আমার কিশোরীবেলার শুরুর সময়টা কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের ভবানীপুরে। অন্য দশটা শিশুর মতো আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কেটে যেত সময়। আমরাও ঈদ এলেই নতুন জমা জুতার বায়না ধরতাম। তখন স্কুলেও ভর্তি হইনি। মনে আছে বাবার সাথে ঈদের জামা কিনতে গিয়েছিলাম। আমি বললাম, আমার জামা আমি পছন্দ করবো। যে জামা পছন্দ করলাম সেটি ছিল আমার মাপের চেয়ে তিন সাইজ বড়! বাবা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তিনি সেই জামাটিই কিনে দিলেন। জর্জেট কাপড়; জামায় বিভিন্ন রং থাকায় আমার সত্যি খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু জামা কিনে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম মা বাবার সাথে খুর রাগ করলেন। বললেন, মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছো, পরে কিন্তু আর নামাতে পারবে না। বাবা কিন্তু কিছু বলেননি সেদিন। এখন ঈদের কথা এলে রমজানের ঈদ, কোরবানির ঈদ দু’টোর কথাই মনে পড়ে। আমার প্রথম রোজা রাখার কথাও বেশ মনে পড়ে। একবার বায়না ধরলাম, রোজা রাখবো। তো রোজা রাখলাম। সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো, তেমন কোনো সমস্যা হলো না। চারটা বাজার পরেই বললাম, পানি খাবো। পানি খাবো মানে পানি খাবো। এবং তখনই খেতে হবে। এবারও আমাকে অনেকভাবে বোঝানো হলো। কারও কথা শুনলাম না। আমাদের বাড়ি থেকে বাজার ছিল খুব কাছে। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গেলেন। আমি বাজারে গিয়ে এমন অবস্থা শুরু করলাম যে, যা দেখি তাই খাবো অবস্থা! বাবা এবারও আমাকে কিছু বললেন না। একের পর এক খাবার কিনে দিলেন। সেগুলো প্যাকেট করে আমাকে বললেন, চলো বাড়ি গিয়ে খাবে। সব কেনা হলো; যা যা চেয়েছিলাম। এবার পুনরায় বলতে শুরু করলাম, পানি খাবো, পানি খাবো, পানি দাও। বাবা আমাকে বললেন, চলো। ওই তো সামনে আর একটু গেলেই পানি খেতে পারবে। ওই তো সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে পানি নেবো। এভাবে বাবা বলছেন আর হাঁটছেন। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, তুমি ঢুকছো না কেন? পানি দিচ্ছ না কেন? এমন করতে করতেই আজান পরে গেল। সারা বিকেল বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে অনেক খাবার কেনা হলো ঠিকই কিন্তু আমি একটু শরবত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। আর কিছুই খেলাম না। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে যখন পাকিস্তান আমল শুরু হয়ে গেছে। আমিও একটু বড় হয়েছি, অর্থাৎ যখন স্কুলে পড়ি, ফোর থেকে সেভেন- এই সময় টানা পাঁচ বছর কেটেছে ফরিদপুর। এক ফুফু থাকতেন আমাদের সঙ্গে। ঈদে আমার দাদার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকেই ফরিদপুরে বেড়াতে আসতেন। নানী বাড়ি থেকেও আত্মীয় স্বজন আসতো। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন, হাসপাতালের অনেক স্টাফ আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাদের বাড়িতে বাবুর্চি ছিল, বিশালদেহী মানুষ। বাইরের ঘরের বারান্দায় সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হতো। ঈদে মা নিজে আমাদের জামাকাপড় সেলাই মেশিনে সেলাই করে দিতেন। মাকে গিয়ে বলতাম, আমার জামার মাপ নাও। খুব প্রাউড ফিল করতাম। খুব মজা লাগতো! সেলাই মেশিন চলছে তো চলছেই। আমরা ভাই-বোনেরা মিলে হয়তো খেলছি আর মাঝে মাঝে দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে দেখছি কতদূর কী হলো! তারপর মজা হতো বাবার সাথে জুতা কিনতে গেলে। জুতা কিনে এনে আমি তো নতুন জুতা প্যাকেটসহ কোলের কাছে রেখে ঘুমাতাম। ক্লিপ-ফিতা-চুড়ি এগুলো সব কেনা হতো। তার কারণ হলো, তখন কিন্তু নানা রকম উৎসব ছিল না। ঈদ ছিল। এখন যেমন কেউ বিদেশ চলে যায় বেড়াতে, কেউ এটা করে ওটা করে। নানান রকম কাজ মানুষের। উৎসবের কেন্দ্রে এখন আর ঈদ নেই। এতো উপলক্ষ্যের ভিড়ে সরে গেছে। রমজানের ঈদ আর ঈদুল আজহা আসা মানে শিশুদের বাধভাঙা আনন্দ। স্কুল বন্ধ হয়ে যেত, কোচিংয়ে যেতে হতো না। বাড়িতে পড়ালেখার জন্য ওই সময় কোনো চাপ দেওয়া হতো না, আনন্দ আর আনন্দ। তবে হ্যাঁ, ‘কোরবানি’ তেমন বুঝতাম না। কোরবানির আয়োজন বাড়ির বাইরে করা হতো। কোথায় কোরবানি হতো তাও দেখতাম না। বাড়িতে গোশত আসতো তাই দেখতাম। জর্দা ফিরনি সেমাই পোলাও এগুলো মা রান্না করতো, আমরা খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। নতুন জামা-জুতা পরে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম। আমাদের বাড়িতেও বন্ধুরা আসতো। একসাথে খাওয়া-দাওয়া হতো। বিরাট একটা ডেকচি ছিল আমাদের। ওটাতে গোশত জ্বাল দিয়ে রাখা হতো। বাবুর্চি বসে বসে জ্বাল দিতো। ওহ্ সেই গোশত খেতে যা মজা! আগেই বলেছি বাবা ডাক্তার ছিলেন। হসপিটালের ইনচার্জ ছিলেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাবাকে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে দেখেছি। পরিবার সামলানো ছিল মায়ের ডিপার্টমেন্ট। মাকে সহযোগিতা করতো বাবুর্চি। বাবুর্চির আবার একজন হেলপার ছিল। কাজের লোকও ছিল। তারা মাকে সহযোগিতা করতো। ওরাই গোশত ভাগ করতো। প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে সেগুলো পাঠানো হতো, গরিবদের দেওয়া হতো। মজার ব্যাপার হলো, গোশত যেমন আমাদের বাড়ি থেকে যেত, তেমনি অন্যদের বাড়ি থেকেও আসত। মানে হলো, একপাশ দিয়ে যাচ্ছে, আরেক পাশ দিয়ে আসছে। বাবার অনেক রোগী ছিলেন যারা আমাদের বাড়ি গোশত পাঠাতেন। ফরিদপুরের দিনগুলো ছিল এমন। ফরিদপুর থেকে আমরা চলে এলাম। আমি চাঁদপুর মামার বাসায় ছিলাম অল্প কয়েকদিন। ১৯৫২ সালের দিকে ঢাকায় আমাদের বাড়ি কেনা হলো। আমরা ঢাকা চলে এলাম। আমি তখন এইটে পড়ি। ঢাকায় আসার পরেও ঈদের ছুটি পেলেই ফুফুর বাড়ি, খালার বাড়ি, মামার বাড়িতে যেতাম। ঈদের আনন্দ ছিল দীর্ঘমেয়াদি। এ গল্পগুলো বিয়ের আগের। বিয়ের পর, নিজের রান্নার পর্ব শুরু হলো। আমি বিয়ের আগে কোনো দিন রান্না ঘরে ঢুকিনি। এখানে-ওখানে বসে বসে বই পড়তাম। মা আমাকে কিছু বলতেন না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম রান্না পারফেক্ট হতো না। দায়ে পরে রান্না শিখেছি। তারপর আস্তে আস্তে হয়ে গেল। শিখতে হলো ঠিক শখ থেকে কিন্তু নয়, এই বিষয়ে আমি একটা অপদার্থ। রান্না শেখার প্রধান কারণ হলো, আমি বুঝতে পারলাম প্রতিটি সন্তান মায়ের হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্ত হয়। আমি যখন মা হলাম তখন রান্নাতে এ কারণেই মনোযোগ দিতে হলো। মা যেসব রান্না করতেন, আস্তে আস্তে সেগুলো সবই প্রায় শিখে ফেললাম। বিষয়টি আগে আমার কাছে সহজ ছিল না, পরে সহজ হয়েছে। এই তো গত বছরও ঈদে আমি দাঁড়িয়ে থেকে সব রান্না করালাম- মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি, ফিরনি, জর্দা বাসায় রান্না করা হলো। ঈদের পরের দিন, মা’র বাড়িতে যাওয়া হতো। মা মারা গেছেন বিরাশি বছর বয়সে, তখন ২০০৩ সাল। তার আগ পর্যন্ত প্রতি ঈদে মায়ের কাছে যেতাম। ঈদে সেখানে ছোটখাটো একটা সম্মেলন হয়ে যেত। জামাই-মেয়ে, নাতি-নাতনী নিয়ে তার ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। কত পদের যে রান্না! মোরগ পোলাও, কাবাব, বোরহানি, কোরমা, কোপ্তা- মা নিজ হাতে সব রান্না করতেন। যে যেটা পছন্দ করে সে অনুযায়ী, মা বেছে বেছে পাতে তুলে দিতেন। বাড়িজুড়ে বাচ্চাদের হুল্লোড়, ছোটাছুটি, লাফালাফি চলতেই থাকতো। তার বকশিশ দেয়ার দৃশ্যটা ছিল নান্দনিক। বুয়া থেকে শুরু করে ড্রাইভাররাও মা’র বকশিশ পেত। এজন্য তার নিজস্ব তহবিল ছিল। সবাইকে দেয়ার জন্য নতুন টাকা মা রেখে দিতেন। পড়ার অভ্যাস আমার বরাবরই ছিল। আমাকে পড়ার জন্য কখনো বলতে হতো না। ১৯৬৮-এর কথা মনে আছে, আমি মনে হয় প্রথমবার ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস লিখলাম ‘বিচিত্রা’য়। তখন তো আর এতো পত্রিকা ছিল না, আর এতো ঈদ সংখ্যা বের হতো না। ওই সময়ে ‘বেগম’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা বের হতো। মলাটে দারুণ ছবি থাকতো, দেখে ভালো লাগতো। একবার ‘ললনা’ পত্রিকায় গল্প লিখেছিলাম। ওই সময় ঈদ সংখ্যা মানে হট ডিমান্ডেড লেখক ছিলেন রাবেয়া খাতুন, মকবুলা মঞ্জুর এরা। আমরা তাদের চিনেছি লেখা পড়ে। আমি নিজে যখন লেখা শুরু করলাম, তখন পত্রিকা অফিস থেকে টেলিফোন করে ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা চাইতো। বিষয় নির্ধারণ করে দেয়ার ব্যাপার ছিল না। আর আমি কখনো ফরমায়েশি লেখক ছিলাম না। কারও নির্ধারণ করে দেয়া বিষয়ে কখনও লিখিনি। অনুলিখন : স্বরলিপি রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ আগস্ট ২০১৮/তারা