শিল্প ও সাহিত্য

শুধু মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা কাম্য নয়

বাংলাদেশে গ্রন্থপ্রকাশনা অনেক বছর থেকেই মেলাকেন্দ্রিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই বছরের অন্য সময় কোনো বই প্রকাশ করে না। শীতঘুমে কাটিয়ে দেয়। বইমেলাকে সামনে রেখে জেগে ওঠে। বিশ থেকে চল্লিশটা পাণ্ডুলিপির বোঝা মাথায় করে হাঁসফাঁস করতে থাকে। উন্নত প্রযুক্তির কারণে বইয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য নজর কাড়ে বটে কিন্তু পাতা ওল্টালে প্রচণ্ড হতাশ হতে হয়। পৃষ্ঠাসজ্জা থেকে প্রুফরিডিং সর্বত্রই তাড়াহুড়োর ছাপ লক্ষ্য করা যায়; যাকে পেশাদারিত্বের অভাব বলেই মনে হয়। এদেশে কোনো প্রকাশনা সংস্থারই এডিটরস প্যানেল নেই। প্রুফরিডারদের অবস্থাও খুব শোচনীয়। শুদ্ধ বানানও ভুল করে রাখার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত এরা প্রতিনিয়ত স্থাপন করে চলেছে। এ বিষয়ে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর নয়। বই প্রকাশনা কোনো মৌসুমী ব্যাপার নয়, তা আমাদের প্রকাশকরা ভালোই বোঝেন বলে আমার ধারণা। তাই জিজ্ঞাসা করলে তারা জোরের সাথেই সাফাই গান যে, তারা সারাবছরই বই প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। বই প্রকাশের জন্য তারা সেই ফেব্রুয়ারির মেলার জন্যই অপেক্ষা করেন। কারণ তখন বই ছেপে বের করার সাথে সাথেই লগ্নিকৃত অর্থ উঠে আসার জোর সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু একসাথে প্রচুর বই ছাপতে গিয়ে তারা কোনো বইয়ের প্রতিই সুবিচার করতে পারেন না। যথেষ্ট সময় নিয়ে প্রকাশ না করার জন্য প্রচুর ভুলভ্রান্তি থেকে যায় যা পরবর্তী সময়ে লেখকের স্থায়ী মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি গ্রন্থ একজন লেখকের কাছে সন্তানের মতো। মা যেমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে বড় করে তোলেন, লেখকও গ্রন্থের ধারণাটিকে মস্তিষ্কে ধারণ করেন। একটু একটু করে তা পরিণত হয়ে ওঠে এবং সুষ্ঠু পরিচর্যার মাধ্যমে একসময় ভূমিষ্ঠ হয়। কিন্তু জন্মপরবর্তী পরিচর্যা অর্থাৎ লেখনী পরবর্তী কাজগুলোতে যত্নের ঘাটতি থাকলে তা লেখক-পাঠক উভয়ের জন্যই বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি আমার একটি ইংরেজি গ্রন্থ ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হলো। বাংলা ভাষায় লিখিত নিজের ১১টি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ River Madhumati and The Broken Fiddle শিরোনামে ইংল্যান্ডের প্রকাশনা সংস্থা Spiderwize প্রকাশ করেছে। নিজের করা অনুবাদের কাজটি প্রকাশ করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম যে পেশাগততা প্রকৃতপক্ষে দায়িত্বশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা ও নান্দনিকতার অপূর্ব এক সংমিশ্রণ যা তাদের কাজের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিফলিত। আমাদের এখানে অর্থ দিলেই যেমন অলেখকদের বইও সহজে ছাপা হয়ে যায়, ওখানে অর্থ দিলেও প্রকৃত লেখকদের গ্রন্থও সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন না মেনে প্রকাশিত হয় না। বিখ্যাত লেখকদের ক্ষেত্রেও তারা একই নীতি অনুসরণ করেন। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের লোগো বিক্রি করে না। প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থারই একটি এডিটরস প্যানেল আছে। জমাকৃত গ্রন্থটি প্রথমে সম্পাদকদের টেবিলে যায়। তারা গ্রন্থটি পড়ে ছাপা যাবে কি যাবে না, সে বিষয়ে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সুনির্দিষ্ট মতামত রাখেন এবং কত ঘণ্টার সম্পাদনা প্রয়োজন তা উল্লেখ করেন। লেখক রাজি হলে কমপক্ষে ১২ সপ্তাহের মধ্যে গ্রন্থটি ছাপার একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে কাজ শুরু করেন। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রথম সংশোধিত কপি লেখকের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। সংশোধনের প্রস্তাবনাসমূহের যেগুলোর সাথে লেখক একমত সেগুলো সংশোধন করে এবং যেগুলোর সাথে একমত নন সেগুলো অবিকল রেখে দ্বিতীয় সংশোধিত কপি পাঠানো হয়। সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা বা ঐতিহ্যের কারণে যদি কোনো শব্দ বা বাক্যের মর্মার্থ বুঝতে তারা সক্ষম না হন তাহলে মার্জিনে তাদের উপলব্ধি লিখে দেন। কোনো বাক্য অস্পষ্ট মনে হলে লেখককেই দ্বিতীয়বার লিখতে অনুরোধ করেন। লেখক পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে আবার ফেরত পাঠান। এরই মধ্যে বইয়ের প্রচ্ছদের কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। এরপর প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসজ্জাসহ গ্রন্থটির তৃতীয় ও শেষ সংশোধিত কপি লেখক বরাবর পাঠানো হয়। প্রচ্ছদ থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে গ্রন্থটি পাঠ করার বিনীত অনুরোধ থাকে। এরপর আর কোনো ভুল সংশোধনের সুযোগ নেই জানিয়ে একটি সংশোধনী পৃষ্ঠা পাঠানো হয়। সেখানে পৃষ্ঠা নম্বর, পঙ্‌ক্তি নম্বর উল্লেখ করে ভুল শব্দ ও সংশোধিত শব্দটি কী হবে তা উল্লেখ করতে হয়। এই কাজটি শেষ করে পাঠানোর পরই বইটি ছাপাখানায় যায়। এত শ্রম থাকে বলেই একটা বই নির্ভুল হতে পারে।

এই পেশাগত আচরণ কি এখানে অসম্ভব? আমাদের প্রকাশকরা সারাবছর বই প্রকাশের ব্যবস্থাটা চালু করতে পারলে এবং একটি বইয়ের পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারলে তা সুন্দর ও নির্ভুল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনার ভাবনাটি সবসময় মাথায় ঘুরপাক খেলে তা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না। যেহেতু প্রকাশনা একটি ব্যবসা এবং প্রকাশকরা অর্থ লগ্নি করেন লাভসহ তা ফিরে আসবে সেই যৌক্তিক প্রত্যাশায়। কিন্তু এতদিনেও তারা দেশব্যাপী ভালো একটি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন নি। ছোট্ট দেশটিতে মেলায় প্রকাশিত বই বিভাগীয় শহরগুলোতেও সহজলভ্য নয়। যতদূর জানি, প্রকাশকদের গিল্ড আছে, তারা ঘটা করে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা বানান, দলবাজি করেন। কিন্তু নিজেদের বিপণন ব্যবস্থাকে জোরদার করেন না। অনেকে দেশব্যাপী বিপণনের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের দিকে চেয়ে থাকেন, তারা ভালো বই কিনছে না বলে দোষারোপ করতে থাকেন, আর তা মিথ্যা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে নানারকম অনিয়ম ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। একদিকে সেগুলো দূর করার চেষ্টা নিতে হবে, পাশাপাশি তাদের ওপর থেকে নির্ভরতাও কমাতে হবে। প্রান্তের মানুষেরা বই কেনেন না বা পড়েন না তা নয়। কিন্তু তাদের হাতে সহজে বই পৌঁছায় না। পশ্চিম বাংলায় আমরা সারাবছর বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে বইমেলা হতে দেখি। সেখানে বই বিক্রি হয়, আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, আর তা থেকে ভালো বই নিয়ে পাঠকদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমাদের প্রকাশকদের গিল্ড সে ধরনের উদ্যোগ নেন না।

প্রান্তে বৃহৎ একটি পাঠক সমাজ রয়েছে। প্রকাশকরা বোধহয় সে ব্যাপারে খুব মনোযোগী নন। মেলায় ২০-৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হওয়াটা বৃহৎ পাঠকশ্রেণি গড়ে ওঠার একমাত্র সূচক হতে পারে না। শুধু ভালো বই প্রকাশ করলেই প্রকাশকদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বইয়ের পাঠক ছড়িয়ে রয়েছে দেশব্যাপী। তাদের হাতে সহজে বই পৌঁছে দেওয়াটাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর তার জন্য চাই সংগঠিত বিপণন ব্যবস্থা। এতে তাদেরই লাভ বেশি। লগ্নিকৃত অর্থ ফিরে আসবে সহজে এবং আর্থিক অনিশ্চয়তাও কেটে যাবে। আর লেখকদের সম্মানী না দেওয়ার অভিযোগ থেকেও তারা মুক্ত হতে পারবেন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য অলেখক ও মৌসুমী লেখকদের বিনিয়োগের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। প্রয়োজন শুধু কার্যকরী উদ্যোগ। আমরা সেই অপেক্ষায় রইলাম।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা