শিল্প ও সাহিত্য

বৈশাখের পদাবলি

 

ছোট ছোট বিনয়ী বৃক্ষ দিনের বেলায় ঝক্‌ঝকে নতুন পাতা অঙ্গে জড়িয়ে        বেশ সাজুগুজু ক’রে               ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একা আমাকে পেয়ে        চোখ মারবে না তো আবার! মলের দু’পাশের গাছগুলো        বয়সের ভার নিয়েও নতুন পাতার জেল্লা ছড়াচ্ছে        সলজ্জ ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বললাম, ‘শুভ নববর্ষ’।        ‘ঢং,        তোমার দেশে কাঁচা চুলের              ছেলেমেয়েরা নেই নাকি?’ শেষমেশ বুড়ি বৃক্ষেরও ধমক খেতে হলো আসাদ! নিষেধকণ্টক ঠুকে ঢেকে দিলে আমার আকাশ উন্মুখ জানালা চাই। আলোমুখ। ফেলবো না শ্বাস! ইচ্ছের কপাট বোজা। কড়া হাতে তুলে দিলে খিল চৈত্রময়তায়- দগ্ধতায়- বাঁচা মুশকিল। তোমার চোখের থেকে ঝরে যদি দিগন্তের হাসি কেউ তো বলতেই পারে ‘হে নির্জন, আজও ভালোবাসি’ ভাটিপোড়া ঝামাগন্ধ... তাও থাকে রূঢ় রৌদ্রে মিশে চেয়েছি জলের ধারা। উঁকিবৃষ্টি মেঘের কার্নিশে। যে ভোলার ভুলে যায়- খেরোখাতা- কেউ মনে রাখে ও হে মুক্ত, ও হে পূর্ণ, দেখা হবে নতুন বোশেখে। যখন কুমার নদের পারে দাঁড়িয়ে একটি নিমসবুজ কলাগাছের পাতা বিছিয়ে নিয়ে লিখছিÑ ‘এইখানে তুমি এসেছিলে...’ একটি নকশাকাটা গামছার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তোমার মুখ তুমি নদের জলে ভাসছ তোমার সাঁতারের কলায় কতশত নকশিকাঁথার ফোঁড়ন প্রসিদ্ধ হয় আমি তোমাকে পাগলের মতো ডাকছি, আর তুমি কালিবাউশের আল্পনা-আঁকা মাটির কলসিতে ভার তুলে দিয়ে ঝাঁ-দুরন্ত গতিতে ছুটছ- যেন স্রোতের অধিক ছলাচ্ছল- ধানগাছের চিবুকধোয়া জলে তোমার হাত-পায়ের উল্লম্ফ ক্রীড়ায় উঠে আসছে বাঁশের কুলা, নাগরদোলা... তোমার উচ্ছ্বাসের পিপায় জল সরে গিয়ে ভেসে উঠছে আড়বাঁশির টান মেলা থেকে কেনা বেতের সাজি, তালের পাখা, গজা-বাতাসার ঘ্রাণ- আমি তোমাকে উন্মাদের মতো খুঁজছি, আর তুমি অচিন সমুদ্রে মিলাবার আগেই- একদা দাপুটে নদের শুকিয়ে-যাওয়া চরায় অর্ধমৃতা এক; প্রাণান্ত বাঁচার নিমিত্তে নিঃসঙ্গ বাতাসে লিখছ হাহাকারের নেশা আমি তোমাকে বাঁচাবার আশায় উৎকণ্ঠিত মাছেদের কাছে সবিনয় নিবেদন করি- যেভাবে মাছেরাই তাদের অস্তিত্ব বাঁচাতে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে দুই পারের বিপুল জনপদে- এইখানে তুমি এসেছিলে...   দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে অঙ্গীকারে অহঙ্কারে অজানা পথের ধুলোবালি মেখে অনেক শতাব্দীজুড়ে রয়ে গেছে অব্যক্ত মনের কথা- কথারা উৎসব হয়ে যায়! তখন অশনি সংকেতের দেশে হঠাৎ করে একদিন ভুভুজেলা বেজে ওঠে! সোহরাওয়ার্দী, চারুকলা প্রেম অপ্রেমে মিশে যায় ছলাকলা- পাঞ্জাবি ফতুয়া শার্টে! মানুষ ভজে মানুষ হয়ে ওঠে রমনার বটমূল- মঙ্গল শোভাযাত্রা, চুলের খোপায় বকুল! শিমুল পলাশের দেশে কেউ কেউ বিপথে গেছে শাড়ির আঁচলে কামনা খুঁজে! পান্তা-ইলিশ মায়ের বুকে মাথা রাখা বালিশ- হাওয়ায় উড়ে শাড়ির আঁচল। জন্মভিটার গাছে গাছে কঁচি আম ঝুলে আছে- বাবার সঙ্গে ভোরবেলায় মশা-মাছি রোগ-ব্যাধি দৌড়ানোর খুলে দেওয়া খাম শেষে এলে তুমি বৈশাখ! মাঠের বুকে গন্ধ বিলিয়ে ধান, কৃষকের মুখে সবুজ আঙিনা ভরে নেয় প্রাণ। তুমি এলে কিনে দেবো নকশিকাঁথা, শাঁখা পিতলের গহনা মাটির পুতুল কানের দুল, তাল পাতার পাখা- কিনে দেবো রেশমি চুড়ি, বেলোয়ারি, জয়পুরি, এনে দেবো বাঙালিয়ানা, বাসন্তী রঙের শাড়ি, কোকিলের কুহুতান- আরো এনে দেবো আউল-বাউল-মাটি-কামার-কুমারের চুল! হঠাৎ মায়ের বুক থেকে বেজে ওঠা সুরহীন গানের সুর। দুয়ার খুলে অগ্নিস্নানে ঝরিয়ে নিয়ে অজস্র দুঃখ শোক নতুনকে করি আহ্বান- আকাশে বাতাসে পাতালে মেখে আগুন ফুটে ফুটে ঝরে যাক সব অশুভ গান! মানবের পূণ্যস্নানে যদি আবার মানব হতে পারি তোমাকে প্রণতি জানাবো বৈশাখ- আমার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে, চারিদিকে আগুনে রাখা হাত নিঃসঙ্গ নিবাস, শহর, গ্রামে কিংবা বিলাতে আমাদের শ্রুতি নিয়ে কেঁপে ওঠে বৈশাখ- হালখাতা-আকবর জীর্ণ পাতা থেকে ঝরে যাওয়া নাম- বুকের ভিতর ভিজে গেছে লালরঙে মাটি, তবুও দেখি পৃথিবীতে কালো হাওয়ার উত্থান।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৯/তারা