শিল্প ও সাহিত্য

বাপুজি’র জন্মদিনে

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্মের দেড়শ বছর পূর্তি দিবস আসন্ন। নিজের হাতে বোনা আটপৌড়ে ধূতি ও চাদর পরিহিত সদা প্রসন্ন মানুষটিকে পরাধীন ভারতে তাঁর অজস্র ভক্ত ও অনুসারী, আবেগমিশ্রিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ‘বাপু’ সম্বোধন করতেন। ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে অপূর্ব প্রাণশক্তিতে ভরা সেই বাপুজির বহু বর্ণময় জীবন ঘাতকের বুলেটে অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অকস্মাৎ তিনি ছবি হয়ে যান। ভারত সরকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জাতির পিতার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। তাঁর ছবি সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অর্থে পরিচালিত পূর্ণ ও আধাস্বায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের দেয়ালে প্রধান কর্মকর্তার মাথার উপর বসানো হয়। ভারতের প্রতি শহর, উপ-শহরে অন্তত একটি সড়কের নাম মহাত্মা গান্ধীর নামে রাখা হয়। পরিতাপের বিষয়, বর্তমান প্রজন্মসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ সড়কগুলো চেনেন কিন্তু যাঁর নামে সড়ক তাঁকে চেনেন না।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির এক মেধাবী ছাত্রীর কাছে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে বিবাদী বাগ বলতে কী বোঝায় জানতে চেয়েছিলাম। ছাত্রী বললেন, এখানে বোধ করি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছিল। কষ্ট পেলাম, অবাক হলাম! এঁরা স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বিনয়, বাদল, দীনেশের নাম শোনেনি! প্রায় প্রতি শহরে গান্ধীসহ অন্যান্য মনীষীদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। যদিও সেই মূর্তি সারাবছর ধূলি ও পক্ষীবিষ্ঠা পরিকীর্ণ হয়ে কদাকার রূপ ধারণ করে থাকে। রাজ্যের বিধানসভা ও কেন্দ্রের রাজ্যসভা ও লোকসভায়ও তাঁর ছবি ও ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় তাঁর ছবি স্থান পেয়েছে। ভারত তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন পালন করে আসছে। তাঁর সমাধি বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী বা আমলাদের পরিদর্শনস্থলে পর্যবসিত হয়েছে। তাঁরা ভারতে এসে প্রথমে তাঁর সমাধিতে ফুলের মালা বা পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্মান জানানোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েক দেশে তাঁর ভাস্কর্য মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে।

তিনি অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের অনন্য রূপকার। মুখ্যত তাঁর এই ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে তাঁকে মহিমময় ও স্বতন্ত্র মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। জাতিসংঘ তাঁর জন্মদিন ২ অক্টোবর বিশ্ব অহিংস দিবস হিসাবে পালন করে। মার্টিন লুথার কিং, নেলসন মেন্ডেলাসহ অন্যান্য বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব তাঁর অহিংস আন্দোলনের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। তাঁরা এর সুফলও পেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে ভারতে ও বিশ্বে তাঁর অহিংসার বাণী প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে কি না তা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নূতন প্রজন্মের মননে তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তিও মলীন করার চেষ্টা হচ্ছে কি না সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

 

জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে মতের মিল-অমিল দুই-ই ছিল  

ভারতবর্ষের পোরবন্দরে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর বাপুজির জন্ম। ভারতবর্ষের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী প্রাক্তন পোরবন্দর বর্তমানের গুজরাট। পিতা করমচাঁদ গান্ধী পোরবন্দরের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি রাজকোটের দেওয়ান হয়েছিলেন। মা পুতলিবা করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী। প্রথম দুই স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে মারা যান। তাঁরা বৈষ্ণব ছিলেন। জৈন ধর্মও তাঁদের প্রভাবিত করেছিল। দুই ধর্মেরই মূল বাণী জীবে অহিংসা, শাক-সবজি আহার, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস যাপন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ইত্যাদি। মা এই সকল ধর্মীয় ও সামাজিক আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন। ছেলে মোহনদাসও মার দ্বারা প্রভাবিত হন। মোহনদাস পোরবন্দর ও রাজকোটের স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি ছোটবেলায় খুব লাজুক ছিলেন। ছাত্র হিসাবেও মাঝারিমানের ছিলেন। স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে তিনি সোমলদাস কলেজ থেকে কোনোরকমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর ইচ্ছা ছিল চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করা। কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় অনুশাসনে শব ব্যবচ্ছেদ সমর্থনযোগ্য নয় বলে তিনি অগত্যা ব্যারিস্টারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যারিস্টার হলে তিনি রাজকার্যে নিযুক্তি পেতে পারেন। সেই সময়ের সামাজিক রীতি অনুসারে ১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মোহনদাস গান্ধীকে বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রী কস্তুরবা মাতাজিকে বিয়ে করতে হয়। দুই সন্তানের জনক মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী ১৮৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ১৮ বছর বয়সে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। তিনি এখানে আইনবিদ্যার সঙ্গে নিষ্ঠা ও শ্রম সহকারে ইংরেজি ও ল্যাটিন শেখায় মনোনিবেশ করেন।

ভারত ছাড়ার আগে মায়ের উপস্থিতিতে জৈন সন্যাসীর সামনে মদ, মাংস ও নারী সংসর্গ এড়িয়ে চলবেন বলে শপথ করেন। তিনি মায়ের আদেশ পালন করেন। তিনি লন্ডনে ‘নিরামিষভোজী সংঘ’-এ যোগ দেন। পরে তিনি সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এই সংঘের অনেকে ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন। দিব্যজ্ঞানের আলোকে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে সোসাইটি গঠিত হয়েছিল। এখানে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম পড়ানো হতো। তাঁরা গান্ধীকে ভগবত গীতা পড়ায় উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি কবি ও সাংবাদিক স্যার এডউইন আর্নল্ড অনূদিত গীতা পড়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি ভগবত গীতাকেই জীবনের ধ্রুবতারা জ্ঞান করতেন। এ ছাড়া তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে বৌদ্ধ, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের দর্শনও আত্মস্থ করেন। দিব্যজ্ঞান সম্পর্কীয় সোসাইটি বা থিওসোফিক্যাল সোসাইটির মধ্যে উল্লেখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সমাজতন্ত্রী, মানবতাবাদী, কবি এডওয়ার্ড কার্পেন্টার, ব্রিটিশ লেখক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক জর্জ বার্নার্ড শ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের বন্ধু ব্রিটিশ লেখিকা, সমাজতন্ত্রী অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ ছিলেন।এঁদের বেশিরভাগই মূলত আদর্শবাদী। তাঁরা সহজ সরল জীবনযাপনের তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন।  কেউ কেউ পুঁজিবাদী ও শিল্পসমাজের সৃষ্ট দুষ্ট প্রভাবের বিরোধী ছিলেন। এই সকল দ্বন্দ্বমূলক দর্শন মোহনদাসের মন ও চরিত্র গঠনে পর্যাপ্ত সহায়ক হয়েছিল।

মোহসদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৯১ সালের জুলাইয়ে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকতেই মায়ের জীবনাবসান ঘটে। ভারতে এসে বুঝতে পারেন- লোভনীয় সরকারি চাকরি লাভের জন্য ব্যারিস্টারি ডিগ্রি পর্যাপ্ত নয়। কারণ, এই ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কোর্টে ওকালতি করবেন স্থির করেন। প্রথম দিনেই বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) আদালতে সওয়াল-জবাবে চরম ব্যর্থ হন। বোম্বাই উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্ট টাইম শিক্ষকতাও করেন। পরে রাজকোট ফিরে মামলার আর্জির মুসাবিদা লিখতে শুরু করেন। তাঁর এই লেখার জন্যও তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তার বিরাগভাজন হন। এই দুঃসময়ে, খুব আকর্ষণীয় না হলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালের আবদুল্লা এন্ড সন্স নামের একটি ইন্ডিয়ান ফার্ম এক বছরের চুক্তিতে তাঁকে নিয়োগের আহ্বান জানায়। তিনি বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৮৯৫ সালে আফ্রিকা পাড়ি দেন।       

 

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে 

দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীর জীবনকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করে। তিনি এখানে লক্ষ করেন যে, শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা ভারতীয় এবং স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। তিনি নিজেও নানাভাবে নিগৃহীত হন। ডারবান কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে মাথার পাগড়ি খোলার আদেশ দেন, তিনি আদেশ অগ্রাহ্য করে আদালত কক্ষ ত্যাগ করেন। প্রিটোরিয়া ভ্রমণে প্রথম শ্রেণির টিকেট থাকা সত্ত্বেও রেলের কর্মকর্তা তাঁকে কালো আদমি বলে তৃতীয় শ্রেণিতে বসে যেতে বাধ্য করেন। স্টেজকোচে ভ্রমণকালে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীকে সিট ছেড়ে না দেয়ায় তাঁকে মারও হজম করতে হয়। তিনি দেখলেন, অনেক হোটেলে ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার নেই। এই সকল ঘটনা তাঁর চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাঁর মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, অত্যাচার প্রতিরোধের মনোভাব জাগ্রত হতে থাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার ছিল না। এই অধিকার আদায়ে বিল উত্থাপনের জন্য তিনি আরো কিছুদিন আফ্রিকায় থেকে যান। তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলেও জনগণ তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। গান্ধী ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘নাটাল ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ভারতীয়দের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন।

গান্ধীর কঠিন সিন্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্য, মনের ঔদার্য, জাগতিক লাভালাভে অনীহা ইত্যাদি দুর্লভ গুণ দক্ষিণ আফ্রিকা থাকতেই লাভ করেছিলেন। এমনিতে শিশুকাল থেকে তিনি ভক্তিমতী মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁর ধর্মীয় ও মানবিক মানস গঠনে পূর্ণতা দান করেছিল। খ্রিস্টান বন্ধুদের ‘বন্ধুসভা’র সদস্যরা তাঁকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি লিও টলস্টয়ের খ্রিস্টানধর্ম বিষয়ক লেখা পড়ে অভিভূত হন। তিনি কোরানের ইংরেজি অনুবাদ পড়েন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও দর্শন নিয়ে চর্চা করেন। তিনি তুলনামূলক ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেন, পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সকল ধর্ম খাঁটি, তবে তাঁর মতে প্রত্যেক ধর্ম অসম্পূর্ণ মনে হওয়ার কারণ, ‘স্বল্পমেধার লোকেরা এইগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।’ জৈন ধর্মাবলম্বী তরুণ মেধাবী পরামর্শদাতা শ্রীমৎ রাজচন্দ্র হিন্দু ধর্মের গভীর অনুভূতি সম্পর্কে তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস রোপণ করেন। ভগবত গীতা বিষয়ে আগে বলেছি। গীতার দুটি শব্দ তাঁর মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এর একটি হলো ‘অপরিগ্রহ’ মানে জাগতিক সুখ-দুঃখ, আরাম-আয়েশ, বিত্ত সম্পদে নির্মোহ হওয়া এবং অপরটি ‘সমভাব’ অর্থাৎ  জয়-পরাজয় এবং সফলতা-ব্যর্থতাকে প্রশান্ত চিত্তে গ্রহণ করা।

 

অপরিগ্রহ এবং সমভাব-  গান্ধীর জীবনের মূলমন্ত্র

এই আদর্শকে তিনি তাঁর পেশার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে সফল হয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালে যে সকল দেওয়ানি মামলা লড়ার জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন, সেই সকল মামলা তিনি আদালতের বাইরে উভয় পক্ষকে বসিয়ে মীমাংসা করে দিতেন। তিনি অর্থের বিনিময়ে তাঁর মক্কেলদের সার্ভিস না দিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। ফলে তাঁর মক্কেলরা তাঁদের জীবনের অন্য সমস্যা বিষয়েও তাঁর পরামর্শ নিতেন। তাঁর সহকর্মীরা প্রতিবাদে জানাতেন যে, মক্কেলরা রোববারেও কেনো বিরক্ত করেন? জবাবে তিনি বলেন,‘ বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবক রোববারেও বিশ্রাম নিতে পারে না।’ গান্ধী সেই সময়ে বছরে ৫০০০ পাউন্ড রোজগার করতেন। কিন্তু তিনি সঞ্চয় করতেন না। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। তরুণ সহকর্মী ও নানা বয়সের রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য তাঁর বাসার দ্বার অবারিত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় মেহনদাস আরো দুটি সন্তানের জনক হন। নিরহঙ্কারী পরিশ্রমী কস্তুরবা সংসার সামলিয়ে হাসিমুখে অসাধারণ ধৈর্য ও সহ্যশক্তির সাহায্যে বাসায় আগত সকলকে সেবাদান করে স্বামীকে সাহায্য করতেন।

গান্ধী ১৯০৪ সালে পুঁজিবাদের সমালোচক জন রাসকিন-এর ‘আন টু দ্য লাস্ট’ পড়ে সহজ-সরল জীবনযাপন, কায়িক শ্রমদান ও আত্মশক্তির উন্নয়নে সচেষ্ট হন। তিনি ডারবানের ফিনিক্সে একটি খামার স্থাপন করেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা খামারে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যে জীবনধারণের প্রয়াস নিয়েছিলেন। এর ছয় বছর পর জোহানেসবার্গে গান্ধীর তত্ত্বাবধানে রাশিয়ার মহান লেখক ও আদর্শবাদী টলস্টয়ের নামে অপর একটি খামার প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধী টলস্টয়ের প্রশংসা করতেন। টলস্টয়ের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। এগুলো পরবর্তী জীবনে তাঁকে ভারতে আশ্রম গড়ে তোলায় প্রেরণা যুগিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীকে কেবল রাজনীতির দীক্ষাই দেয়নি, তাঁকে জনগণকে নেতৃত্বদানে সক্ষম করে তুলেছিল। সলাজ মুখচোরা মানুষ বাগ্মীতে পরিণত হয়েছিলেন। ব্রিটেনের বিশেষ পণ্ডিত গিলবার্ট মারে ১৯১৮ সালে ‘হিবার্ট জার্নালে’ ভবিষ্যদ্বাণী করে গান্ধী সম্পর্কে লিখেন: ‘এই ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গ করায় সাবধান। কারণ লোকটি সকল ইন্দ্রিয় সুখে পরাঙমুখ। বিত্ত সঞ্চয়ে, আরাম-আায়েশ ভোগে, প্রশংসা বা পদোন্নতিতে নিস্পৃহ। তিনি যা সঠিক মনে করেন তা সম্পাদনে স্থির প্রতিজ্ঞ। তিনি বিপজ্জনক ও অস্বস্তিদায়ক শত্রু, কারণ আপনি কিছুটা হলেও তাঁর দৈহিক সেবা পেতে জয়ী হলেও, তাঁর আত্মাকে বিন্দুমাত্রও স্পর্শ করতে পারবেন না।’

১৮৯৭ সালে একদল শ্বেতাঙ্গ তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্ট করে ব্যর্থ হয়। ডারবানের প্রশাসক গান্ধীকে আক্রমণকারীদের নেতার নাম জানাতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ জানাননি। তাঁর মতে, কারো ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য পুরো দলকে শাস্তি দেওয়া তিনি সমর্থন করেন না। ১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল সরকার উপনিবেশের ভারতীয়দের নিবন্ধনে বাধ্য করানোর জন্য একটি আইন পাশ করেন। ১১ সেপ্টেম্বর জোহান্সবার্গে সৃষ্ট গণ-প্রতিরোধে গান্ধী সকলকে এই আইন বর্জনের আহ্বান জানান। তিনি জনগণকে বলেন, যে কোনো ধরনের অত্যাচার ও হুমকির কাছে যেনো মাথা নত না করা হয়। সাত বছর ধরে আইন অমান্য আন্দোলন অব্যাহত থাকে। অনেকে অত্যাচারিত ও বন্দি হন। অত্যাচারে কেউ কেউ আহত হন, মারাও যান। শান্তিকামী ভারতীয়দের ওপর এই নৃশংস নিপীড়নের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। ভারত, ব্রিটেন ও আফ্রিকার পত্রপত্রিকায়ও এই জঘন্য অত্যাচারের সংবাদ পরিবেশিত হলে ভারত ও ব্রিটেন থেকে আফ্রিকার সরকারের ওপর চাপ আসতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত আফ্রিকার জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান ১৯১৪ সালে গান্ধীজির সঙ্গে বসে সমঝোতা করায় বাধ্য হন। আইন বাতিল করা হয়। গান্ধীর আদর্শ জয়ী হয়। এখানেই ‘সত্যাগ্রহের’ ভিত্তি স্থাপিত হয়। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের অনুরোধে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে লন্ডন হয়ে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি ভারতে ফিরে আসেন। এই কারণে দিনটিকে প্রবাসী ভারতীয় দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

গান্ধীজি ভারতে ফিরেই তাঁর পারিষদবর্গসহ প্রথমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আশ্রমে ওঠেন এবং আশ্রমে প্রায় এক মাস (কারো মতে ৭দিন) সময় কাটান। ১৯১৪ সালে আফ্রিকায় গান্ধীজির গুণমুগ্ধ ভক্ত ও সাথীরাও তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধী দান করেছিলেন জানা যায়। ভারতে বিশ্বকবিই প্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করে তিনি যে কতো বড় মাপের মানুষ তা ভারতবাসীকে জানিয়ে দেন। গান্ধীজিও কবিকে ‘গুরুদেব’-এর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতে ফেরার পর তিন বছর ভারতীয় রাজনীতির আনাচে-কানাচে ঘুরে কাটান। এই সময় রাজনৈতিক কোনো আন্দোলনে তিনি অংশ নেননি। তিনি ব্রিটিশের যুদ্ধ চেষ্টাকে সমর্থন করেন এবং ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান সেনাদলের জন্য সৈন্য সংগ্রহে ব্রতী হন। একই সঙ্গে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বিহার ও গুজরাটের কৃষকদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয়দের প্রবল স্বাধীনতা আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে কুখ্যাত ‘রাওলাট অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। এই বিধি সন্দেহভাজন যে কাউকে বিনা বিচারে কারাবন্দি করার ক্ষমতা প্রদান করে। গান্ধীজি এর প্রতিবাদে ভারতবর্ষে একদিনের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেন। পাঞ্জাবে খবর ছড়ায়- নেতাদের বন্দি এবং অনেককে গুম করা হয়েছে। পাঞ্জাবে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জনগণ পথে নেমে আসে। ব্রিটিশ সেনারা মানুষের ওপর নির্যাতন চালায় এবং বাড়ি, দোকান ও কারখানা লুট করে। প্রতিবাদে অমৃতসরের  জালিওয়ালানাবাগে ৪০০ নরনারী ও শিশু জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে মার্শাল ল জারি করে জেনারেল ডায়ার্সের নেতৃত্বে তিন দিক থেকে ঘিরে গণজমায়েতের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সামনে ছিল উঁচু দেয়াল। মানুষের পালানোর কোনো পথ ছিল না। অর্ধেকেরও বেশি লোক মারা পড়ে। বাকি মানুষ আহত হয় মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার এই আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। জেনারেল ডায়ার্সকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

 

গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অঘোষিত অহিংস এই যুদ্ধ খুব কার্যকর হয়েছিল

১৯২০ সালের শরতে গান্ধী রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসেন এবং পার্টির সর্বময় কর্তৃত্ব কব্জা করেন। সেই সময় ভারতবর্ষ নয় শুধু, সম্ভবত অন্য কোনো দেশেও তাঁর মতো প্রভাবশালী নেতা আর কেউ ছিলেন না। তিনি ৩৫ বছর বয়স্ক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। ভারতের প্রধান শহরগুলোর একটাতে কংগ্রেসের উচ্চ মধ্যবিত্তদের নিয়ে তিনদিনের কর্মশালার মাধ্যমে তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। কর্মশালায় পার্টিকে ক্ষুদ্র শহরে ও গ্রামে তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গান্ধীর বাণী খুব সহজ। তাঁর মতে ব্রিটিশের আগ্নেয়াস্ত্র নয়, ভারতীয়দের অসম্পূর্ণতার কারণে তারা ব্রিটিশের দাসত্ব করছে। গান্ধীর কর্মসূচি হলো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সরাসরি ব্রিটিশ নির্মিত ও ব্রিটিশের সাহায্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য এবং বিধানসভা, আদালত, অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন। তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের পরিবর্তে খাদি পরার আহ্বান জানান এবং নিজেদের চরকায় সুতা কেটে বোনা কাপড় পরে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করার উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বিশেষ করে মহিলাদের চরকায় সূতা কেটে কাপড় বোনায় বেশি উৎসাহিত করতেন। তিনি নিজের পরনের কাপড় নিজেই বুনতেন। এই আন্দোলন এমন এক কৌশল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করা হয়। এই সময় মহিলাদের চরকার কাজকে অসম্মানজনক মনে করা হতো। তিনি একে আত্মনির্ভর হওয়ার সম্মানজনক আয়ের উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি শিক্ষিত সম্প্রদায়কে ব্রিটিশের অফিস, আদালত বর্জন করে চাকরি থেকে ইস্তফা ও ব্রিটিশ উপাধী বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন।

এই আন্দোলনের সংবাদ বিদ্যুৎবেগে সারাদেশকে আলোড়িত করে এবং বিদেশী শাসকদের মনে কাঁপন ধরায়। তাঁরা হাজার হাজার আইন অমান্যকারী সত্যাগ্রহী বন্দি করতে শুরু করে। মানুষ হাসতে হাসতে লাইন দিয়ে বন্দিত্ব বরণ করতে থাকে। ১৯২২ সালে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠলে, পূর্ব ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চৌরি চৌরায় আন্দোলন সহিংস পর্যায়ে গেলে গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে তাঁর অনেক অনুসারীর মনে ধাক্কা লাগে। তাঁরা ভাবলেন যে, তাঁর এই স্বেচ্ছামূলক আত্ম-সংযম ও বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতা জাতীয় সংগ্রামকে সংকুচিত করে ধর্মীয় অসারত্বে পর্যবসিত করবে। এরপর ১৯২২ সালের ১০ মার্চ গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে ছয় বছরের কারাবাসের দণ্ড দেয়া হয়। অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের জন্য তাঁকে ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি দেয়া হয়। তাঁর অবর্তমানে কংগ্রেসে ভাঙন ধরে। দুই দলের মধ্যে এক দলের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু ও অপর দলের নেতা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী ও বল্লভভাই প্যাটেল। সবচেয়ে বড় ক্ষতি ১৯২০-২২ পর্যন্ত চলা অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যে সৌহার্দ্যসূচক বন্ধনের সৃষ্টি হয়েছিল তা ভেঙে পড়া। গান্ধী আলোচনা ও যুক্তির সহায়তায় বিবাদমান দুই সম্প্রদায় থেকে পারস্পরিক সন্দেহ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অপসারণের প্রয়াস নিয়েছিলেন। মারাত্মক দাঙ্গা দেখা দিলে তিনি জনগণকে অহিংসার পথে ফেরানোর লক্ষ্যে ১৯২৪ সালের শরতে তিন সপ্তাহের অনশন ধর্মঘটে বসেন। তিনি সফল হন। কংগ্রেস ১৯২৪ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করে। তিনি এই পদে এক বছর কাজ করেন। 

১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য বিখ্যাত ব্রিটিশ আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয়কে সদস্য করা হয়নি। কংগ্রেসসহ অন্যান্য পার্টি কমিশন বর্জন করে। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের কাছে এক বছরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের দাবির মতো কঠোর প্রস্তাব পেশ করেন, অন্যথায়, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এক বছরের মধ্যে দেশজুড়ে অহিংস আন্দোলন শুরু হবে বলে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেন। তিনি সরকারকে প্রথমে দুই বছর সময় দিতে চেয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জোরাজুরিতে এক বছর সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কংগ্রেসে গান্ধী স্বমহিমায় ফিরে আসেন। ব্রিটিশ রাজ তাঁদের চরমপত্রকে অবজ্ঞা করে। ১৯৩০ সালের মার্চে তাঁর বিখ্যাত লবণ সত্যাগ্রহ ও লবণ-যাত্রা শুরু হয়। কারণ ব্রিটিশ সরকার লবণের ওপর ট্যাক্স বসিয়েছিল। এতে দরিদ্র জনগণের কষ্ট বাড়ে। গান্ধীর এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অঘোষিত অহিংস যুদ্ধ খুবই কার্যকর হয়েছিল। লাখো লাখো মানুষ তাঁর মার্চে শামিল হয়েছিল। তিনি ১২ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল এলাহাবাদ থেকে চারশ মাইল পায়ে হেঁটে লবণ উৎপাদনস্থল ডান্ডি পৌঁছেছিলেন। উদ্দেশ্য স্বহস্তে লবণ উৎপাদন করবেন। সরকার মার্চ থেকে ৬০ হাজার আন্দোলনকারীকে বন্দি করেন। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য লর্ড এডওয়ার্ড আরউইনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। ১৯৩১ সালের মার্চে সরকার অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের বিনিময়ে সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়। সরকার বিলেতে অনুষ্ঠেয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য গান্ধীকে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন। আলোচনায় কেবল ভারতীয় যুবরাজ ও সংখ্যালঘুদের সমস্যা স্থান পায়। এতে গান্ধীসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতারা হতাশা নিয়ে ফিরে আসেন। লর্ড আরউইনের স্থলাভিষিক্ত লর্ড উইলিংটন জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে নূতন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি গান্ধীকে কারাবন্দি করেন। উদ্দেশ্য তাঁকে তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা।

১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সরকার নূতন সংবিধানে ভারতের নিন্মশ্রেণির অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের সংবাদ শুনে তিনি এর প্রতিবাদে জেলের মধ্যে অনশন শুরু করেন। আবেগের বশে এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিন্মশ্রেণির জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি ড. বি. এম. আম্বেদকরসহ অন্যান্য হিন্দু নেতারা এই ব্যবস্থা দলিতদের (মহাত্মা গান্ধী এদের ‘হরিজন’ নাম রেখেছিলেন। কিন্তু তা টেকেনি। সরকারি নথিতে এদের নাম নমঃশূদ্র।) উপকারে আসবে মনে করেছিলেন। মহাত্মার মতে, শিক্ষা-দীক্ষায় এদের উন্নত করতে পারলে এরা উচ্চ শ্রেণির সমকক্ষ হয়ে উঠবে।

 

বাপুজির বহু বর্ণময় জীবন ঘাতকের বুলেটে অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়

গান্ধী ১৯৩৪ সালে কেবল নেতৃত্ব নয় সদস্যের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল যে, কংগ্রেস নেতাদের কাছে অহিংস আন্দোলনের কোনো তাৎপর্য নেই। অথচ সেটিই তাঁর বিশ্বাসের ভীত ছিল। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে জাতি গঠনে মনোনিবেশ করেন। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। এদের বেশির ভাগ নিরক্ষর। তিনি এদের স্বাক্ষর করা, সমাজের বড় ব্যাধি অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়া, সুতা কাটা ও কাপড় বোনায় উৎসাহ দেওয়া ও অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলে বেকার চাষীদের আত্মনির্ভর করায় মনোনিবেশ করেন। ভারতের কেন্দ্রস্থলে সেবাগ্রাম নামক স্থানে তিনি বাস করতে শুরু করেন। সেটিই ছিল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শেষ ক্রান্তিকালে পৌঁছায়। গান্ধী ফ্যাসিবাদবিরোধী ছিলেন। তিনি যুদ্ধকে ঘৃণা করতেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ফ্যাসিবাদকে সমর্থন না করলেও ভারতের ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রয়াসে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। গান্ধী আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ রাজ নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব ভারতীয়দের দিয়ে মেনে নেওয়ানোর জন্য স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস-এর নেতৃত্বে একটি মিশন পাঠায়। তাঁরা ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাকচাতুর্যের মাধ্যমে দ্ব্যর্থবোধক প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁরা রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চান। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে বিভেদ উসকে দেওয়া। তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় এবং মিশনও ব্যর্থ হয়। ১৯৪২ সালে গান্ধীজি ভারত ছাড় আন্দোলনের ডাক দেন। এই সময় অক্ষশক্তি বিশেষ করে জাপানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের যুদ্ধের ক্রান্তিকাল। ব্রিটিশ সরকার গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা সকল কংগ্রেস নেতাদের কারাবন্দি করে। তাদের উদ্দেশ্য কংগ্রেস পার্টি ধ্বংস করা। ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমে বাড়তে থাকে। পার্টির শীর্ষ নেতাদের পুনের (পূর্বের পুনা) আগা খান প্রাসাদে (বর্তমান গান্ধী জাতীয় মেমোরিয়াল) বন্দি করে রাখে। বন্দিদের মুক্তির অল্প কিছুদিন আগে গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা ১৯৪৪ সালে কারাগারে মারা যান।

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে লেবার পার্টির বিজয় ভারত-ইংরেজ অধ্যায়ে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে। পরবর্তী দুবছর ধরে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি-পূর্ব আলোচনা চলতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন প্রদত্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত বিবেচিত হয়। তিনি আগস্টের মাঝামাঝি ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান দুটি নূতন দেশে পরিণত করে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব করেন এবং দুই পক্ষই এতে সম্মতি দান করে। এতে গান্ধী চরম হতাশ হন। তিনি চাননি ভারতবর্ষ দ্বিধাবিভক্ত হোক। কংগ্রেস নেতারা জেলে থাকার সময় মুসলমান বিভেদকামী শক্তির কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায় এবং এরা পাকিস্তান দাবির সমর্থন লাভে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধানোর মতো কুনাট্যের আশ্রয় নেয়। গান্ধীজি ভারতবর্ষের বিভাজন আটকাতে পারেননি, দাঙ্গাও বন্ধ করতে পারেননি। অনেক রক্ত ঝরার পর তিনি দাঙ্গার প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করেন। আগস্ট মাসে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। সেপ্টেম্বরে তাঁর অনশনকালে দাঙ্গা বন্ধ হয়। তিনি দাঙ্গায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিহার, কলকাতা ও নোয়াখালী পরিভ্রমণ করেন। তিনি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি পরক্ষভাবে দিল্লী নগরীকে দাঙ্গার জন্য দায়ী করেন। জানুয়ারির ৩০ তারিখে সন্ধ্যায় গান্ধীজি প্রার্থনা সভায় যাবার পথে নাথুরাম গডসে তাঁকে গুলি করলে এই মহাজীবনের অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু আকাশবাণীতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সেদিন জানান:

‘বন্ধু ও সহযোদ্ধারা, আমাদের জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে এবং সেখানে শুধুই অন্ধকার। আমি ঠিক জানি না, আমি আপনাদের কী বলব, কেমন করে বলব! আমাদের প্রেমময় নেতা, যাঁকে আমরা ‘বাপু’ বলে থাকি, আমাদের জাতির পিতা আর নেই। হয়তো এভাবে বলায় আমার ভুল হচ্ছে। তবে তাঁকে আর আমরা দেখতে পাব না, যাঁকে আমরা বহুদিন ধরে দেখেছি। আমরা আর উপদেশ কিংবা সান্ত্বনার জন্য তাঁর কাছে ছুটে যাব না এবং এটি এক ভয়াবহ আঘাত, শুধু আমার জন্যই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য।’

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক  ঢাকা/তারা