শিল্প ও সাহিত্য

পলিটিক্যাল ডিগবাজি

|| অরুণ কুমার বিশ্বাস ||

ডিগবাজি মূলত শারীরিক কর্ম-কসরতের একরকম পদ্ধতি বা ধরন বলে পরিগণিত হলেও যারা গণিতে কাঁচা, তাদের জন্য এমম্বিধ প্র্যাকটিস মোটেও সুখকর নয়। টাইমিং বা সময়ানুগ চেষ্টা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতদূর মনে পড়ে, ছোটোবেলায় স্রেফ শখের বশে বন্ধুরা মিলে অনেক সময় ডিগবাজি প্র্যাকটিস করতাম। যারা একাজে যথেষ্ট পারঙ্গম, তারা কিন্তু ডিগবাজির খেলায় হেসেখেলে বেশ উতরে যেত। কিন্তু আমার মতো নাদান ও পাটিগণিতে যারা কাঁচা, তারা ডিগবাজি দেবার উদ্দেশে মাথা নিচু করে পশ্চাদ্দেশ উত্তোলন করলেও শেষমেশ ‘বাজি’ বা খেলটা আর দেখানো হতো না। বরং আমাদের কাণ্ড দেখে চৌকস বন্ধুরা আচ্ছাসে ডুগডুগি বাজাতো বা একযোগে সব করতালি দিত। আমার এ নিবন্ধের গৌড়চন্দ্রিকা আপাতত এটুকুই থাক, এবার আসল কথায় আসি। সামনে জাতীয় নির্বাচন। দেশের আনাচে-কানাচে গলিঘুঁপচি সবখানে বইছে ইলেকশনের প্রমত্ত হাওয়া। সেই হাওয়ার তোড়ে অনেকের পক্ষেই সরল সিধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে, ফলে তারা চাই কি না-চাই, ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বেশুমার ডিগবাজি খেয়ে বসে আছেন। রাজনীতির খেলায় দল-বদল বস্তুত নতুন কিছু নয়। গণতন্ত্রের চর্চায় নানা মুনির নানা মত থাকবে, একদলের খেয়ে অন্য দলের হয়ে সেমসাইড গোলের প্রচেষ্টাও থাকবে, আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে স্রেফ গায়ের চামড়া বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে বিরোধী শিবিরে গিয়ে নিজের চোপা প্রদর্শন করবেন। এই যে দলবিরোধী কাজকাম, বা মুখে এককথা কিন্তু মনে আরেক- একে আমরা কী বলতে পারি! ডিগবাজি বা পল্টিবাজি। পল্টিবাজ যারা তারা কিন্তু অনায়াসে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে শুধুমাত্র মনোনয়নের মুলো চাখার লোভে চোরাগোপ্তা উপায়ে অন্য দলে গিয়ে নাম লেখান। আবার অনেকে আছেন এমন, যারা কিন্তু ডিগবাজি একটা নয়, ছোট্টবেলার সেই সার্কাসের ক্লাউনের মতো সারা গায়ে রঙচঙ মেখে একাদিক্রমে বেশ কিছু ডিগবাজি খেয়ে বসেন। তাতে তাদের গা ব্যথা হয়, কিন্তু মন ভাঙে না। এটাই যে তাদের অভ্যেস। কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, ডিগবাজি খেতে গেলে গণিতে পাকা হতে হয়, তদুপরি গায়ে গতরে তাগত থাকতে হয়। নইলে বুড়ো বয়সে চমক দেখাতে গিয়ে নিজের শরীরের হাড়গোড় ভেঙে অনেক সময় ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হবার আশঙ্কাও থেকে যায়। রাজনীতির মাঠে খুব বেশি পল্টিবাজ যারা, তারা কিন্তু হালে সব সময় পানি পান না। কারণ সেই আস্থার সঙ্কট। বারবার দল বদল করতে করতে একসময় সে নিজেই ভুলে যায় যে, তার জন্ম লুসাই পাহাড়ে নাকি গোবি মরুভূমির বালুতটে! বিশেষত কাজেকামে নেই, অথচ মোহনভোগলোভী (মতান্তরে মনোনয়ন) যারা, তাদের কিন্তু প্রচেষ্টার শেষ নেই। তার মূলফটক, ব্যাকডোর, ট্র্যাপডোর, চাই কি রসুইঘরে গিয়েও মনোনয়নের ধান্ধায় যার তার সাথে হিসাব নিকাশে বসে যায়। পিপেভর্তি তেল আর ট্যাঁকভর্তি টাকা নিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। দুচোখে মিনতিভরা দৃষ্টি, সেখানে প্রবল আকুতি নিয়ে ভেসে ওঠে একটাই মাত্র কথা- ভাই, অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যান। দয়া করে আমারে মনোনয়নের মুলোখানা একটু ছুঁতে দেন। তারপর আমি দেখিয়ে দেবো রাজনীতি কাকে বলে! হোয়াট ইজ পলিটিকস! এসব প্রফেশনাল পল্টিবাজদের আমি সার্কাসের ক্লাউনের সাথে কেন তুলনা করেছি সে ব্যাখ্যায় আসছি একটু। আমরা জানি, রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। এই দল ওই দল কোন্দল- সবই থাকবে। সবাই যে রাজনীতিটা ঠিক বুঝে করে তা তো নয়! রাজনীতি এখন অনেকটাই হয়ে গেছে ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি অর্জনের হাতিয়ার। ফেল কড়ি মাখো তেল, দেখিয়ে দাও ভাই পলিটিক্যাল খেল! অবশ্য রাজনীতি আর ব্যবসার মাঝে বেশ খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে বৈকি। পাশ্চাত্যে বলা হয়, বিজনেস ইজ অ্যান আর্ট। আর পলিটিকস হল গিয়ে ‘আর্ট অফ কমপ্রোমাইজ’। তাই সেখানে দলাদলি তেলাতেলির অবকাশ থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! সার্কাসে যারা খেলা দেখায়, তাদের কিন্তু অত লাজলজ্জার বালাই থাকে না। দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য কখনও কখনও তাদের যা নয় তাই করে দেখাতে হয়। নইলে টিকিটের টাকা উসুল হবে না যে! আর দর্শক যদি একবার মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে পাটিগণিত বা বীজগণিতে আর কাজ হবে না, রাজনীতির মাঠে ঘুঘু চড়বে। নির্বাচন সামনে রেখে একশ্রেণির প্রফেশনাল পল্টিবাজের দেখা মিলছে। এদের কাজই হলো গিয়ে ঘোপেঘাপে কাজ সারা। রাজনীতিটা ঠিক বোঝে না, করেও না, তবু তাদের মনোনয়ন চাই। যেন দলীয় মনোনয়ন পেলেই পাবলিক লাইন ধরে তার মুখে ভোটের সিলখানা মেরে আসবে! এমনও দেখা গেছে, দীর্ঘ পাঁচ বছর চিকা মেরে এখন গিয়েছেন তিনি বিরোধী শিবিরের মনোয়ন চাইতে। মজার ব্যাপার, মনোনয়ন তিনি লভিয়াছেনও বটে, কিন্তু কেন্দ্রের কথা মানছে না তার রাজনৈতিক এলাকার জনগণ। এমন কি, যেই দল থেকে তিনি মনোনয়ন পেলেন, তাদের সব নেতাকর্মী মুড়োঝাঁটা নিয়ে হৈ হৈ করে তেড়ে আসছে এই ‘জাতীয় বেইমান’কে শায়েস্তা করতে। বস্তুত, ব্যাকডোর দিয়ে কাজ সারতে গেলে এমনই হয়। তখন তাকে আর কষ্ট করে ডিগবাজি খেতে হয় না, নেতাকর্মী আর জাগ্রত জনতা মিলে ঠ্যাঙ ধরে ল্যাং মেরে মুরগি বানিয়ে দেয়। এবার আসুন জানা যাক, রাজনীতি কী এবং কেন, ইহা করিলে কী হয় আর না করিলেই বা কী! একশ্রেণির বর্ষীয়ান তাত্ত্বিক বলবেন যে, রাজনীতি হলো গিয়ে ইয়ে মানে নীতির রাজা। কেউ কেউ বলেন,  যে নীতি পরিপালনের জন্য রাজপথে গিয়ে রক্তাক্ত হতে হয় তাই হল গিয়ে আসল রাজনীতি। অবশ্য আমরা এদ্দিনে এটুকু বেশ বুঝে গেছি, রাজনীতি অতিশয় ফলদায়ক বিষয়। এই কাজ করে কেউ নিঃস্ব হয়েছে এমন উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন না। বাস্তবে নেইও। তবে পাটিগণিত না বুঝে, অসময়ে এই কার্যে প্রবৃত্ত হইলে অনেক সময় তা বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়, এবং তাতে ভিটেমাটি চাঁটি হবারও উপক্রম হতে পারে। সে যাক, শুরুটা হয়েছিল ডিগবাজি দিয়ে, শেষটাও না হয় তাই দিয়েই হোক। আমার অফিসে এক অধস্তন কর্মচারী আছে। কিছুদিন পরপর সে বায়না করে- স্যার, একটু ছুটি চাই। কেন কেন, আবার কী হল! সেদিন না ছুটি নিলে! সে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, স্যার, আমার নানি মারা গেছে। তার কুলখানি। অতীব মানবিক বিষয়, তাই ছুটি দিতে কসুর করি না। মাসখানেক যায়, আবার সে ফিরে আসে। স্যার, আমার নানি আর নাই। তার কুলখানি, তাই ছুটি চাই। আমি তেতো গলায় বলি, আবার নানি! এক মুরুগি কতবার জবাই হয় ভাই? সে চুপচাপ থাকে। আমি ভাবি, হতে পারে তার নানাজান দুইবার দারপরিগ্রহ করেছেন। তাই ছুটি দিয়ে দিই। পরের উপকার করিলে সওয়াব হয়, আমিও তাই অশেষ সওয়াব হাসিল করি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এখানেই এ কাহিনীর শেষ নয়। গল্প আরো কিছুটা বাকি। মাসখানেক পরে আবার তার চেহারা দেখতে পাই। কী রুস্তম, তোমার নানি মারা গেছেন বুঝি? সহাস্যে বলি। রুস্তম লাজুক হেসে বলে, স্যার, আমার নানাজান আর নাই। আমি মুখ ফসকে বলে ফেলি, যাক, তাহলে এরপরে আর তোমার ছুটি লাগবে না, তাই না! তাতে কিন্তু হা হা করে ওঠে আমার অধস্তন রুস্তম। বলে, সে কি কথা স্যার, নানাজান তো মরি মরি, এখনও মরে নাই। তিনি সেরি উঠলে আরেকখান নিকাহ করবেন শুনলাম। তখন আবার নানি হবে। আমিও ছুটি পাবো। এই গল্পের মাজেজা হলো, যারা ডিগবাজ তাদের নানা-নানির শেষ নেই, বয়ানেরও অবধি নেই। রুস্তমের মতোন তারা হরহামেশা যখন-তখন এসে মনোনয়ন চাইবে। আমি না দিলে বড়কর্তা দেবেন। তবু ছুটি থুক্কু মনোনয়নের মুলো তারা চাখিবেনই চাখিবেন। ‘পলিটিক্যাল ডিগবাজি’ বলে কথা। হে হে হে! রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা