শিল্প ও সাহিত্য

গোলাপেও বিষ আছে

অরুণ কুমার বিশ্বাস : নবনীতা বড় ভালো মেয়ে। অন্তত পাড়ার সবাই তাই বলে। আমিও তেমনই জানতাম, নইলে কি আর আগবাড়িয়ে স্বেচ্ছায় হামাগুড়ি দিয়ে হাঁড়িকাঠে মাথা গলাই! পরিচিত সবার কাছে নবনীতা আদর্শ মেয়ে হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। পপুলার ল্যাংগুয়েজে যাকে বলে সাক্ষাত ‘রোল মডেল’। মেয়ে হিসেবে হয়তো সে ভালোই ছিল, কিন্তু বউ হিসেবে নয়! আমি তাকে বিয়ে করে ভালোবাসার মোড়কে জড়িয়ে সোফা-কাম-বেডসমেত মোটামুটি একখানা ভালো বাসায় এনে তুলতেই বুঝলুম, সে শুধু বিদূষী নয়, মুখরাও বটে! ওর পক্ষ নিয়ে বললে বলা যায়, নবনীতা আউট স্পোকেন, আই মিন সোজা কথার মানুষ। অতশত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে শুধু মেয়ে নয়, মেয়ের বাপ-মা চৌদ্দ গোষ্ঠি ঠোঁটকাটা। মুখের উপর কারো নিন্দেমন্দ করতে ওদের জিভে আটকায় না। আমি ওকে ‘নবনী’ বলে ডাকি। আজকের এই শর্টকাটের যুগে এত বড় বাহারি নাম বারবার মুখে আনা বড্ড দুষ্কর। একদিকে যেমন ক্যালরি খরচ হয় বেশি, আবার শব্দ দূষণেরও সমূহ আশঙ্কা থাকে। একটু ভাবুন তো, নবনীতা উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রতিবারে চারটি করে বর্ণ, দুটো আ-কার, ই-কার, দিনে যদি নিদেনপক্ষে পঞ্চাশবার বলতে হয় তাহলে দু’শ বর্ণ একশ ‘কার’ সহযোগে উগড়ে দিতে কী পরিমাণ ক্যালরি বাজে খরচ হবে! ক্যালরি তো আর বানের পানি কিংবা কর্পোরেশনের গ্যাস নয়, যে যার ইচ্ছেমতো একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা উনুন জ্বালিয়ে রাখবো! গ্যাস পুড়ছে পুড়ুক। নিজের তো নয়! নবনী দেখতে মন্দ নয়। আমার বন্ধুমহল তাই মনে করে। অবশ্য অন্যের বউ বরাবরই দৃষ্টিসুখকর। বড্ড মিষ্টি লাগে। কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহী হয়ে বন্ধুপত্নী মিষ্টি কি নোন্‌তা যাচাই করার জন্য লেটেস্ট মডেলের নকিয়া সেটসহযোগে পরকীয়ায় নেমে পড়েন। যাকগে যাক, আমি আজ আমার বন্ধুদের সমালোচনা করার জন্য কলম ধরিনি, আমার উদ্দেশ্য অন্যরকম। আজ আমি শুধু আজকের কথাই বলবো। যেমনটি একবার বলা হয়েছে, নবনীতা কেবল বিদূষী নয়, সে মুখরাও বটে! প্রতিদিন অফিস যাবার মুখে কোন না কোন অছিলায় একবার তার সাথে আমার ঠোকাঠুকি হবেই। এটা নাকি আমার পথখরচা। একবার পকেটে পুরে নিলে সারাদিন চালিয়ে নেয়া যায়। কাজের দফারফা, মাথার চাঁদি গরম, কেমন একটা বিস্বাদ চোঁয়া ঢেঁকুর কণ্ঠনালী বেয়ে মুখগহ্বর ধরে বহির্গমনের পথ অনুসন্ধান করে। আজ বড় তাড়া ছিল, তাই নবনীর সাথে মনের সাধ মিটিয়ে বাদানুবাদ করা গেল না। অন্যসময় খোঁচা খুনসুটি থেকে শুরু করে হাতাহাতি অব্দি চলে যাই, নিদেনপক্ষে দু’চারখানা ফুলদানি, চায়ের কাপ-প্লেট, নয়তো অ্যাশট্রে হাওয়ায় উড়বে, আমি তুখোর ফিল্ডারদের মতো নবনীর ছোড়া ফ্লাইং সসার সুকৌশলে তালুবন্দি করবো, তবেই না সুখ। কিন্তু আজ আর সেসব কিছু হল না। গেল হপ্তায় টেকো বসের রসকষহীন কড়া ধমক খেয়ে দাপ্তরিক কাজের প্রতি কিছুটা ‘সিনসিয়ার’ হবার চেষ্টা করছি। কারণ বউয়ের সাথে ঝগড়া মাঝরাতেও করা যায। কিন্তু চাকরিখানা চলে গেলে শত চেষ্টা করেও আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। চাকরির বাজার তেতে উঠেছে ক্রমশ। ছুড়ে দেয়া তীরের মতো একবার গেলে আর ফিরে আসে না। চোখের পলকে কয়েক লাখ কাঠবেকার একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সারাটা দিন আমার ভীষণ মন খারাপ। সাধ মিটিয়ে ঝগড়া করা হয়নি। নবনীর ছোড়া তীরটা হজম করেই বেরিয়ে যেতে হলো, স্কাডের বদলে মিসাইল ছোড়া হলো না। এমন পরাজয় সহজে মেনে নেয়া যায় না। পুরুষ বলে কথা! ‘হালুম’ না থাকলে সে আবার বাঘ কিসের! কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, পরাজয়ে ডরে না বীর! একমাঘে কখনও শীত যায় না। শীত আবার আসবে। আমিও লেপ-কাঁথা নিয়ে তৈরী। ‘এবার ফিরাও মোরে...’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বো। অফিস ফেরত বাসার বাস ধরবো বলে প্রেসক্লাবের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু বাসের দেখা নেই। এই সময়টায় নগরবাসীর বড্ড হেনস্থা! চাতকের মতো উন্মুখ হয়ে সব বসে থাকে। অথচ সেই বহু প্রতীক্ষিত পরিবহণের কোন খবর নেই। যাও বা দু’একটা আসে, অমনি একঝাঁক মানুষ পঙ্গপালের মতো ছেঁকে ধরে। রুট মেলে না, ঠাঁই মেলে না বাসে। পা রাখার জায়গাটুকুও নেই বাসের পাদানিতে। যাদের কাছে জানের চেয়ে সময়ের মূল্য বেশি তারা ‘বনের রাজা টারজানের’ মতো বাম্পারে পা রেখে ঝুলে পড়ে, সারাটা পথ বাদুর ঝোলা হয়ে নগরের শোভা বর্ধন করে। বেঘোরে মারাও যায় কেউ কেউ। আমি পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগোলাম। আমি বাবা বেঘোরে প্রাণ খোয়াতে রাজি নই। নবনী এখনও মা হলো না, জীবনের গলি-ঘুপচি কিছুই চেনা হয়নি এখনও। এরই মধ্যে টুপ করে মরে গেলে লোকে কী বলবে! সাতটা না পাঁচটা না, একটা মাত্র বউ আমার। তাকে এমন অকুল পাথারে ভাসিয়ে আমি স্বার্থপরের মতো অকালে সটকে পড়তে পারি না। এমন অনাচার ধম্মে সইবে না। মহামান্য হাইকোটের্র সামনে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। গোলাপ, ডালিয়া, আর কিছু মলিন চেহারার গ্লাডিওলাস। নিশ্চয়ই কুড়িয়ে পেয়েছে কোন ফুলের দোকান থেকে। সার, কিনবেন এট্টা ফুল! লন না, দুই দিন কিছু খাই নাই। মেয়েটা এমনভাবে সার বলছে, আমার কানে ওটা ঠিক ‘ষাঁড়’ বলে মনে হলো। নবনী প্রায়ই বলে, আমি নাকি বুনো ষাঁড়ের মাতো গোঁয়ার্তুমি করি! মেয়েটাও বুঝি বুঝে গেছে আমার আসল চরিত্র! ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া হলো। সত্যিই সে দুদিন কিছু খায়নি! একবেলা না খেলে আমার পেটে রীতিমতো ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে যায়, আর এ বলছে দুদিন কিচ্ছু খায়নি! চিমসে পেটে দানাপানি পড়েনি। পাঁজরের সবগুলো হাড় গুনে ফেলা যায়! চর্বি শুকিয়ে পিঠ আর পেট আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। দারিদ্র্যের এমন বীভৎস নগ্ন রূপ আর কোথাও আছে কি!  আলগোছে আমার হাতটা পকেটে চলে গেল। এমনিতে আমি যে খুব ‘দয়ার শরীর’ তা নয়। তবে বাচ্চা মেয়েটার বিশুষ্ক বুভুক্ষু মুখের পানে তাকিয়ে আর স্থির থাকতে পারিনি। গোঁয়াড় বলে কি আমার মন বলে কিছু নেই! দশ টাকা দিয়ে একটা গোলাপ কিনে নিলাম। বাসও জুটলো খানিক বাদে। সটান বাসায় ফিরে এলাম। আজ আর কলহ নয়, নয় কোনো যুদ্ধ। ভালো কোনো কাজ করলে মন ভালো হয়ে যায়! ঠিক করলাম, এই গোলাপ শুঁকিয়ে নবনীর সাথে সন্ধি করে নেব। বড্ড খিদে পেয়েছে। ঝগড়া করার মতো এনার্জি নেই আজ। মিছেমিছি ক্যালরি খরচ করে কী লাভ! ওটা তো আবার আমাকেই জোগাতে হবে! কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বাস্তবে হয় আরেক। কলবেল টিপে দাঁড়িয়ে রইলাম বেকুবের মতো। নবনীর দেখা নেই। তবে কি সে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়সহযোগে লাঞ্চ সেরে ভাতঘুম যাচ্ছে! এত দেরি করছে কেন দরজা খুলতে! দু’রুমের ছোট্ট বাসা, ম্যারাথন রেসের মাঠ নয় যে পুরোটা ডিঙিয়ে দরজার কাছাকাছি আসতে ঘণ্টা পেরোবে! মনটা ভীষণ খিঁচড়ে গেল! খায়, আর পড়ে পড়ে ঘুমায়। দিন দিন জলহস্তীর মতো গাড়ে-গর্দানে এমন বেড়েছে না, দেখে মাঝে মাঝে নিজেরই ভুল হয়, এই নবনী তো, নাকি ওর কাঁধে বেম্মদত্যি ভর করেছে কোন। কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই! অবশেষে তিনি এলেন, থপথপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ততক্ষণে আমার মেজাজ চড়ে টঙ! তবু সামলে নিলাম নিজেকে। গোলাপটার একটা সদ্‌গতি করা দরকার। নইলে দশটা টাকা মাঠে মারা যাবে। ও দরজা খুলতেই হাতসমেত সুগন্ধী গোলাপ বাড়িয়ে দিলাম। নবনী নিল বটে, তবে ওর চোখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল না। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছে বোধ হয়। নাকি হতভম্ব! নবনীর মুখে কোন কথা সরছে না। মুখে কথা সরবে না মানে, আলবাত সরবে। নবনীকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। সে এমন চুপ করে থাকার মেয়ে নয়! খানিকবাদে ক্রুদ্ধ সিংহীর মতো তেড়ে এলো নবনী। গাঁক গাঁক স্বরে চেঁচালো, বলো, কে দিয়েছে এই গোলাপ? কোন্ রমণীর আঁচলের তলায় বেড়ে উঠেছে তোমার অবৈধ প্রেম! বলো, জবাব দাও! সহসা মনে হলো এক্ষুনি ঝড় আসবে, ভেঙে পড়বে আকাশ! নবনীর এমন রণরঙ্গিনী রূপ আগে কখনও দেখিনি! এবার সত্যি আমার বিমূঢ় হবার পালা। এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আমি মহামতি চার্লি চ্যাপলিনের মূকাভিনয়ের মাঝে শেল্টার খুঁজলাম। তাও শেষ রক্ষা হবে কি! মনে হল গোলাপেও বিষ আছে। নতুন করে জানলাম, আমার বউ নবনী কেবল মুখরা নয়, ভয়ঙ্কর বটে! রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জানুয়ারি ২০১৯/তারা