শিল্প ও সাহিত্য

গল্প থেকে ছবি মানেই কি চাটুবৃত্তি?

বাংলা ছোটগল্প থেকে এত এত চলচ্চিত্র, পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্মিত হয়েছে যে, সেটির তালিকা করতে গেলে আরব্য রজনীও ফুরিয়ে যেতে পারে। এর কারণ সূচনা পর্ব থেকেই, মানে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র সাহিত্যের হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। প্রথমদিকে এই পথচলায় পুরাণের প্রভাব থাকলেও, তাতে ধীরে ধীরে নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতার প্রভাব বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে দিনলিপি, এমনকি প্রবন্ধের বই থেকেও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। কখনো সেসব কাজ সফল হয়েছে, কখনো বা বিফল। তবে তাতে সাহিত্য থেকে দু’হাত ভরে গ্রহণ করা থামিয়ে দেয়নি চলচ্চিত্র।

ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৯৬ সালে প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয়। এরপর নানা ধরনের চলমান ছবি বানানো হয়েছে, প্রদর্শিত হয়েছে। কাহিনিচিত্রের চল শুরু হয় বিংশ শতকের প্রথমভাগ থেকেই। চলচ্চিত্র আবিষ্কারের সাত বছরের মাথায়, ১৯০৩ সালে হীরালাল সেন তৈরি করেন ‘আলিবাবা’, ১৯১৩ ও ১৯১৭ সালে দুইবার নির্মিত হয় দাদা ভাই ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ১৯১৯ সালে জ্যোতিষ ব্যানার্জী বানান ‘বিল্বমঙ্গল’, ১৯২৩ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায়, রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয় ‘মানভঞ্জন’, এভাবেই শুরু, তারপর আর থেমে নেই কাহিনিচিত্র। বলা বাহুল্য হবে না, ‘মানভঞ্জন’ ছবিটির মাধ্যমেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্প চলচ্চিত্ররূপ পেতে শুরু করে। এরপর একে একে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘অতিথি’, ‘মণিহারা’, ‘নষ্টনীড়’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘দালিয়া’, ‘জীবন ও মৃত’, ‘বিচারক’, ‘নিশীথে’ ইত্যাদি ছোটগল্প নিয়ে ছবি বানিয়েছেন খ্যাতিমান পরিচালকরা।

শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, পরিচালকরা আকৃষ্ট হয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সাহিত্যকর্মের প্রতিও। চলচ্চিত্রের এমন ঋণ বা ভিন্নচিন্তায় এমন নির্ভরশীলতা অনেকেই পছন্দ করতেন না। যেমন পছন্দ করেননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯২৯ সালে মুরারি ভাদুড়িকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘ছায়াচিত্র এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেচে- কারণ কোনো রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারে নি।’ এখন এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করা যে কঠিন সেটাও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, তাই ঠিকঠিক ধরতে পেরেছিলেন যে সৃষ্টিশীল মানুষের মাথার উপর যদি পয়সাকড়ির চাপ থাকে তাহলে মৌলিক গল্প তৈরি করা একটু কঠিনই বৈকি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: ‘(দাসত্ব থেকে উদ্ধার) করা কঠিন, কারণ কাব্যে বা চিত্রে বা সঙ্গীতে উপকরণ দুর্ম্মূল্য নয়। ছায়াচিত্রের আয়োজন আর্থিক মূলধনের অপেক্ষা রাখে, শুধু সৃষ্টিশক্তির নয়।’

সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণকে ‘চাটুবৃত্তি’ বা ‘দাসত্ব’ শব্দগুলো দিয়ে দেগে দেয়া আসলে আপত্তিকর। যদিও এটা পরিষ্কার যে রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্রের শক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এবং স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রকে ভাবতে পেরেছিলেন, তারপরও বলতে হয়, চলচ্চিত্রকে রবীন্দ্রনাথ, অসম্ভব বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও, পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। এর কারণ তিনি মনে করেছিলেন, সাহিত্যমুখী হয়ে থাকাই বুঝি চলচ্চিত্রের বন্দিদশা বা চাটুকারিতা। আর এ থেকে মুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন আর্থিক মূলধনকে। প্রকৃত পক্ষে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রও ‘চলচ্চিত্র’ হয়ে উঠতে পারে নির্মাতার প্রতিভার কারণে। কাজেই চলচ্চিত্র যদি সাহিত্যের ‘চাটুবৃত্তি’ করেও থাকে, তাহলে সেটি সত্যজিৎ রায়ের মতে, নতুন মাধ্যমটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার কারণে।

রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিন্তু সাহিত্যকর্ম অর্থাৎ নিজের লেখা নাটক থেকে ১৯৩২ সালে ‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই ছবিতে ক্যামেরার কাজ দেখলেই তাঁর চলচ্চিত্রজ্ঞান ধরা পড়ে। প্রশ্ন হলো এই ছবিটি যে খারাপ হয়েছে, সেটা কোন কারণে- আর্থিক মূলধনের কারণে, না মাধ্যমটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার কারণে?

এডুইন এস পোর্টার, জর্জ মেলিয়ে, ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ, চার্লি চ্যাপলিন, আর্নেস্ট লুবিটশ, বাস্টার কিটন, সের্গেই আইজেনস্টাইন, কার্ল থিওডর ড্রেইয়ার, আলেকজান্দার দভজেঙ্কো, জিগা ভের্তভ প্রমুখেরা ত্রিশের দশকের আগেই ছবি বানিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন পৃথিবীতে। মানে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘নটীর পূজা’ বানাচ্ছেন, এর আগে চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় বহু মহারথী এসে গেছেন এবং তাঁদের স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। তাঁদের কাজ দেখা তখনকার যুগে অতটা সহজ ছিল না, চলচ্চিত্র তৈরি করাও ছিল যথেষ্ট শ্রমসাধ্য কাজ, এখনকার তুলনায়। তারপরও রবীন্দ্রনাথ যা বানিয়েছেন, তার পেছনের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। যাক আর রবীন্দ্রনিন্দা করব না। তিনি মহান সাহিত্যিক, এ ব্যাপারে কোনো তর্ক নেই। তবে সাহিত্য থেকে রসদ নেয়া মানেই যে চলচ্চিত্রের ‘চাটুবৃত্তি’ বা ‘দাসত্ব’ করা নয়, সেটার বড় প্রমাণ আসলে সত্যজিৎ রায়। তিনি রবীন্দ্রনাথসহ অন্য লেখকদের মোট পনেরোটি ছোটগল্পকে রুপালি পর্দায় অনুবাদ করেছেন, বিনির্মাণ করেছেন। তাছাড়া তাঁর ত্রিশটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে তেইশটি ছবিই সাহিত্য নির্ভর। সত্যজিৎ আদতে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতে জানতেন। ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) বানানোর সময় আর্থিক মূলধনে টান থাকলেও, ছবিটি কাল জয় করেছে। এতেই প্রমাণ হয় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক নয়।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প বিচিত্র রঙ ও গন্ধে সজ্জিত এক বৃক্ষ। তো সেখান থেকে ফুল-ফল আহরণের লোভ চলচ্চিত্রকারের হবে না তা কি করে হয়? তাই তো যুগে যুগে ছোটগল্প থেকে হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খেয়েছেন নির্মাতারা। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ থেকে শুরু করে হাল আমলের চলচ্চিত্র পরিচালকেরাও দুই হাত প্রসারিত করে নিচ্ছেন সাহিত্য থেকে। তাছাড়া চলচ্চিত্র এমন এক মাধ্যম- সে নেয়নি কোন মাধ্যম থেকে- সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। নবীনতম শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র গ্রহণ করেছে সাহিত্য থেকে, নাটক, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও স্থিরচিত্র থেকে। তাই বলে এটা বলা যাবে না, চলচ্চিত্র এসব শিল্পের দাস বা চাটুকার।

বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবু ইসহাক, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন, আমজাদ হোসেন, শাহাদুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখের গল্প ও উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে। রাজন তরফদার, সুভাষ দত্ত, আব্দুল্লাহ আল মামুন, চাষী নজরুল ইসলাম, মসিহউদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, সিবি জামান, আলমগীর কুমকুম, কাজী হায়াৎ, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, আকরাম খান প্রমুখ ছোটগল্প ও উপন্যাস থেকে ছবি বানিয়েছেন এদেশে।

বাংলাদেশে ছোটগল্প থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্যে কাহিনিচিত্র তৈরির উদাহরণ থাকলেও, ছোটগল্প থেকে অ্যানথোলজি ফিল্ম বা চলচ্চিত্র সংকলন বানানোর রীতি চোখে পড়ে না। এমন নিরীক্ষা বাংলাদেশে হতে পারে। একই বিষয়ের উপর তিনটি ছোটগল্প বাছাই করে, তিনজন নির্মাতা একটি ছবি বানালেন। বাইরের দেশে এধরনের অ্যানথোলজি ফিল্ম অনেক হচ্ছে ইদানিং। যেমন ফ্রান্সে আঠারোটি গল্প নিয়ে ‘প্যারিস আই লাভ ইউ’ (২০০৬) ছবিটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বর্ণময় প্যারিসই ছিল সেই ছবির প্রধান বিষয়। তিনটি গল্প নিয়ে সডারবার্গ, ওঙ্কারওয়াই ও আন্তোনিওনি তৈরি করেছিলেন অ্যান্থোলজি ফিল্ম ‘ইরোস’ (২০০৪)। এসব ছবিতে পরিচালকেরাই গল্প লিখেছেন ছবির জন্য। বলা যায়, সাহিত্যের ‘চাটুবৃত্তি’ তাঁরা করেননি। কিন্তু তাঁদের লেখা গল্প কি সাহিত্যের অংশ নয়? এটা ঠিক গল্পগুলো স্বতন্ত্রভাবে পড়ার জন্য লেখা হয়নি। তাতে কি? কাহিনিচিত্রের গল্প যদি আলাদা করে গল্প হিসেবে লেখা হয়, তাহলে কি সেটি গল্প হয়ে উঠবে না? গল্প থেকে যদি চলচ্চিত্র হতে পারে, চলচ্চিত্র থেকে গল্পও হতে পারে। আজকাল হচ্ছেও। বহু গ্রাফিক্যাল নভেল বাজারে বেরুচ্ছে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য থেকে। ননফিকশন বই থেকেও যেমন ছবি হচ্ছে, আবার প্রামাণ্যচিত্র থেকেও ননফিকশন বই বেরুচ্ছে। যেমন উডি অ্যালেন নির্মাণ করেছিলেন ‘এভরিথিং ইউ অলওয়েজ ওয়ান্টেড টু নো অ্যাবাউট সেক্স’ (১৯৭২), ৮৮ মিনিটের এই ছবিটি ডক্টর ডেভিড রুবেনের লেখা একই নামের একটি ননফিকশন বই থেকে বানানো। আবার জন বার্জারের ‘ওয়েজ অব সিয়িং’ (১৯৭২) প্রামাণ্যচিত্রটি পরে বই আকারে বেরিয়েছে। কাজেই গল্প, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র এদের সম্পর্ক এখন একমুখী নয়, একে অপরের কাছ থেকে নিয়ে সমৃদ্ধ। কে যে কার ‘চাটুবৃত্তি’ করছে এখন!

সাহিত্য বা ছোটগল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো, সাহিত্যকর্ম থেকে একজন নির্মাতার গ্রহণের পরিমাণ। একজন পরিচালক গল্পের পুরোটাই নিতে পারেন ছবিতে, এক্ষেত্রে লেখকের গল্পের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত থাকবেন পরিচালক। অর্থাৎ তাঁরা গল্পকে অবিকৃত রেখে চলচ্চিত্রে রূপদান করেন। জার্মান চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক সিগফ্রিড ক্রাকোয়ার এটাকে বলেন, সিনেম্যাটিক অ্যাডাপটেশন। আর আরেক দল হলেন অবিশ্বস্ত পরিচালক। তাঁরা ইচ্ছেমতো কাটছাট করে গল্পটি পুনঃনির্মাণ করেন এবং নিজেদের মতো করে চলচ্চিত্র বানান। গল্প থেকে কঙ্কালটি হয় তো ধার করেন, বাকিটুকুর মধ্যে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে দেন। এই ধরনের কাজকে ক্রাকোয়ার বলেন, আনসিনেম্যাটিক অ্যাডাপটেশন।

এখন অ্যাডাপটেশন বা গ্রহণ যেভাবেই হোক, গল্প হুবহু এক রেখে অথবা গল্প পরিবর্তন করে, চলচ্চিত্র বানানোর পর যদি সেটি দর্শকের মন ছুঁয়ে যেতে পারে এবং ছবিটি যদি গল্পকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলেই একটি ছবি কাল অতিক্রম করে। এমন অনেক মাঝারি মানের গল্প দেখা যাবে, যা ভালো পরিচালকের হাতে পড়ে নাম করেছে। আবার উল্টো চিত্রও আছে। আমি নাম-তারিখের তালিকা দিয়ে লেখাকে স্থূল করে তুলতে চাই না। সেটা যারা ক্যাটালগ করেন, তারা করবেন। আমি এখানে বলতে চেয়েছি, স্বতন্ত্রভাবে লিখিত গল্প থেকে ছবি করা মানেই তার চাটুবৃত্তি বা দাসত্ব করা নয়। নয় তো চলচ্চিত্রের সূচনাপর্ব থেকে আজ অবধি এত এত পরিচালক সাহিত্যের উপর নির্ভর করতেন না।

এখানে দক্ষতার বিষয় রয়েছে। যারা বিখ্যাত গল্প লেখক, তাঁরা গল্প বলায় পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। যিনি বড় মাপের চলচ্চিত্র লেখক, তিনি দৃশ্যের ভেতর দিয়ে গল্প বলায় ওস্তাদ। ব্যাপারটা এমন নয়, চলচ্চিত্রের ওস্তাদ মাত্রই গল্প লেখায় তিনি সমান দক্ষতা অর্জন করবেন। কাজেই তিনি গল্প লেখকের দ্বারস্থ হতেই পারেন। সেটা হচ্ছেনও। যে যেটাতে পারদর্শী, তিনি সেটাই করবেন। তাছাড়া যে কোনো কাহিনিচিত্র তৈরি করতে গেলে গল্পের প্রয়োজন হবেই। সে গল্প আগে থেকেই লিখিত থাকতে পারে, অথবা পরিচালক নতুন গল্প ভেবে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারেন। পার্থক্য হলো একটি গল্প যেভাবে পাঠক পড়ে যেতে পারেন, গল্প থেকে চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা চিত্রনাট্য সেভাবে পাঠ করা যায় না। এর কারণ দুটি দুই মাধ্যম। একটি ছাপা হয়, অন্যটি দেখানো ও শোনানো হয়। গল্প সৃষ্টিতে একজনই যথেষ্ট। গল্পের চলচ্চিত্রায়নে লাগে সৈন্যসামন্ত এবং অবধারিতভাবেই বিনিয়োগ। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন, দ্বিতীয়টিতে শুধু সৃজনশক্তি থাকলেই চলে না, আর্থিক মূলধনও লাগে। অর্থাৎ শুধু পরিচালক থাকলেই চলে না, প্রযোজকও প্রয়োজন।

অতএব চলচ্চিত্র কোনো একক মানুষের সৃষ্টি নয়, যদিও বলা হয় এটি পরিচালকের মাধ্যম, তারপরও একা পরিচালক চাইলেই একটি ছবি তৈরি করে ফেলতে পারেন না। তার যদি আর্থিক মূলধন না থাকে, তাহলে প্রথমত তার দরকার হয় একজন বিনিয়োগকারীর। এরপর তার প্রয়োজন হয় প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, অভিনয়শিল্পী, আলো ও শব্দের জন্য কলাকুশলী, সংগীত পরিচালক, সম্পাদকসহ নানা জনের। চলচ্চিত্র একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। ধারণাগত দিক থেকে চলচ্চিত্র যেমন শিল্পের অন্যান্য শাখা থেকে নেয়, তেমনি কাঠামো নির্মাণেও সে একাধিক মানুষের উপর নির্ভরশীল। এই শিল্পের ধরনটাই এমন। সে অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে নিজে একটি ভিন্ন কিছু হয়ে ওঠে। শিল্পমাধ্যমটির বৈশিষ্ট্যকে ধরতে পারলে এর সম্পর্কে আসলে ‘চাটুবৃত্তি’ বা ‘দাসত্ব’ এসব শব্দ ব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকে না।

 

সহায় ১.বিজিত ঘোষ (সম্পাদিত), ২০১৬, সিনেমা গল্প গল্পের সিনেমা, কলকাতা: পুনশ্চ ২.আহমেদ আমিনুল ইসলাম, ২০০৮, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: আর্থসামাজিক পটভূমি (১৯৭০-১৯৮০ দশক), ঢাকা: বাংলা একাডেমি ৩. সোমেশ্বর ভৌমিক, ২০১১, রূপের কল্পনির্ঝর: সিনেমা আধুনিকতা রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স ৪.এম. আসাদউদ্দিস ও অনুরাধা ঘোষ, ২০১২, ফিল্মিং ফিকশন: সাম রিফ্লেকশনস অ্যান্ড আ ব্রিফ হিস্টোরি, এম. আসাদউদ্দিস ও অনুরাধা ঘোষ সম্পাদিত ‘ফিল্মিং ফিকশন: ট্যাগোর, প্রেমচাঁদ ও রায়’, নয়াদিলি: অক্সফোর্ড ৫.বিধান রিবেরু, ২০১৯, চলচ্চিত্র বোধিনী, ঢাকা: কথা প্রকাশ

 

ঢাকা/তারা