শিল্প ও সাহিত্য

শার্ল বোদলেয়ার ও তাঁর কবিতা

আগন্তুক

কাকে তুমি ভালোবাসো সবচেয়ে বেশি, হেয়ালি মানব? তোমার বাবা?

তোমার মা, তোমার বোন অথবা তোমার ভাই?

‘আমার না আছে বাবা, না আছে মা, না বোন, না ভাই’

‘তোমার বন্ধু?’

‘এখন তুমি এমন এক শব্দ ব্যবহার করছো যার অর্থ আমি এখন পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি।’

‘তোমার দেশ?’

‘আমি জানি না কোন অক্ষাংশে তা অবস্থিত।’

‘সৌন্দর্য?’

‘আমি সানন্দে তাকে ভালোবাসতে পারতাম, দেবী আর অমরত্ব।’

‘স্বর্ণ?’

‘আমি এটাকে ঘৃণা করি যেমন তুমি ঈশ্বরকে করো।’

‘আচ্ছা, তাহলে কী তুমি ভালোবাসো, অদ্ভুত আগন্তুক?’

‘আমি ভালোবাসি মেঘেদের... ভাসমান মেঘেদের... ওইখানে... ওই

 উঁচুতে... ওই বিস্ময়কর মেঘেদের!’

 

মাতাল হও

তোমাকে সব সময় মাতাল হতে হবে। এইটাই হলো মোদ্দা কথা- এটাই একমাত্র পন্থা। তাই সময়ের ভয়াবহ বোঝা তোমার পেছনে আর তোমাকে পৃথিবীতে ঝুঁকিয়ে দেয়ার আগেই তোমাকে ক্রমাগত মাতাল হতে হবে। তবে কিসে? মদে, কবিতায় অথবা পূণ্যে, যা খুশি, তবে মাতাল হও। আর যদি কখনো, কোনো প্রাসাদের দোরগোড়ায় অথবা কোনো পরিখার সবুজ ঘাসে, তোমার বেদনাতুর নিঃসঙ্গ কক্ষে, যদি আবার জেগে ওঠো, বাতাসকে জিজ্ঞেস করো, ঢেউকে জিজ্ঞেস করো , জিজ্ঞেস করো নক্ষত্রকে, পাখিকে, ঘড়িকে, যা কিছু উড়ুক্কু, যা কিছু ক্রন্দনরত, যা কিছু ঘুর্ণায়মান, যা কিছু সব গান গায়, যা কিছু কথা বলে... জিজ্ঞেস করো, এখন কিসের সময় আর বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি তোমাকে উত্তর দেবে, ‘এখনই সময় মাতাল হওয়ার! তাই সময়ের শহীদ ক্রীতদাস হওয়ার আগে, মাতাল হও, ক্রমাগত মাতাল হও! মদে, কবিতায় অথবা পূণ্যে যা খুশি তাতে।’

 

একটি প্রাণবন্ত সরাইখানা

(ব্রাসেলস থেকে ওকেলে যাওয়ার পথে)

আমি জানি হে সুরুচির কাঠামো

এবং লোক মিষ্টান্নের নিদর্শন

তোমার সরলতম রসনা পূরণে

(একটি ডিম ভাজাও বাকী স্বাদ সেরে নেবে),

 

আর, তাই, প্রাচীন ফারাও, মনসেলে*

এইখানে এই পথে আমি তোমাকেই ভাবছি

কেননা একটি অপ্রত্যাশিত সাইন এখানে ঝোলানো

বলা আছে: সরাইখানা, সমাধি মদ ও কফি দোকানের দিকে।

* চালর্স মনসেলে উনবিংশ শতকের ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কবি, সাংবাদিক। তাকে আদর করে ‘ভোজন রসের রাজা’ বলা হতো।

 

জানালাগুলি

বাইরে থেকে একটা খোলা জানালার ভেতরে তাকিয়ে একজন কখনোই ততোটা দেখতে পায় না যতোটা একজন বন্ধ জানালার ভেতর দিয়ে দেখতে পায়। একটিমাত্র মোমবাতিতে আলোকিত জানালার চেয়ে অধিক গভীর, অধিক রহস্যময়, অধিক গর্ভবতী, অধিক কপট, অধিক উজ্জ্বল আর কিছু নেই। বাইরে সূর্যালোকে যা দেখছে কেউ একজন তা অনেক কম আকর্ষক জানালার আড়ালের চেয়ে। সেই কালো কিংবা উজ্জ্বল আলোর বর্গাকারের ভেতরে জীবন প্রাণবন্ত, জীবন স্বপ্নময়, জীবন ভোগান্তির।

ছাদের সমুদ্রের বাইরে দিয়ে আমি দেখতে পাই এক মধ্য-বয়স্ক নারী, এখনই তার মুখে বলি রেখা, যে এখন কোনো কিছুর দিকে ঝুঁকে আছে এবং যে কখনোই বাইরে যায় না। তার মুখের বাইরে, তার পোশাক এবং তার অঙ্গভঙ্গি, কার্যত আমাদের কোনো কিছুই না, আমি এই নারীর গল্পটি বানিয়েছি অথবা আরো বলা যায় কিংবদন্তীই, এবং কখনোবা আমি এ গল্প নিজেকেই বলি আর কাঁদি।

যদি সে একটা বৃদ্ধ লোক হতো, আমি হয়তো তার গল্পটাও এমনই ভালো করে বলতে পারতাম।

আর আমি বেঁচে থাকার গৌরব এবং আমার নিজের পাশেই আরেকজনের যাতনা নিয়ে বিছানায় যাই।

হয়তো তুমি বলবে, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার গল্পটি সত্যিকারের একটি গল্প?’

কিন্তু আমার বাইরের বাস্তবতা কি তাতে কী আসে যায়, যতোক্ষণ এটা আমাকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে,

আমাকে আমার অনুভব দেয় এবং আমি আসলে কে?

 

পাইপ

আমি লেখকের পাইপ;

কেউ আমাকে রং দিয়ে চিনবে,

হাবশী কিংবা কাফ্রী,

আদতে আমার প্রভু, একজন মহান তামাকসেবী।

 

যখন তিনি বেদনায় ভারাক্রান্ত

আমি একটা কুটিরের মতো ধোঁয়া ছাড়ি

যেখানে তারা নৈশ আহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে

চাষীর ফিরে আসার অপেক্ষায়।

 

আমি আলিঙ্গন করি প্রশমিত করি তার আত্মাকে

তরঙ্গায়িত নীল জালে

যা উত্থিত হয় আমার জ্বলন্ত মুখ থেকে।

 

আমি ছড়িয়ে দেই মেঘের মতো সুগন্ধী পাতা

যা উষ্ণ করে তার হৃদয় আর আরোগ্য করে

তার মনের অবসাদ। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা