দেখেছে, এত বেলা করে ঘুমিয়েও নেই হয়ত। ভাবতে ভাবতে তার নাম্বারে কল করে ফেললে তুমি। দু’এক সেকেন্ডের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার পরে রেকর্ডেড মেসেজ শোনা গেল। এই ফোন নাম্বার কিরণ হয়ত কবেই বদলে ফেলেছে। কিংবা এটা আদৌ কোনোদিন কিরণের ছিল কি না তা ভেবে বের করতে তোমার স্মৃতি তোমাকে ধোঁকা দিয়ে চলল।  কফিতে চুমুক দিয়ে পাশের টেবিলে তাকালে তুমি। উনিশ-বিশ বছর বয়সের তিনজন ছেলেমেয়ে এসে বসেছে। খাবারের অর্ডার দিয়েছে হয়ত, তারপর ডুবে গেছে নিজেদের জগতে। মনে পড়ল, এ বয়সে তিন বন্ধু একসঙ্গে হলে আশেপাশের মানুষ তোমাদের চিৎকার-হাসাহাসিতে চমকে তাকাত। অথচ তাদের টেবিলে ভয়ানক নীরবতা। একজনের কানে হেডফোন, তিনজনেরই চোখ ফোন বা ট্যাবে। সেদিন এক বন্ধু বলছিল, ‘দেখেছ, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কত ভদ্র! মাথা সবসময় নিচে।’ পাশের টেবিলে তাকিয়ে মনে হলো, সময় করে একসাথে খেতে আসার তেমন দরকার পড়ে না এদের। তবু পুরোনো নিয়ম অন্ধের মতো পালন করে যাচ্ছে। আর এদিকে, চল্লিশের কাছাকাছি এসে তোমার চোখ খুলে গেছে। তুমি আড্ডায় যাও না। সেসব পুরোনো প্যাটার্ন। এখন ভার্চুয়াল আড্ডা আছে। ‘তোমাকে খুব মিস করছি’ মন্তব্য দেখলে ভেতরে উত্তেজনা হয়। তবে জানো না কেন, ওই উত্তেজনাটা ধরে রাখতেই ভালো লাগে। একটা সাজানো দুঃখবোধ। ওরকম কিছু না থাকলে নিঃস্ব লাগে। ভয় হয়, হায় হায়, কেউ আমাকে চায় না! তবে পুরোনো বন্ধুর ফোন নাম্বারটা চাইতে ইচ্ছে করে না। সব সম্পর্ক ওখানেই আটকে থাকুক, ভার্চুয়াল জগতের নির্ঝঞ্ঝাট আকাশে। কিন্তু বিপদ কি সেখানেও কম? সবসময় সম্পর্কের বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখতে পার না। নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছ, কেন এত মিলে যাই, মিশে যাই? মনে পড়ল, একবার তোবলতে গেলে মিশেই গিয়েছিলে। পুরোনো সম্পর্ক ভালো। চুপচাপ থাকে পুরোনো সম্পর্কের জায়গাতেই। কেবল মনে রাখা, বাড়া-কমার কোনো ব্যাপার নেই। নতুন সম্পর্ক ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অথচ সেদিন পুরোনো সম্পর্কই ভাসাতে লাগল তোমাকে। কিরণকে এখন কোথায় পাবে সে নিয়ে চিন্তাটা বেশিদূর এগোলো না অথচ আগের ঝাপসা বা মুছে যাওয়া দিনের ছবিগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। তখনকার সময়ে,পহেলা বৈশাখের ভোর বেলা কিরণ বটতলায় লম্বা সারিতে বসে গান গাইবে আর তুমি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবে, কিরণের অত্যাচারে তা হবার কোনো উপায় ছিল না। তারপর থেকে প্রতিবারই তোমাকে অনুষ্ঠানে আসতে হয়েছিল। বেশ আগেভাগেই আসতে হতো। সামনের দিকে বসতে হতো, কিরণ যেন তোমাকে দেখতে পায়। মঞ্চের উপরে কী সুন্দরই না দেখাত তাকে! কখনো সাদা, কখনো লাল, কখনো সবুজ কি হলুদ শাড়ি আর মাথার দু’পাশ থেকে নেমে আসা বেলি বা গাঁদার মালায়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভিতরটা কেঁপে উঠল তোমার। কফির কাপটা হাতে ধরে রাখা অবস্থায়ই নড়ে গেল। ছলকে টেবিলে কফি পড়ল খানিকটা। কফিশপের লোগোর ছাপওলা টিস্যু দিয়ে তুমি যত্ন করে টেবিলে পড়া কফিটুকু মুছতে লাগলে। মুছতে মুছতে তোমার মনে হলো, কোনো নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি ঠিক এভাবে মুছে দেয়া যেত! কিন্তু মোছা যায়নি। সেই যে কিরণদের বৈশাখী অনুষ্ঠান দেখতে তুমি শেষ যখন রমনার বটমূলে গিয়েছিলে। তারপর আর না-গেছ সেই অনুষ্ঠানে আর না-গেছ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে নাকি জোর করে ভুলে যেতে চেয়েছিলে? তোমার ঠিক জানা নেই। মাথার উপরে জোর দিতেই ঠিক মাঝখানে তীব্র ব্যথার মতো যন্ত্রণা শুরু হলো তোমার। তুমি কফির কাপ রেখে মাথার দুদিকে চেপে ধরে কনুই টেবিলে ঠেকালে। কিছুতেই সেই মুহূর্ত থেকে বেরোনো গেল না। বেরোতে চাইলে উল্টো মাথার মধ্যে কতকগুলো ভয়ানক বিষ্ফোরণের শব্দ বাজতে থাকল। শব্দটা আশেপাশে কোথাও নয়, তাই এর থেকে পালিয়ে বাঁচাও যাবে না, তুমি জানো। তুমি যেখানে যাবে, শব্দটাও পেছনে পেছনে তোমাকে ধাওয়া করবে। হাতের তালুতে চোখমুখ ভালো করে মুছে নিলে তুমি। চোখ বন্ধ করলে শব্দ আরো তীব্র আর স্পষ্ট হলো... কিরণ বলেছিল, ‘হলুদ শাড়ি এবারে আমাদের।’ আগের রাতে শাহবাগ থেকে শাড়ির সঙ্গে মানানসই মাথায় ঝোলানোর ফুলের মালা কেনার সময় কিরণের সঙ্গে তুমিও ছিলে। কিরণ গাঁদা নিতে চায়নি; বলেছিল, ‘হলুদের উপরে তো এই হলুদ রঙের ফুল দেখাই যাবে না। তার চেয়ে বরং বেলি ভালো। দেখ, এই মালাটার গন্ধটাও দারুণ।’ হাঁটতে হাঁটতে তাকে হলের গেট অব্দি পৌঁছে দিয়ে নিজের হলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তুমি। পরদিন খুব ভোরে উঠেই রমনা। অনুষ্ঠানের আগে আগে, আলো তখনো ফুটেছে কি ফোটেনি, তুমি গিয়ে সামনের দিকে বসেছিলে। কিরণকে দেখা যাচ্ছিল একইরকমের হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। ধাপে ধাপে বানানো মঞ্চটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো ঝাপসা হয়ে আসছিল চোখ, ঘুম তখনো কাটেনি হয়তো তোমার। সামনের হলুদ কাপড়গুলোতে তাই আক্ষরিক অর্থেই চোখে সরিষার ফুল দেখছিলে। তারপর একসময়, ‘প্রভাতে বিমল আনন্দে বিকশিত কুসুমগন্ধে...’শান্ত এক সংগীত শুরু হতেই ঘুমের বদলে উল্টো বিস্ময় নিয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিলে তুমি। ভাবছিলে, কী স্নিগ্ধ সুর, কী অপূর্ব এই সুরের ওঠানামা, এই করতেই মাসখানেক ধরে পরীক্ষার পড়াশোনা রেখে কিরণ রিহার্সেলের জন্য ওই ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ছুটে যেত! বসুনিয়া গেটের কাছে তাকে ছাড়তে গিয়ে প্রায়ই তাকে তুমি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার দিনক্ষণের কথা মনে করিয়ে দিতে। সে এমন ভাব করতো যেন তার চেয়ে গানের রিহার্সেল ঢের জরুরি। আর তখন ওই মঞ্চের সামনে বসে তোমার মনে হলো, এতদিন প্র্যাকটিস না করলে কি আর এরকম তাল মিলিয়ে সমবেত গলায় গাওয়া সম্ভব? গানের টানে চারদিকে যেন অপার অপার্থিবতা ভর করল। মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও কোনো অপশক্তি নেই, কোথাও মন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে তুমি তোমার ভেতর থেকে উচ্চারণ করছিলে, ‘চারিদিকে করে খেলা, বরণ-কিরণ-জীবন মেলা...’ অুনষ্ঠান এগোচ্ছিল, তোমার মুগ্ধতা বাড়ছিল। আরো পরে শ্রোতায় ভরে গিয়েছিল চারপাশ। মানুষে গিজগিজ করছিল, অথচ সবাই নীরব আর সংগীতে মগ্ন। কিন্তু আটটার দিকে ঠিক কী হলো তোমার জানা নেই, গানের সুললিত সুরের মাঝখানে একেবারেই বেমানান বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলে। কয়েক মুহূর্ত তোমার চোখ-কান কিছু কাজ করছিল না। তোমার মনে হচ্ছিল যেন অসীম কাল কেটে যাচ্ছে তারই মাঝখানে। তোমার ঠিক পাশেই কিছু পোড়া মানুষ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে ছিল। বারুদ আর চামড়া পোড়ার গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল মুহূর্তে। নিথর মানুষদের স্তূপের পাশ থেকে মানুষজন উঠে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছিল। তোমার শরীরেও একসময় তাগিদ ফিরে এলো, তুমিও তাড়াতাড়ি পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করলে। ধাক্কা খেলে। ধাক্কা খেয়ে কোনোমতে টাল সামলালে। দূর থেকে দেখলে কিছু মানুষ আর পুলিশ ছুটে গেল মৃত মানুষদের স্তূপ লক্ষ্য করে। টানাহেঁচড়া করে যেই তাদের নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। তারই মধ্যে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলে তুমি। এবারে আর ততটা জোরে নয়, কিংবা আগের বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গিয়েছিল তোমার। কিন্তু ধোঁয়ার কুণ্ডলীর পিছনে মঞ্চের উপরে হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবিদের আতঙ্কিত ছোটাছুটি দেখতে পেলে তুমি। তোমার মনে পড়ল, কিরণ! তুমি জীবিত মানুষদের ঠেলাঠেলি আর মৃত মানুষের স্তূপ ফেলে, বারুদের গন্ধ ভেদ করে সেদিকে ছুটে গেলে। মঞ্চের প্রায় সবাই ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। ভিড়ের মধ্যে কিরণকে খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল তোমার। দারুণ বিভ্রান্তি নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো একের পর এক হলুদ শাড়ির মাঝে তুমি কিরণের মুখ খুঁজতে লাগলে। কিছু পরে দেখলে মঞ্চের সিঁড়ির নিচে পাখির ভয় পাওয়া বাচ্চার মতো থরথর করে কাঁপছে কিরণ। তুমি ছুটে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত রাখলে, ‘কিরণ, ঠিক আছ তো, না? ঠিক আছ?’ কিরণ কিছু বলেনি। কেবল তোমার গলা শুনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তোমাকে। তুমিও তাকে জড়িয়ে ধরেছ শক্ত করে। মানুষের হুলুস্থুল ছোটাছুটির মাঝখান দিয়ে তুমি তাকে নিয়ে চলে আসতে শুরু করলে। কিরণ যেন স্থবির হয়ে গেছে তখন। তার পা তোমার গতিতে আগাচ্ছিল না। তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছিল তোমার। মাঝখানে সে একবার দাঁড়িয়েই পড়ল। তোমার হাত টেনে বলল, ‘বলেছিলাম না তোমাকে, বৈশাখ মানেই রক্তের গন্ধ? বলেছিলাম, মনে আছে?’ তুমি তাকে আরেকবার হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলেছিলে, ‘বাদ দাও তো, কিরণ। এখন চলো এখান থেকে।’ শত শত মানুষ সামনের দিকে হাঁটছিল। দৌড়ে যাচ্ছিল। তোমরাও চলছিলে তাদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে এত জোরে পা চালাচ্ছিলে যেন তোমরা দৌড়ে যাচ্ছ। তোমার মাথায় ঘুরছিল কিরণের কথা, সে কী করে জানতো বৈশাখ মানে রক্তের গন্ধ? কিরণ যেন কোনোভাবে তোমার ভাবনা জেনে গিয়েছিল। কলাভবন পেরিয়ে বড় বড় শিশু গাছগুলোর নিচে এসে একটু থামল, তারপর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তুমিও প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে। কিরণ বলল, ‘শুনবে, কেন আমি বৈশাখ থেকে রক্তের গন্ধ পাই?’ তুমি কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ ওর হাত ধরে থাকলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়েছিল সে। সেখানে রাস্তার পাশে তখন ভিড় অনেকটা কমে এসেছে। ফুটপাথের দিকে সেঁটে গিয়ে কিরণ বলেছিল, ‘আমি যখন ক্লাস টেন-এ পড়ি, বৈশাখের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম আমাদের শহরের টাউন হলে। গান শেষ হতেই শুনি বাইরে নাকি কী এক অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। দর্শক-শ্রোতারা অনেকেই হল ছেড়ে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি রাস্তার বাতাসে রক্তের গন্ধ। এত গুমোট গন্ধ, কী বলব, আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার কেন যেন একটুও ভালো লাগছিল না। তাই বাকি অনুষ্ঠান হবে কি না কিছু না জেনেই বাড়ি চলে এসেছিলাম। আসার পথে টাউন হলের মোড়ের উপরে দেখলাম রক্তাক্ত অনেকগুলো শরীর শোয়ানো। উৎসুক মানুষ চারদিকে ঘিরে আছে, তাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে মৃত শরীরগুলোর কারো হাত, কারো পিঠ দেখতে পেলাম। সেখানটায় গন্ধ এত তীব্র, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছে আমার। পাশেই প্রায় চ্যাপ্টা হয়ে থাকা একটা মাইক্রোবাস কাত হয়ে ছিল। আমি একটা রিকশা পেয়ে একরকম পালিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’

‘তারপর?’ ততক্ষণে তুমিও ধাতস্ত হতে পেরেছিলে। কিরণের গল্পের মধ্যে ঢুকে গিয়ে তোমার কৌতূহল বাড়ছিল।

‘তারপর বাড়ি পৌঁছানোর কিছু পরে একটা পিক-আপ ভ্যানে করে আমাদের বাড়িতে একটা লাশ এলো। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না কী ব্যাপার। আমাদের জানানো হলো ওটা আমার বাবার লাশ। টাউন হলের সামনে ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসের অ্যাক্সিডেন্টে তিনি মারা গেছেন। ছোট শহর, বলতে গেলে সবাই সবাইকে চেনে। বাবাকে চিনতে পেরে পাশের পাড়ার কিছু ছেলে লাশটা নিয়ে এসেছিল। বাবা তার বন্ধুর অফিসের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।’ তুমি আর কিছু বলোনি। কিরণের ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখেছিলে। কিরণের চোখের দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে কিন্তু সে নির্দিষ্ট কিছুই দেখছিল না। মনে হচ্ছিল ভবিষ্যত কালের মতো ধোঁয়াসা কিছু তার দৃষ্টি দখল করে ফেলেছে, সেখানে দুর্বোধ্য কিছু সংকেত ছাড়া আর কিছু নেই। তুমিও তখন অব্যক্ত কল্পনা চোখে নিয়েআকাশের দিকে তাকিয়েছিলে। শিশু গাছের ছড়ানো ডালপালার ছোট-বড় ফাঁক দিয়ে উপরের ঝকঝকে আকাশের নানান আকৃতির টুকরো উঁকি দিচ্ছিল, অথচ মাটিতে সমস্তকিছু ছিল রক্ত আর দুরাশায় মাখামাখি। কিরণ কানের পাশ থেকে বেলির মালাগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছিল। মাটিতে সাদা বেলির পাপড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। তুমি তাকে মানা করোনি। তারপর কাঁদতে কাঁদতে কিরণ ফুটপাথে বসে পড়েছিল। কোনো কথা না বলে কিরণের একটা হাত ধরে তুমিও বসে পড়েছিলে তার পাশে। কফি শপে বসে স্যান্ডুইচ খাবার পরে অন্তত দু’ গ্লাস পানি আর কফি খাওয়ার পরেও তোমার কেন যেন গলা শুকিয়ে আসতে থাকল। মনে হলো তোমার ভেতরের তৃষ্ণাটা এত তীব্র, কিছুতে মেটার নয়। কাচের বাইরে রাস্তায় তখন তুমুল কোলাহল। সাধারণ একটা দিনের প্রথম ভাগ। তাকিয়ে দেখলে মানুষ যার যার কাজে উন্মাদের মতো ছুটছে; কারো এতটুকু সময় নেই। শুধু তোমার যেন অসীম স্থবিরতা সেদিন। যা খুশি করে কাটাতে পারো অথচ তোমার তখন কেবল কিরণকে ছাড়া আর কারো কাছে যেতে মন চাইল না। সেখানে বসেই তুমি কিরণের ফোন নাম্বারে আরো কয়েকবার চেষ্টা করলে। কোনো লাভ হলো না। ফেসবুকে কিরণের নামের তিনটা শব্দকে নানাভাবে লিখে খুঁজে দেখলে, কোনো ফল হলো না। কত মানুষই তো এর বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিরণও হয়ত তাই। শেষে একসময় একটা রিকশা নিয়ে ধানমন্ডি থেকে বেরিয়ে কলাবাগানের সিডির দোকানগুলোর দিকে চলে গেলে। এতদিনে কিরণের কোনো গানের সিডি বেরিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। শত শত সিডি ঘেঁটেও কিরণের নাম বা ছবি কোথাও পেলে না তুমি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে কিরণ তার পর থেকে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছে! হতেই পারে। সে খুব আঘাত পেয়েছিল। কিরণের গান ছেড়ে দেবার চিন্তাটা মাথায় আসতেই তোমার মনে হলো কিরণকে খুঁজে পাওয়ার সব রাস্তা যেন অন্ধগলিতে গিয়ে মিলে গেল। বাড়ি ফিরে তুমি ভাবতে লাগলে কী করা যায়। ক্লাসের কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে কিরণের কথা জানতে চাওয়ায় কেউ তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। একজন বলল, বছর দুয়েক আগে একবার একজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল, ঢাকাতেই থাকার কথা। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে তুমি ঠিক করে ফেললে, তিন দিনের ছুটি, শনি-রবি আর পহেলা বৈশাখ। এই তিন দিনের মধ্যে তুমি কিরণের খোঁজ বের করবেই করবে। আর এটা ভাবতেই তোমার প্রথমে যা মনে পড়ল, তা হলো, পহেলা বৈশাখে রমনায় গিয়ে দেখলেই তো হয়! কিরণ যদি ঢাকায় থেকে থাকে, তবে নিশ্চয় ওই অনুষ্ঠানে গাইতে আসবে। গান ছেড়ে দিলেও কিরণ নিদেনপক্ষে অনুষ্ঠানটা দেখতে আসবে। সে-ই তো বলেছিল, ঢাকায় থেকে ওখানে না যাওয়া তার মতে অসম্ভব। ঠিক করে ফেললে ওই অনুষ্ঠানে অন্ধকার থাকতেই তুমি গিয়ে হাজির হবে। মঞ্চ থেকে শুরু করে দর্শক আর পুরো রমনায় তন্ন তন্ন করে খুঁজবে তুমি তাকে। সেখানে না পেলে আর্ট কলেজের সামনের নববর্ষের র‌্যালিতে ঘুরে ঘুরে দেখবে। তোমাকে খুঁজে পেতেই হবে তাকে। দুটো দিন অস্থিরতায় কাটালে তুমি। এর মধ্যে নানান পত্রিকার অনলাইন আর উইকিপিডিয়া ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করলে, কী হয়েছিল পরে রমনায় বোমা ফোটানোর সেই বিচারে? হতাশ হয়ে তুমি দেখলে যে কিছুই হয়নি। বিচার কোথাও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। দশজন মানুষ মারা গিয়েছিল, পঞ্চাশ জনের মতো আহত হয়েছিল। তারিখের পর তারিখ পড়েছে বিচারের। বারবার বলা হয়েছে সাক্ষী অনুপস্থিত। চৌদ্দ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আর এদিকে এর মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলানো হয়েছে সাতবার। বিস্ময়ের হলেও বাস্তব যে আজ চৌদ্দ বছর কেটে গেছে, কোনো সুরাহা হয়নি। শনি-রবিবারজুড়ে তুমি বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিলে। তারপর পহেলা বৈশাখে সত্যিই খুব ভোরে পৌঁছে গেলে রমনার বটমূলে। ইলিশ আর পান্তা বিক্রির জন্য মানুষ মোটে তখন বাঁশের খুঁটি দিয়ে টেবিল সাজাচ্ছে। বড় ঝোলায় করে বাতাসা, কদমা কিংবা মুড়ি-মুড়কি নিয়ে কেউ পার্কের দিকে ঢুকছে। পুলিশ সমস্তকিছু খুলে খুলে দেখছে। যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করছে। তোমার পাঞ্জাবির পকেটও দফায় দফায় খতিয়ে দেখা হলো। তুমি বুঝলে, সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এটুকুই হয়েছে। চৌদ্দ বছর পরে তুমি রমনার অনুষ্ঠানে আবার সেই জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলে যেখান থেকে একদিন কিরণের হাত ধরে কিছু হতাহত শরীরকে পিছনে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে। মঞ্চের সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকলে। একে একে অনেক শিল্পী মঞ্চে উঠতে লাগল। আজকে তাদের গায়ে সাদা আর লাল রঙের কাপড়। শ্রোতার ভিড় বাড়তে থাকলে তুমি সামনে গিয়ে বসলে। আর বসে মঞ্চের দিকে তাকাতেই তুমি কিরণকে দেখতে পেলে। একইরকম আছে প্রায়। এই কটা বছরে কী আর এমন বদলাবে। নিশ্চিন্ত চেহারা আর অনুষ্ঠানের সারিতে আসন গেড়ে বসা কিরণের দিকে তোমার চোখ আটকে থাকল। সে হয়ত তোমার দিকে তাকাবে না, সে তো আর জানত না যে তুমি আসবে, তবু অন্য মানুষদের মাথার পিছনে নিজেকে একটু আড়াল করে রাখলে। একসময় অনুষ্ঠান শেষ হলো। মঞ্চের সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি। অন্যদের সঙ্গে একসময় কিরণ নেমে আসতে লাগল, হাতে তানপুরা। কিরণের চলন আগের চেয়েও শান্ত। তোমার দিকে চোখ পড়তেই সে থমকে গেল।

‘সাইফ, না?’

‘কেমন আছ, কিরণ?’

‘আমি ভালো। তুমি কোথায় ছিলে এতদিন বলো তো? আমি তোমার খোঁজ করেছিলাম। বিদেশ থেকে ফিরে এলে কবে?’

‘ফিরেছি কয়েক বছর আগে। খুব স্ট্রাগল গেল, কিরণ। হাজার ঝামেলায় কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম। তুমি ঠিক আছ তো?’

‘আমি একদম ঠিক। তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। মনে আছে, ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমি ঠিক আছি কি না? চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি আর চেঁচামেচি তখন, মনে পড়ে?’

‘হ্যাঁ, তার মাস তিনেক পরেই চলে গিয়েছিলাম আমি দেশ ছেড়ে।’

‘তুমি কি ভীতু, সাইফ?’

‘পুরোপুরি না। এই দেখ না ফিরে এলাম আবার। তখন মনে হয়েছিল, আর কী থাকল আমাদের? সবই তো গেল।’

‘কিছুই যায়নি আমাদের, সাইফ। ওইটুকুতে কিছু যায় না।’ কিরণ অদ্ভুত সুন্দর করে হাসল। তার কানের দু’পাশের লাল গোলাপ আর বেলির মালা দুলে উঠল। বারুদ আর রক্তের গন্ধের স্মৃতির জায়গায় অদ্ভুত বেলির গন্ধ জায়গা করে নিল। কাছেধারেই কোথাও বাঁশি আর ঢোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। কেউ বাজিয়ে শুনিয়ে বিক্রি করছে হয়ত। অসম্ভব সুন্দর সাজসজ্জায় কিছু ছেলেমেয়ে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিতে গ্রুপ ছবি তুলতে লাগল। সবকিছুর দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তুমি কিরণের দিকে তাকালে। কিরণ যেন তোমার মুখ থেকে কিছু শোনার প্রতীক্ষায়। তার মুখে তৃপ্তির একটা হাসি লেগে থাকল। তোমার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, ‘তুমি আর বৈশাখ শুনলে রক্তের গন্ধ পাও না এখন, তাই না, কিরণ?’ ‘ঠিক ধরেছ। পাই না। আমি ভয়কে জয় করেছি। দেখছ না, চারদিকে কতকিছুর সুগন্ধ? এত সুন্দরের মাঝখানে রক্তের গন্ধের জায়গা থাকে আর?’

তুমি অবাক-বিস্ময়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে থাকলে। মনে মনে বললে, এবারে আর তোমাকে হারাব না, কিরণ। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৮/তারা