শিল্প ও সাহিত্য

প্রতিটি শব্দে যুক্ত করতে চেয়েছি আমার বোধ-বিন্যাস ও পাঠক্রিয়া

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে; ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’। দু’বছর পর প্রকাশিত হয় ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’। বইটি তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে, তিনি প্রশংসিত হন। নানা বিষয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা প্রায় সত্তরটি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ত্রিশের অধিক। অনুবাদ করেছেন রুমি ও রসুল হামজাতভের কবিতা।  পাশাপাশি উপন্যাস, ছোটগল্প ও স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাঁর কবিতা ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ ভাষাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননা। বুয়েট থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশে ও বিদেশে নানান প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থেকে বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও আধুনিকতা প্রসঙ্গে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক মোজাফ্‌ফর হোসেন। শ্রুতিলিপি করেছেন স্বরলিপি।  

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আপনি ষাটের দশকের কোন সময় লিখতে শুরু করলেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সেই অর্থে লেখালেখি শুরু করি ১৯৬৬ সালে। তার আগে সামান্য প্রস্তুতিপর্ব ছিল।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: অর্থাৎ তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের লেখক-কবিরা তখন শুধু শিল্পের দায়িত্ব না, জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন— রাষ্ট্রগঠনে কাজ করছেন। একইসঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাষা কেমন হবে—শিল্পের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা— সেটাও তৈরি করছেন। আপনি কি এ বিষয়ে তখন সচেতন ছিলেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সেটা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ এখানে দেশভাগের পর যাঁরা কবিতা লিখতে শুরু করলেন তাঁরা যেন কলকাতার হাওয়াকে ঢাকায় এনে দাঁড় করাতে চাইলেন। সেটা দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পঞ্চাশে এসে একটা নতুন কবিতার আন্দোলন হয়ে গেল। এবং নতুন কবিতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ভালো কবিদের—  মেজর কবিদের পেয়ে গেলাম। ষাটে এসে আমরা আমাদের এই অংশকে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলাম।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আপনি নিজে তখন সময়ের ব্যাপারে কতটা সচেতন ছিলেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সচেতন না হয়ে আমাদের কোনো উপায় ছিল না। ৬৬’র কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। অস্তিত্বের লড়াইয়ের সাথে আমাদের সামনে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের ডাক ছিল। আমাদের সামনে স্বপ্ন ছিল, একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা নির্মাণের ডাক ছিল। এই স্বপ্নগুলো ১৯৬৬ সনে রাজনৈতিকভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যার ফলে, যারা সচেতনভাবে লেখালেখি শুরু করলেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষা নির্মাণ এবং নিজস্ব পথনির্মাণের দিকে এগোলেন। ১৯৬৬ থেকে শুরু করে ১৯৬৮ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছি। তার ভেতরে রুশ কবিতা, চৈনিক কবিতা এবং পশ্চিমের আরো অনেক দেশের কবিতা। এটি ছিল আমার নিজস্ব ভাষা তৈরির পাশাপাশি দেশ থেকে যে রাজনীতি উঠে আসছে তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রকৌশলের ছাত্র, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। আমি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এবং আমি নির্বাচিত প্রতিনিধিও ছিলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতএব কখনো রাজনীতি আমার পিছু ছাড়েনি। বাংলাদেশের রাজনীতি ধরার জন্য, বাঙালির রাজনীতি ধরার জন্য, বাংলা ভাষার রাজনীতি ধরার জন্য তার পিছে-পিছে ছুটেছি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: এখান থেকে একটা কথা আসে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর রাজনৈতিকসত্তা এবং শিল্পীসত্তা এই দুটোর সমন্বয় কেমন হয়েছে কবিতার ক্ষেত্রে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এখানে আরো একটি ট্রাজেডি আছে। যারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন তাদের সময়ের মূল অংশটুকু খেয়ে ফেলে তাদের একাডেমিক পাঠ। তার ফাঁকে রাজনীতিতে আসা এবং কবি হয়ে ওঠার পরিভ্রমণে যুক্ত হওয়া সহজ নয়। আমি এখন এটুকু বলতে পারি, ৭০ বছর বয়স পার করে মনে হয় কবিতাই আমার কাছে প্রথম ছিল। দ্বিতীয় রাজনীতি এবং তৃতীয়ত একাডেমিক পাঠ। ফলে মোটামুটিভাবে লেখাপড়াটা চলে যাক—  পরে কি হবে না হবে দেখা যাবে, প্রাণের চর্চাটা প্রধান হয়ে থাকুক এটাই আমার ইচ্ছা ছিল। আজ অব্দি সেই ইচ্ছা থেকে আমি কখনো চ্যুত হইনি। কেননা, আমার বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি দেশ পেয়েছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। রাজনীতি বলতে আমি মানুষের রাজনীতি করি, মাটির রাজনীতি করি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: যদি আবার কবিতার প্রসঙ্গে যাই, একবার অক্তাবিও পাস রবার্ট ফ্রস্টের সঙ্গে দেখা করেছেন। পাস তখন তরুণ। ফ্রস্ট তাঁকে বলেছিলেন, প্রত্যেক তরুণ কবির কাজ হচ্ছে নতুন কিছু নিয়ে আসা। এবং তার প্রথম কাজ হচ্ছে তার ঐতিহ্য অস্বীকার করে নতুন একটা জায়গায় পা ফেলা। আপনি যখন কবিতা লিখতে এসেছেন নতুন বাংলাদেশের কবিতার ঐতিহ্য কি হবে এটা নিয়ে অনেকেই দ্বিধান্বিত থেকেছেন— ধর্মীয় ঐতিহ্য নাকি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে থাকা আবার না থাকা নিয়ে কী বলবেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা ১৯৫২-এর পর থেকেই নিজস্ব ধারাটি খুঁজে পেলাম। ১৯৬০-এর পর থেকে যাঁদের ষাটের কবি বলা হয়, তাঁরা নিজস্ব ভাবধারাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া শুধু না, রাষ্ট্রীয়ভাবেও একটা দায়িত্ব পালনে চলে গেলেন। তাঁদের অনুসারী হয়ে আমরা যখন এলাম আমরা চিন্তা করলাম কে কোন দিকে যাবো। ভেতরে-ভেতরে আমরা সবাই কিন্তু তৈরি হচ্ছিলাম, যার প্রতিফলন আপনি বর্তমানে দেখতে পাবেন। আমরা চেয়েছিলাম যেন একটু পোক্ত মূল পাই। যার কাণ্ডটিও প্রশস্ত হয় এবং কিছু ফুল-ফল হয়। বাংলা কবিতার পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন স্বপ্নবীজ বোনাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আপনার কবিতা যদি আলাদা করি, এই পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের কবিতার ধারায় দেখি, তাহলে দেখবো আপনার কবিতা প্রতীকধর্মী, পরিশীলিত, বেশি দীর্ঘ না, পরিমিতি বোধ আছে। উইলিয়াম ব্লেকের একই রকম প্রতীকবাদী কবিতা আমরা পড়েছি। আপনি কি সচেতনভাবেই প্রতীকবাদী কবিতার দিকে হেঁটেছেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: একেবারে অকপটে স্বীকার করতে পারি, আমি কবিতার নানারকম অনুসরণে গেছি। আমার নিজের পথটি খুঁজে নিতে হয়েছে বিভিন্ন পথ অন্বেষণ থেকে। যদি ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ দেখেন, এটি প্রায় দশ বছরের লেখা কবিতা থেকে ফেলে দেওয়ার পরে যা অবশিষ্ট— তাই। বের হওয়ার পরে দেখি, এখানে হাবীবুল্লাহ সিরাজী কোথায়? নেই তো! তার দুই বছর পরে যখন ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’ বের হয়, আপনি দেখবেন একদম ভিন্ন চরিত্রের একটি বই। তারপরও আমি দেখি, এখানে তো হাবীবুল্লাহ সিরাজী নাই— সেই অর্থে। এই করতে-করতে আমি এগোচ্ছি কিংবা পিছোচ্ছি, আমি জানি না আমি আমার নিজের ভাষাটি তৈরি করতে পেরেছি কিনা!

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  এখানে একটা ব্যাপার, প্রায় ৪৪ বছরে প্রথম বই থেকে আজ পর্যন্ত আপনার ত্রিশের অধিক মৌলিক কবিতার বই প্রকাশিত হলো। আমরা পাঠক হিসেবে দেখেছি, এতো বিষয় বৈচিত্র্য, দেশি বিদেশি নানা ঘটনা ও প্রেক্ষাপটের উপর লেখা কবিতা। সমকালীনতা, ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ, পুরাণ, উত্তরাধুনিকতা— সবই আছে। কখনো কি মনে হয়নি কোনো কবিতা থেকে কোনো কবিতা উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে? যেমন আপনার কবিতা পড়লে আপনার নাম না থাকলেও পাঠক বুঝতে পারবে এটা কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা। আবার একইসঙ্গে বুঝবে এটা আগের কবিতা থেকে আলাদা। এই চ্যালেঞ্জটা কীভাবে আপনি নিয়েছেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: একটি কবিতা লেখার পরে নিজেই ভাবি এটি আগে লিখেছি কিনা? এবং অন্য কেউ লিখেছেন কিনা? হতে পারে অন্য কেউ লিখেছেন, তবে আমার ভেতরে এসেছে আর একটা কবিতা হয়ে। তারপর খুঁজতে শুরু করি, ভেবে দেখি একটা শব্দ নতুন যোগ করতে পেরেছি কিনা? কিংবা একটা বিষয়কে অন্যভাবে দেখাতে পেরেছি কিনা? যে পর্যন্ত না আমি সন্তুষ্ট হই, আমি কবিতাটি মুদ্রিত আকারে দেখতে চাই না। বিষয়বস্তু যেটা বললেন, আমি মাথার ভেতরে ধরেই নিই, আপনি যদি খেয়াল করেন ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’, ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’, ‘মধ্যরাতে জ্বলে ওঠে গ্লাশ’ এরপর কিন্তু আমার বেসিক চেঞ্জ ‘হাওয়াকলে জোড়া গাড়ি’। এরপর ‘কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা’, একটি বড় চেঞ্জ আসে ‘কাদামাখা পা’তে। এখন যে অবস্থানে আমি আছি সেটি হচ্ছে পশ্চিমের গুপ্তচর থেকে সরে যাওয়ার পথ খোঁজায়। আমি কতটুকু পরিমিত হতে পারবো। আমি কত অল্পতে পৌঁছতে পারবো গন্তব্যে। এসব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। নিজেকে ভাঙতে হচ্ছে। যদি বলেন আমার দর্শনটা কী? আমার দর্শন আমি নিজে এ পর্যন্ত যা পেয়েছি জড় ও চৈতন্যের সঙ্গে পঞ্চভূত সম্মিলন করা। আপনি খেয়াল করে দেখবেন আমার কবিতায় এক সময় যে রকম খানা-খাদ্য ছিল রান্না-বান্না ছিল এবং সেটাকে আমি পাকাতে চেষ্টা করেছি। এখন সেটি অগ্নি, বায়ু, জল, মৃত্তিকার সঙ্গে লগ্ন। আর আমি কখনো বিশ্বাস করিনি যে মানুষবিহীন কোনো কবিতা লেখা যায়। শিল্পের জন্য শিল্প করতে এসেছি বটে কিন্তু মানুষকে বাদ দিয়ে নয়।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  কবিতাবিষয়ক আপনার একটি প্রবন্ধে আপনি বলেছেন, কবিতা কোনো ঘটনা বা বিষয়ের উৎস অন্বেষণ করে। এবং উৎস থেকেই এ কবিতাটি আসে। একদম একক একটি জায়গা থেকে। এই বিষয়টি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এটাকে দুই ভাবে দেখা যায়। এটা ভূমির উপরিতল আর ভূমির নিচুতল। যেমন জলভাগে যা থাকে উপরিতল থেকে আসে। আর মৃত্তিকার অভ্যন্তরে যা থাকে একেবারে মূল কাঠামো থেকে আসে। আমি মোটামুটি চিন্তা করি যেটা নিচের থেকে আসে তাকে উপরে আনতে যে উপরে থাকে তাকে নিচে নিয়ে যেতে। এবং নিচে দেয়ার সময় আমি আগুন পর্যন্ত, আগ্নেয়গিরি পর্যন্ত যেতে চাই। উপরে যাওয়ার সময় আমি নক্ষত্র পর্যন্ত যেতে চাই। এই হচ্ছে মোটামুটি আমার মতো করে আমার ভাষার অংশ। এটাকে ফ্রেমিং করতে গিয়ে আমি তখন প্রতিস্থাপন করি, নানা রকম তথ্য-উপাত্ত। আমার সম্পর্কে যদি কেউ কখনো কিছু লেখেন কিংবা বলেন, আমি খুব মান্যতার সঙ্গে সেটা পাঠ করি এবং বুঝতে চেষ্টা করি আমি আমার লেখাটাকে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছি। এটি আমার জন্য উপকার যেমন হয়, অপকারও তেমন হয়। আবার অনেক সময় এমন হয় উপরেও না, নিচেও না, আমি মধ্যস্তরে কিছু পেয়ে গেলাম, তখন মনে হয় সেটিকে আমি ভূমিতে নামাবো নাকি উপরে তুলবো। এগুলো কবিতা লেখার সময়ের সিদ্ধান্তের কথা।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: খুবই সচেতন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি অচেতনে কোনো জিনিস করার চেষ্টা করি না। আমি স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সেই রাতের স্বপ্নকে দিনে আনতে চাই, দিনের স্বপ্নকে রাতে নিতে চাই। দিনের মতো করে, রাতের মতো করে। আমি বিশ্বাস করি মনে-প্রাণে যে, একটি শব্দও আমি কখনো অচেতনভাবে বসানোর চেষ্টা করিনি। আমার দুর্বলতা হতে পারে যে, পাঠকের কাছে পৌঁছতে গিয়ে অচেতন শব্দটি ‘অবসকিওর’ হয়ে যেতে পারে। কখনো ফাঁকি দিতে চাইনি। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছি আমার রক্তবিন্দু থেকে শুরু করে আমার মেধা থেকে শুরু করে আমার বোধ-বিন্যাস ও পাঠক্রিয়া। এখানে আমি কখনো আপোষ করিনি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: একটু আগে আপনি আপনার কাব্যদর্শনের কথা বলছিলেন। আসলে কবিতার কোনো দার্শনিক সত্য থাকে কি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অবশ্যই। শিল্পের দার্শনিক সত্য— কবি হোক, শিল্পী হোক— নিজে নির্মাণ করেন। নিজেই প্রকৃতির সঙ্গে, জড়কে যিনি চৈতন্যে আনতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি একখণ্ড পাথরেরও প্রাণ আছে। আমি কিন্তু পাথরের প্রাণে বিশ্বাস করি। কীভাবে? আপনাকে একটা সরল উদাহরণ দিই, ঘরের মেঝেতে আপনি মারবেল পাতবেন, মারবেল জড়বস্তু। সেই মারবেল পাতার দশ-পনেরো দিন পরে দুই ফোঁটা কালি ফেলবেন, আবার পনেরো দিন পরে দেখবেন ওই কালি ওখানে নেই ও খেয়ে ফেলেছে। কারণ ও জীবন্ত আছে, ও খাচ্ছে। যখন আপনি পাথর বাদ দিয়ে মোজাইক করবেন কিংবা একটা স্লেট ফেলবেন, ও কিন্তু সহসা খাবে না। ও কৃত্রিমভাবে এসেছে। কিন্তু যে পাথরটি প্রাণ নিয়ে এসেছে, পাথরেরও প্রাণ যে আছে সে সেটা প্রমাণ করবে তার অস্তিত্ব দিয়ে। বিশ্বাস করি জড়-চৈতন্য সামান্য একটি তীক্ষ্ম সরলরেখা দিয়ে আমরা ভাগ করার চেষ্টা করি। রফিক ভাই (কবি রফিক আজাদ)-এর কবিতায় বলা সুতোর এপার আর ওপার। এই যে সুতো, এটি চিহ্নিত করা কবির জন্য একটি বড় কাজ। আমার শিল্পভাবনা আমি দার্শনিকভাবে উপস্থাপন করতে চাই, অতবড় কথা আমি বলতে পারি না। কিন্তু এই কথাটি বলতে পারি, মানবজন্মে জড় এবং চৈতন্যের বিভেদ রেখা যিনি এক করতে পারেন তিনিই প্রকৃত শিল্পী। আমার কবিতার দার্শনিক সত্য যদি কিছু থাকে সেখান থেকেই উৎসারিত।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  আচ্ছা এখানে দর্শনের প্রসঙ্গ যেহেতু এলো; প্রসঙ্গ ধরে বলি, দার্শনিক প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কাঠামোর ভেতর কবিদের স্থান রাখেননি। আবার কবি পার্সি বিশি শেলি তাঁর ‘ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ প্রবন্ধে বলছেন যে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন কবি। আপনার কী মনে হয়?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: দেখেন, কবিদের কথা কেন বলতে গেলেন প্লেটো? কেন বললেন না কৃষকের কথা? কবির কথা কেন বললেন, তার মানে কবি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বলাটাও আমি আমার দর্শনে ধনাত্মক দেখি। কবিকে তিনি স্বীকার করেছেন। এবং তাকেই তিনি বলছেন ‘না’। কবি শেলির কথা যেটি বললেন, তিনি কবি, কবিতার অনন্ত মহাপ্রাণ তার সঙ্গে যুক্ত।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন কবি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোধহয় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা টের পেয়েছি।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমাদের রাষ্ট্রগঠনের মধ্যদিয়ে টের পেয়েছি এবং কবি শব্দটিকে মহিমান্বিত করার জন্য শব্দটির কি মর্মার্থ আমি গ্রহণ করবো তার উপর কবির গুরুত্ব বিবেচনা করবে। এখন যদি আমি কাঠকেও কবি বলি, কিংবা লোহাকেও কবি বলি (হ্যাঁ, লোহাও কবি কিন্তু লোহাকে কবি হয়ে উঠতে হবে) তাহলে হবে না। আমরা ৭ই মার্চের ভাষণকে বলছি মহত্তম কবিতা। এটাতো ভেতর থেকে উঠে এসেছে, ফলে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কবি উপাধি পাচ্ছেন। এবং এটাই স্বাভাবিক। কবিতা এভাবে চলে আসে প্রাণের ভেতর থেকে। আপনি নিজে গদ্যসাহিত্য করেন কিন্তু কবিতার ব্যাপারে আপনার যে মনোযোগ তা কিন্তু সামগ্রিকভাবে আপনার জীবনকে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করে, এভাবে সবাই কবি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  আপনার কথার সূত্র ধরেই মনে পড়ল, মনোবিজ্ঞানী ইয়ং একটা প্রবন্ধ লিখেছেন সমস্ত সৃষ্টির মূলে যারা আছেন তাদের নিয়ে, কিন্তু প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্য পোয়েট’।  

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ইয়েস। তিনি নিজেও সৃষ্টিশীল মানুষ বলে বিষয়টি সেভাবে গ্রহণ করেছেন। এই কারণে আমি বলি, সৃষ্টিশীলতার মাপকাঠিতে প্রকৃতির চেয়ে বড় কবি আর কেউ নন।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আমার একটা প্রশ্ন, বাংলাদেশ পর্যায়ে ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত যাঁরা কবি, এখনকার তরুণ কবিরা যখন তাঁদের সমালোচনা করেন, একটা বিষয় তাঁরা একটু মোটাদাগে বলেন যে, এই কবিদের কবিতাগুলো হয়ে গেছে বক্তব্যনির্ভর। শিল্পের জায়গা থেকে এই কবিতাগুলো টিকবে না বলে তারা সিদ্ধান্ত দেন। আপনি কি মনে করেন জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে গেলে কবিতা শিল্পমানের জায়গা থেকে পড়ে যায়?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না। যেটাকে আমি কবিতা বলছি সেটা নিশ্চয় কিছু গুণ ধারণ করে, যেজন্য লোকমুখে চলে। পঞ্চাশের দশকে হোক কিংবা ষাটের দশকে বর্ণনামূলক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু ঠিক সুবিচার তাঁদের প্রতি করা হচ্ছে না। অনেকে তার বাইরেও লিখেছেন, ভেতরেও লিখেছেন। বর্ণনামূলক কবিতা যদি কবিতা না হতো তাহলে অনেক মহাকাব্য আমরা এতোদিনে ফেলে দিতাম। বাংলাভাষায় অন্য কোনো মহাকাব্য না হোক, মেঘনাদবধ নামে একটি কাব্য আমরা এতোদিন বহন করে আসছি। জরুরি বিষয় হলো, কবিকে বিচার করার জন্য, কবিতার ঐতিহাসিক পাঠ জরুরি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: স্লোগানধর্মী যে কবিতার কথা বলা হচ্ছে, এটা কিন্তু আপনার কবিতা সংখ্যায় কম। আমি বলছি মুখে-মুখে আবৃত্তিযোগ্য এরকম কবিতার কথা।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি প্রলোভনে পড়িনি। একই কথা দশবার বলে- ওটা আমাকে টানেনি। আমার ধর্ম এবং মর্মে যে জিনিসটি ছিল, আমি শব্দ ব্যবহার করবো উপযোগী করে। যে যে বিষয়বস্তুর মধ্য আমি যাচ্ছি তার মতো করে। বাক্য ব্যবহার করবো সেই উপযোগী করে কবিতা যা চায়। অনেকে আমাকে বলেন যে, তুমি বেশি ছন্দের ব্যাপারে আক্রান্ত। আমি আক্রান্ত না। আমি বাংলা কবিতার পরম্পরা, বাংলা কবিতার স্বাদ মননে নিয়ে লিখতে বসি। আমি যখন ডাল রান্না করি ডালে যখন পাঁচফোড়ন দিই, আমি মনে করি পাঁচফোড়ন দেয়া জরুরি। অনেকে হয়ত পাঁচফোড়ন না দিয়ে ডাল সিদ্ধ করে রান্না করেন। যার যা পদ্ধতি। তবে আমার বিবেচনায় স্লোগানধর্মী কবিতাও চূড়ান্ত বিচারে উৎকৃষ্ট কবিতা হতে পারে। কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাও তো স্লোগানধর্মী, কিন্তু এই কবিতা বাদ দিয়ে কি আমরা নজরুলকে ভাবতে পারি!

মোজাফ্‌ফর হোসেন: অসাধারণ কবিতা, যেভাবেই পাঠ করি।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ। সুকান্ত সারাজীবন যে কবিতা লিখেছেন স্লোগান তার মধ্যে আছে। কিন্তু তার মধ্যে এক একটি মর্মবাণী আছে যা মানুষকে টানে। আন্দোলিত করে। অতএব কবিতাটি হয়ে ওঠা বড় কথা। ভেতরের মালমসলায় যদি কবিতা হয়ে ওঠে সেটি টিকে যাবে।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: একটা বিষয়, আপনি কবিতা লিখেছেন আপনার সময় এবং পাঠকের জন্য। কখনো মনে হয়েছে নিজের জন্য কবিতা লিখছি বা আত্মমুক্তির জন্য কবিতা লিখতে হচ্ছে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: নিজের জন্য বললে বড় কথা হয়ে যায়। তবে মনে হয় যে, এটি একটি কাজ। একটা কমা যদি যথার্থভাবে বসাতে পারি কিংবা একটা সেমিকোলন যদি যথাস্থানে বসাতে পারি, আপনি খেয়াল করে দেখবেন আমি উর্ধ্বকমা ব্যবহার করি। প্রচুর পরিমাণে ড্যাশ ব্যবহার করি। যতিচিহ্ন ব্যবহারের ব্যাপারে আমি অসম্ভব ক্রিয়াশীল। কারণ আমি পাঠককে বলতে চাই, এটা এই। সম্প্রতি আমি যতিচিহ্নহীন কবিতা লিখছি, দেখতে চেয়েছি কতটা খুলতে পারি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: টানা গদ্যে কবিতা?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: টানা গদ্যে কবিতা অনেক আগেই আমি লিখেছি। আমি নতুন একটি কাজ করছি, এটাকে ধৃষ্টতা ধরবেন না। এটির নাম যাত্রাপুস্তক। ১৯৮০ সালে একবার চিন্তা করেছিলাম যখন আমি ‘হাওয়াকলে জোড়া গাড়ি’ লিখি। এটা ২০০৮ সালে শুরু করি। ধরা যাক কোরআন শরিফের কথা। কোনোরকম বিতর্কে না গিয়ে আমি যেটুকু বুঝেছি যে, একটি ঘটনা আছে মাছের পেটের ভেতরে গেলেন ইউসুফ নবী। তিনি বের হয়ে এলেন- এবার কাহিনিটি আমি বলবো এবং বলার পরে একটি অনুভব আমি দিব। এরপর আমি আর একটি কাহিনিতে আসবো। এরকম করে ত্রিশটি পর্ব লিখেছি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: সবই কি ধর্মীয় এলিগরি নিয়ে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ। যেমন লাঠি ফেলে দিলাম, সাপ হয়ে গেল। আমি এটিকে তুলে নিয়েছি আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং শেষে একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আমরা কি একে পুনর্নির্মাণ বলতে পারি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পুনর্নির্মাণ তো খুব বড় কাজ হয়ে যায়, পুনঃলিখন বলা যায়।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আমাদের সময়ের অনেক লেখককে ধর্মীয় মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে দেখি। আপনারা যখন লিখতে আসেন তখন এই ভূখণ্ড চিহ্নিত হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয়ে। তখন কবিতায় ভারতীয় বা আরব মিথ ব্যবহারে আপনাদের কোনো সমস্যা হয়েছে কি না?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কেউ কেউ সমস্যায় পড়ে থাকতে পারেন। আমি নিজে মিথ সরাসরি আনিনি। আমি মিথ; সেটি যে অঞ্চলের হোক, কিছুটা দেশজ ও লোকায়ত করে তুলতে চেয়েছি। আমি মিথের পুনর্নির্মাণ ঠিক করিনি, কিন্তু ভারতীয় মিথের প্রচুর উপকরণ কবিতায় ব্যবহার করেছি, খুব স্পষ্ট করে নয়, মিলিয়ে দিয়েছি, খুঁজে নিতে হবে। কৃষ্ণ-রাধা, বেহুলা, সুজাতা— এমন অনেক চরিত্র আছে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, ১৯৭২ সালে আমি শুরু করেছি রসুল হামজাতভের কবিতার অনুবাদ। তিনি দাগেস্তানের জনপ্রিয় কবি। ওঁর একটি বই আছে ‘আমার জন্মভূমি’ নামে। বইটি বাংলা একাডেমি থেকে স্বাধীনতার আগে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছিলেন আকবর উদ্দিন সাহেব। সেখানে কবিতাংশ অনুবাদ করেন কবি আবুল হুসেন। তখন থেকেই তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়। সিলেক্টেড কবিতায় অক্টেব বলে একটা অংশ আছে পঁয়ষট্টিটি কবিতা নিয়ে। সব আট লাইনের কবিতা। সেখান থেকে শুরু করলাম। আমরা জানি, তিনি আভার ভাষায় কবিতা লেখেন। পরে রুশ ভাষায় লেখা শুরু করেন। আভার ভাষায় মাত্র তিরিশ হাজার লোক কথা বলে। দাগেস্তানের পার্বত্য এলাকায় অনেক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস। কিছুদূর পরপরই ভাষা বদলে গেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, একটি ঘোড়ার পিঠে একটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয়। বস্তার ভেতরে দুপাশে নানাভাষা। ঘোড়াটি যখন উঠতে থাকে পাহাড়ে তখন বস্তার মুখ খুলে যায়, ভাষাগুলো পড়তে থাকে। যেখানে যে ভাষা পড়ে, সেখানকার মানুষ সেভাষায় কথা বলে। ঘোড়াটি যখন উপরে উঠে যায়, তখন শূন্য বস্তা পড়ে থাকে। ভাষাগুলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আমরা বলতে পারি, আপনি কেবল দেশীয় কবিতার ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশ্বকবিতা থেকেও গ্রহণ করেছেন। নির্দিষ্ট করে কোনো কবির দ্বারা আপনি কি প্রভাবিত হয়েছেন কখনো?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হয়ত অনুসরণ করিনি তবে মজ্জমান হয়ে পাঠ করেছি কয়েকজন কবিকে। যেমন ডিলান টমাসের কথা বলি। একসময় আমি ডিলান টমাসের ভেতর নিজেকে গড়িয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম আমাকে আমার স্বর নিয়ে থাকতে হবে। তারপরও কিছু অনুভূতি আমার কবিতার ভেতর চলে আসতে পারে। এর বাইরে কার্লোস উইলিয়ামস, ব্লেক, এলিয়ট, ইয়েটস এমন আরও কয়েকজন কবির কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করেছি।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: তখন তো বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ হয়ে গেছে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বোদলেয়ার, হেল্ডারলিন, রিলকের কবিতার অনুবাদ বুদ্ধদেব বসু করেছেন। বোদলেয়ারের কাছ থেকে শব্দের ব্যবহার ও রিলকের কাছ থেকে সংহত হওয়ার বিষয়টি শেখার আছে।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আপনি বলছিলেন, মধুসূদনকে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতা শুরু হলো। আমরা দেখি যে পশ্চিম থেকে তিনি সাহিত্যের কাঠামো নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিষয়টা ছিল ভারতীয় বা বঙ্গদেশীয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন পরে, ত্রিশের আধুনিকার সূত্র ধরে আমাদের লোকায়ত চেতনার এবং আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের যে কাঠামো ও ভঙ্গি তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটল কি না?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না, বিচ্ছেদ ঘটেনি। মধুসূদন শুধু ফর্ম নিয়ে আসেননি। তিনি এন্টিহিরো নিয়ে এলেন। রামায়ণের বিকল্প পাঠ তিনি তৈরি করলেন। আর আমাদের চোখ খুলে দিল বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা। একাধিকবার করে মহাভারতের কথা পড়েছি। আমাদের লোকায়ত দর্শন ও পুরাণের সঙ্গে আধুনিকতা মিলিয়ে অনেক কাজ হয়েছে।

মোজাফ্‌ফর হোসেন: আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, বৌষ্ণব সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, পুথি সাহিত্য— এই সাহিত্যের ধারাকে তো শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি অন্যভাবে দেখি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত উত্তরণের পথে আমরা নানাভাবে পা ফেলেছি। যার ফলে আমরা পশ্চিমে গেছি, পুবে থেকেছি, কিন্তু চূড়ান্তভাবে আমরা খুঁটিটি নিজের মাটিতেই পুঁততে চেয়েছি। আমি যদি নাম ধরে বলি- শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, বেলাল চৌধুরীসহ আরও অনেকে আছেন। তাঁরা নিজের পথে হাঁটলেও তাঁদের গন্তব্য এক ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তব কবিতা নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি গদ্যভাষ্যে নতুনভাবে কাজ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে জীবনানন্দ দাশকে নতুনভাবে উন্মোচন করছেন। এই যে পেছনের সঙ্গে সম্মুখকে জোড়া লাগানো, এটা তখন অনেকে করেছেন। এরপর আমরা দেখি আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, মহাদেব সাহা, হুমায়ূন কবির— এভাবে প্রত্যেকে তাঁর মতো করে কাজ করেছেন। আমরা মোটামুটিভাবে আলাদা করে চিহ্নিত হলেও সকলের ঋণ ছিল বাংলা কবিতার কাছে, বাংলা ভাষার কাছে এবং বাংলার আবহমান জীবনের কাছে। একটা কথা বলি, তখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের নবনির্মাণ করার একটা ব্যাপার ছিল। আজ যত সংহতভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশ আমার স্বাধীন দেশ, তখন সেটা নির্মাণ প্রক্রিয়ার ভেতর ছিল।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  আমরা সাধারণত ঐতিহ্য বা অগ্রজ লেখকদের কাছ থেকে গ্রহণ করি। আপনি কি তরুণদের কাছ কিছু গ্রহণ করেছেন কখনো?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার মৌলিক চিন্তা সময়ের কাছ থেকে গ্রহণ করা। তরুণ সময়কে রিপ্রেজেন্ট করেন। সময়ের প্রতিনিধিত্ব তরুণরা করেন। আমি সবসময় তারুণ্যের অংশ হয়ে থাকতে চাই।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  শেষ প্রশ্ন: ফ্রস্ট বলেছিলেন, কবিতার প্রত্যেকটা লাইনে, প্রতিটা শব্দে ঘাপটি মেরে থাকে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা। আপনার এ পর্যন্ত যে সৃষ্টি, তার আড়ালে ব্যর্থ কবিতার সংখ্যা কেমন হবে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এটা কঠিন প্রশ্ন আমার জন্য। অনেকে যখন যেটা লেখেন তখনই ঐ সময়ে সেটি নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে ভাবেন। আমার সেটা মনে হয়নি। আমার কেন জানি মনে হয়, সবই ঊন। এটা বিনয় না, আমার ভাবনা। নিজের কবিতাকে ব্যর্থ বা সার্থক— সেভাবে বলা খুবই কষ্টকর।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  আমি আসলে জানতে চেয়েছি, যে কবিতা আপনি গ্রন্থভুক্ত করেছেন, সেগুলো নয়, এর পেছনে যে কবিতার অপচয় হয়েছে, মানে আপনি খসড়া অবস্থায় ছিঁড়ে ফেলেছেন, সেই সকল কবিতার কথা।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার কবিতা লিখতে সময় লাগে। খসড়া তৈরি করে প্রথমে রেখে দিই। কিছুদিন পর সেটি আবার লিখি। একটি কবিতা আমি আট থেকে দশ বার লিখি। এসবই ব্যর্থতা, কারণ প্রথম প্রয়াসেই আমি চূড়ান্ত কবিতা লিখতে পারি না। এতে ক্ষতি যেটা হয়, যে আবেগ দিয়ে প্রথম খসড়াটা লেখা হয় বারবার সংশোধনের ফলে সে আবেগ কেটে যায়। নতুন একটা আবেগ এসে এর সঙ্গে জুড়ে যায়। অর্থাৎ যখন প্রকাশিত হয়, তখন শেষ চিন্তাটি তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তবে বিষয়বস্তুর তেমন হেরফের হয় না, হয়ত কাব্যরূপের পরিবর্তন ঘটে।

মোজাফ্‌ফর হোসেন:  কিন্তু কবিতা তো ঘোর থেকেও আসে, যেটি সচেতনভাবে সম্পাদনার বিষয় থাকে না। যেমন কুবলাই খান কবিতা স্বপ্নে পেয়েছিলেন কোলরিজ। আপনার কাছে কবিতার ঘোর কতখানি কাজ করে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রত্যেক কবিই কোনো না কোনোভাবে ঘোরের ভেতর থাকেন। এমনও হয়েছে মধ্যরাতে উঠে লিখতে বসেছি। কখনো মনে হয়েছে, আমি মুখ পাইনি লেজ পেয়েছি। কবিতার শেষ লাইনটা তখন লিখে রেখেছি। এরপর উল্টোযাত্রায় শরীরটাকে তৈরি করতে হয়েছে। ঢাকা/তারা