শিল্প ও সাহিত্য

তারেক মাসুদ নিয়ে তর্কের পুনরাবৃত্তি

তারেক মাসুদকে ঘিরে ইতিহাসের যে তর্ক বা আলোচনা লতিয়ে উঠতে পারতো, তার অঙ্কুরোদ্‌গম হলেও বিকশিত হয়নি। তাঁর অকাল প্রয়াণের পর অনেকের লেখায় এর উপস্থিতি রয়েছে। এটা ঠিক ভাসমান শৈল চূড়ার মতো, আমরা তার সামান্যই দেখতে পাই, অধিকাংশ থাকে ডুবন্ত। ফলে এই শৈলখণ্ডে আঘাত পেয়ে বড় জলযানও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণেই হয়তো সেই তর্ক এগিয়ে নেয়া হয়নি। তবে তর্কটা অনেক দিন থেকেই বিদ্যমান; বলা যায়, অনেক দিন তা ক্রিয়াশীল থাকবে।

তর্কটা হচ্ছে- তারেক মাসুদ কী নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন? কাদের জন্য সিনেমা তৈরি করেন?

সিনেমা তৈরি নিজেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ; সেখানে সিনেমার কারিগরি এড়িয়ে ইতিহাসের তর্কে যাওয়া কতটা যৌক্তিক- এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার বিনোদন পাতার পাঠক ও তথাকথিক ‘লাইফ স্টাইল’, ‘ফ্যাশন’ ম্যাগাজিনের গ্রাহকদের কাছে তা স্বাভাবিক। এসব প্রকাশনার কোথাও সিনেমাকে ঐতিহাসিক নিরিখে দেখার চেষ্টা নেই। এমনকি সিনেমার কারিগরি দক্ষতা-ত্রুটি নিয়ে কথা বলার সক্ষমতা এই প্রতিবেদক বা চলচ্চিত্র কথকদের মধ্যে কমই দেখা যায়। তারা বরং স্থূল চিন্তার সিনেমা নিয়েও শরীর সর্বস্ব তারকা আলাপে আগ্রহী। অথচ সিনেমা ক্যামেরায় থাকে না; থাকে চিন্তায়, মগজে। বিনোদন সাংবাদিকরা এড়িয়ে যান- বিশ্বে চলচ্চিত্র মাধ্যম হচ্ছে মগজের পদাতিক বাহিনী। এই সৈন্য পুঁজি আর রাষ্ট্রের হাতে নিয়ন্ত্রিত। তার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন (হেজিমনি), এমনকি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ (ডমিনেট) করার জন্য ব্যবহার হয়। তাই কোনো দেশে সশস্ত্র আক্রমণের আগে দেখা যায় ওই দেশের বিরুদ্ধে নানা ভুলভাল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে অন্তর্জালে। যেমন আফগানিস্তানের পর ইরাকে মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের পক্ষে জনসমর্থন তলানিতে ঠেকলে, অস্কার আসরে পুরস্কৃত হয় ‘হার্ট লকার’। এই চলচ্চিত্রের নাম ছড়িয়ে পড়ে। তারপরই মার্কিন একদল তরুণকে হোয়াইট হাউসের সামনে আফগানিস্তানে আক্রমণের পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায়। নতুন করে বিনিয়োগ আসে ইরাক যুদ্ধের পক্ষে। আজকের দিনে আপাত যুদ্ধহীন দেশে পুলিশ ফ্র্যাঞ্চাইজি বা সাবেক সেনা সদস্যকে নায়ক করে যে সিনেমাগুলো তৈরি হয়, তা আসলে রাষ্ট্রের পুলিশিপনা ও সৈন্যদের পক্ষে সম্মতি আদায় (হেজিমনি) করার প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে ওই ধারার চলচ্চিত্র খুব কমই নির্মাণ করা হয়। তাই বলে বিষয়টা দূরের নয়। কেননা, সেটা কি আমাদের আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র? এখানেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ইতিহাসের তর্ক। এর প্রতি উদাসীন থেকে তো চিন্তাশীল লেখক-চলচ্চিত্রকার সেরা কর্ম উপহার দিতে পারেন না। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সেই তর্কে নতুন আলো পড়বে, এটা স্বাভাবিক। তারেক মাসুদ সেই পুরনো তর্কে নতুন করে আলো ফেলতে চেয়েছেন।

সাহিত্য-শিল্পে ইতিহাসের তর্ককে ‘আলোচ্য বিষয়’ হিসেবে আমাদের সামনে সুসংবদ্ধভাবে উপস্থাপন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মনন ও মনীষাপূর্ণ এই লেখক ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে বিষয়টিকে সবচেয়ে গভীরে নিয়ে গেছেন। বোধ করা যায়, তারেক মাসুদ এই আহমদ ছফার সান্নিধ্যে এসেই শেখ মোহাম্মদ (এসএম) সুলতানের ওপর ‘আদম সুরত’ প্রামাণ্য চিত্র তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এটা এতটাই প্রকাশ্য যে, বিষয়টি তাঁর রচনাসমগ্রের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করতে ছাড়েন নি প্রকাশক : ‘নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এবং নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না।’

তারেক মাসুদ অনেক লেখায়, বক্তৃতায় তেমনটা কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করেছেন। তারেক মাসুদের জীবনে আরেকজনের সান্নিধ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, অগ্রজ চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। বাংলা চলচ্চিত্র যে কজন কারিগরের হাতে চিন্তাসমৃদ্ধ ও নান্দনিক হতে পেরেছে, এর মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর সান্নিধ্যেই নিজের চিন্তা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন তারেক মাসুদ। ততদিনে (৮০-এর দশকে) তিনি নিজস্ব চলচ্চিত্রের ভাষা খুঁজে পেয়েছেন। এটাকে আহমদ ছফা থেকে আলমগীর কবিরে ‘উন্নিত’ হওয়া বলা যায়। অন্তত নিজের কক্ষ পথে যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ কাল বলা যায়। এই যাত্রা তাঁর প্রধান নির্মাণের দিকে তাকালেও আঁচ পাওয়া যায়। যেমন- প্রামাণ্য চিত্র: আদম সুরত (১৯৮৯) ও মুক্তির গান (১৯৯৯); পূণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র: মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও রানওয়ে (২০১০)। বিষয়টা বোঝার জন্য সেই ইতিহাসের তর্কে ফেরা যাক।

আমরা যে ইতিহাসের তর্কের কথা বলছি, তা লতিয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে। মানে, স্বাধীন দেশে মানুষের কোন পরিচয় মুখ্য হবে: জাতি না ধর্ম? বলা হয়ে থাকে, ধর্মের নামে নিপীড়ন মোকাবিলা করেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই জাতি পরিচয়ই মুখ্য হবে। কিন্তু স্বাধীনতা কি কেবল ’৭১-এর সশস্ত্রযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, না কি ’৪৭-এর দেশভাগের আকাঙ্ক্ষাকেও ধারণ করবে? এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী: মুক্তিযুদ্ধ সাতচল্লিশের দেশভাগের ভুল সংশোধন করেছে মাত্র, নতুন কিছু নয়; আরেক ব্যাখ্যা বলছে: মুক্তিযুদ্ধের ভেতরই লুকিয়ে আছে দেশভাগের আকাঙ্ক্ষা। কী সেই আকাঙ্ক্ষা? শব্দবন্ধে প্রকাশ করলে তা দাঁড়ায়: ‘বাঙালী’ নাকি ‘বাঙালী মুসলমান’ এই তর্ক। আহমদ ছফা এই দ্বিতীয় শব্দবন্ধে ছিলেন। ফলে তাঁর আলোচনায় এক রকম, যা প্রকাশ পেয়েছে ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ ও ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে। এর একটা কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার সময় ভারতে তথাকথিত ইহজাগতিকতার (সেক্যুলারিজম) আড়ালে বিকাশমান ‘হিন্দুত্ববাদ’ ও রাষ্ট্র হিসেবে ‘সম্প্রসারণবাদী’ নীতি (বর্তমান সময়ে যা সাম্রাজ্যবাদ-এ রূপ নিয়েছে বলে অনেক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেন) প্রতিরোধের জন্য ‘মুসলিমবাদ’কে সামনে আনা। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, খানিকটা ‘সেক্যুলার’ হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলী এমন একটা যুক্তিতেই সাম্প্রদায়িক দল ভারতের জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগ দিয়েছেন এবং নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন।

এর বিপরীত ব্যাখ্যাকাররা মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতাকে দেশের প্রধান, প্রায় ‘একমাত্র’ স্তম্ভ মনে করেন। ফলে দেশভাগ কিংবা তৎপূর্ব ইতিহাস প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। ছেদ পড়ে ধারাবাহিকতার; খণ্ডিত হয়ে যায় ইতিহাস। অথচ এই জনপদের ইতিহাস হাজার বছরের, আর স্বাধীনতাও একদিনে আসে নাই। তবু কেন এমন মাতাল উদযাপন, খণ্ডিত বয়ান? কে না বুঝবে, এর ভেতরে রাজনীতি আছে। যে কাহিনী বলে বলে নিজেদের আখের গুছানো যায়, গণমানুষের ইতিহাস বন্দী হয়ে পড়ে পারিবারিক খাঁচায়। সে রাজনীতির কথা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক। চলচ্চিত্রে ফেরা যাক।

তারেক মাসুদ বরং দ্রুতই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছেন। বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ভাষ্য তৈরি করতে চেয়েছেন। এই পথের প্রস্তুতি পর্বে বিপুল উৎসাহ আলমগীর কবিরের কাছে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফ্রান্স থেকে চলচ্চিত্র বিদ্যায় চৌকস পরিচালক কবির দেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর এ দেশসহ বিশ্বের সবখানেই বামপন্থী রাজনীতির যে প্রবল জোয়ার ছিল ফ্রান্সও তার বাইরে ছিল না। ফলে স্বাধীনতার পর জহির রায়হানের নেতৃত্বে একদল চলচ্চিত্রনির্মাতা চলচ্চিত্র শিল্পের যে পূর্ণ জাতীয়করণের পরিকল্পনা তৈরি করতে দেখা যায়, এ তারই প্রভাব। স্বাধীনতার পর আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ ও ‘সীমানা পেরিয়ে’ সিনেমায় শ্রেণি চিন্তার ওপর ভিত্তি করে চরিত্রগুলোর আচরণ করতে দেখা যায়। স্বাধীনতা পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ছাত্রদের ‘সংস্কৃতি সংসদ’ দেশের নাটক ও চলচ্চিত্রে প্রভাব রাখতো। ষাটের দশকে শুরু হলেও সত্তুরের দশকে বিকশিত হয় চলচ্চিত্র উৎসাহী তরুণদের সংগঠন ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’। বিশেষত মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্বে এই আন্দোলন আশির দশক ছাড়িয়ে সক্রীয় ছিল। বাংলাদেশে ভিন্নধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বোদ্ধা দর্শক তৈরিতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুরুতে জহির রায়হান, আলমগীর কবির তাদের সঙ্গে যুক্ত ও প্রভাবিত ছিলেন। পরে তারেক মাসুদও যুক্ত হন। আমাদের অনেক চলচ্চিত্র কথকরা তারেক মাসুদকে ওই দুই চলচ্চিত্রকারের ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার বলে মনে করেন। অবশ্য উত্তর প্রজন্ম হিসেবে এ-দেশিয় চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক ভাষ্য তৈরির চেষ্টা ছিল তাঁর। সে বিষয়ে আমরা ফিরব।

তারেক মাসুদকে ঘিরে যে তর্কের সম্ভাবনা ছিল, তার ফসল তিনি ঘরে তোলেন নাই। অথচ যাকে ঘিরে ইতিহাসের কোনো তর্কই ঘনীভূত হতে পারে না, তিনিই বরং সেই তর্ক উসকে দিয়ে ফায়দা নিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, অমিতাভ রেজা, যিনি চলচ্চিত্রকারের চেয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবেই পরিচিত। ‘আয়নাবাজি’ সিনেমা মুক্তির আগে তর্ক উসকে দিয়ে বললেন- তিনি বাঙালী মুসলমানদের জন্য সিনেমা তৈরি করেন। এরকম কোনো প্রসঙ্গই ছিল না তাঁর চলচ্চিত্রে। তবু ওই বাক্যটি ফেসবুকার, অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে বিপুল বিতর্কের জন্ম দিল। ফলে তাঁর সিনেমার বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করল। অবশ্য তর্কটা তাঁর চলচ্চিত্রের বাণিজ্য ছাপিয়ে যাওয়ার আগে, সময় বুঝে ঠিকই ভুল স্বীকার করে করায়ত্ব রেখেছেন। অথচ সিনেমাটি কোনো মাত্রায় তাঁর উত্তাপ বহন করে না, নিতান্তই বাণিজ্যিক মসলা ছাড়া। তারেক মাসুদ এই ধরনের চলচ্চিত্রকে চিহ্নিত করেছেন, ‘বাণিজ্যহীন বাণিজ্যিক সিনেমা’ হিসেবে। অর্থাৎ এই সিনেমাগুলো এতটাই স্থুল ও ক্লীশে যে, বিশ্বের সিনেমামোদীদের কাছে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও নেই। দেশের স্থুল ও বুদ্ধিবর্জিত দর্শকদের কেবল ঘণ্টাদুই প্রেক্ষাগৃহে আটকে রাখা মাত্র। বাণিজ্যের স্থুল মসলা হিসেবে মুক্তির আগে ‘সিনেমায় একটি চুম্বনের দৃশ্য ছিল, কিন্তু ফেলে দেয়া হয়েছে’, ‘নায়িকা ভীষণ বিব্রত ছিল’- এ ধরনের ‘সুরসুরি মার্কা’ বক্তব্য ছড়িয়ে তাকে আরেকটু বাড়িয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক। অথচ যে দৃশ্যটা বাদ দিয়েছেন, তাকে প্রচার করার কি-ই বা ছিল? কিন্তু সিনেমার অবস্থা অনেকটাই গোবরে পদ্ম ফুলের মতো ব্যাপার। এ তো জানাই আছে, গোবরে পদ্ম ফুটলে তাতে গোবরের খ্যাতি বাড়ে না, বরং গোবরকে আরো চোখে ধরিয়ে দেয়। ‘আয়নাবাজি’র এই ‘সাফল্য’ বুঝিয়ে দেয় দেশের অন্য চলচ্চিত্রগুলো কত স্থুল, বাণিজ্যহীন বাণিজ্যিক। জহির রায়হানের অসমাপ্ত চলচ্চিত্রের নাম ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। নামটি স্মরণে এলে মনে হয়, তিনি হয়তো আলোকময় শিল্প মাধ্যমের বাণিজ্যিক ও চিন্তাহীনতার গহ্বরে আলো ফেলতে চেয়েছিলেন। সে যাক, আমরা বরং তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের ভাষ্য দেখতে চাই। এবং দেখতে চাই, তাঁর সেই বিক্ষণের যথার্থতা কতটুকু। এজন্য তাঁর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র বিবেচনায় আনতে হবে।

একাধিক সাক্ষাৎকার, লেখা ও বক্তৃতায় তারেক মাসুদ বলেছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাছে কৃতজ্ঞ। অন্যান্য কারণের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কৃতজ্ঞ এ জন্য যে, এর মাধ্যমে তিনি মাদরাসা থেকে ‘মুক্তি’ পেয়েছেন। মুক্তি পেয়ে তিনি ভর্তি হয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় যেমন, এখনও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা উষ্মা বোধ আছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ইংরেজি ভাষীদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া বিদ্যায়তনে পড়ছেন তারা। নিশ্চয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় জগৎ সেরা শিক্ষায়তনের একটি। আমাদের কাছে ‘অক্সফোর্ড’ ও ‘ইংরেজি’ সমান দ্যোতনায় বাজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যি তা না হলেও ছায়াতুল্যে তৃপ্তি নেয়ার চেষ্টা করে। এটাই তাদের মুক্তি দিশা। তারেক মাসুদও এর বাইরে নন।

‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে, আনুর সাহেবি ইংরেজি বলিয়ে পিতা এখন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। অর্থ সম্পদ থাকতেও তিনি ধর্মীয় বোঝাপড়া থেকে আনুকে পাঠিয়ে ছিলেন মাদরাসায়। স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গভঙ্গের আগেই ‘ইংরেজি শিক্ষার’ বিরোধীতা করতে গিয়ে ইংরেজি ভাষাকেই উপেক্ষা করে, উপমহাদেশের মুসলিমরা গড়ে তুলেছেন মাদরাসা শিক্ষা। এই সুযোগে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের প্রচারণা ছিল, মাদরাসায় পড়ে মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে। আজকের দিনে যাকে বলবে, জঙ্গি হয়ে উঠছে। শুধু ভাষার প্রতি বিদ্বেষ থেকে ইংরেজি না জানার কারণে তার খেসারত মুসলমানরা কত বছর দিয়েছে তা অনেকটা সবার জানা। চলচ্চিত্রে আনুকে মাদরাসা থেকে মুক্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধ। চলচ্চিত্রের কাহিনি এখানেই শেষ। ভালো হতো আনুর জীবনের সংকট এখানেই শেষ হয়ে গেলে। কিন্তু আনুর জীবন তারপরও এগিয়ে যায়। তাহলে আজকের দিনে আনু ও তাঁর সন্তানের কী অবস্থা হবে? অনুকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা এখানে বুঝতে চাই- এই আনুর ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে?

ভাবা যাক, আজকের দিনে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থে আনু এখন সচ্ছল। একটা সরকারি অফিসে চাকরিও করে। তাঁর একটি ছেলে আছে। সন্তানের আগ্রহ দেশের ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। পিতার ভুল বুঝতে পেরে আনু তাতে সায় দিলেন। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আনুর সন্তান একদিন ‘জঙ্গি’ হয়ে গেল। আজকের সমাজতত্ত্বে এর ব্যাখ্যা কী? এর ব্যাখ্যা হলো দাসত্বের কারণ, পরিচয়ের সংকট ও ঔপনিবেশের করতলে বেড়া ওঠার ভেতরে। যে ভাষা তাঁর আশার ভাষা হয়ে ওঠে না, যে দেশ তাঁর সম্ভাবনার সবটুকু বিকশিত করতে পারে না, সেখানে ব্যবস্থা বদলের ‘শর্ট-কাট’ রাস্তার একটি হচ্ছে ‘জঙ্গিপনা’। আর কে না জানে, আইএস থেকে শুরু করে জঙ্গি ছাপ্পর মারা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর গোষ্ঠীর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ব্যবহার সব ওই পশ্চিমাদেশের আনুকূল্যে। ভাষা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘জঙ্গি’ হওয়ার গুরুতর সংযোগ নেই- কথাটি বোঝা যায় তারেক মাসুদের শেষ ছবি দেখলে।

মৃত্যুপূর্বে শেষ পূণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘রানওয়ে’তে মাদরাসা বিষয়টি ফিরে এসেছে রাজনৈতিক চেহারায়। আক্ষরিক অর্থ যা-ই হোক, ভাবার্থের দিক দিয়ে ‘রানওয়ে’র অনুবাদ ‘অবতরণ পথ’ ফেলে ‘উড্ডয়নের পথ’ মনে করেন সবাই। দেখা যায়, মাদরাসা পড়ুয়া রুহুল চাকরি পাচ্ছে না, সঙ্গ দোষে জঙ্গি দলে মিশে যায়। এখানে লক্ষ্যণীয়, রুহুলের হতাশা। কিন্তু এখন তো সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে প্রশাসনিকভাবে সাধারণ শিক্ষার সমগুরুত্ব ঘোষণা করেছে। এখন প্রশ্ন হলো- রুহুলরা ‘জঙ্গি’ হবে কি না?

শিক্ষা সনদের সমমর্যাদা ঘোষণার পরও দেশে জঙ্গি কাহিনি রয়ে গেছে। মাদরাসা শিক্ষাকে সাধারণের সমমান মর্যাদা দেয়ার পর তো কারো জঙ্গি হওয়ার কথা নয়! হালের রাষ্ট্রীয় কথন হচ্ছে: ‘আধুনিক’ শিক্ষা গ্রহণ করেও কেউ কেউ জঙ্গি হচ্ছে। এই বয়ানও এক সময় হয়তো ভুল হবে। কিন্তু এই যে মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের বন্দি দশা, দেশে জঙ্গিবাদের ঘোর, তা তো দূর হচ্ছে না! সে দিক দিয়ে তারেক মাসুদের জঙ্গি দর্শনের নৃ-তত্ত্ব সমসময়ের বয়ানে আক্রান্ত।

কথা হচ্ছে- মাদরাসা, ইংরেজি শিক্ষার কী গলদ আছে যে কারণে আমাদের জঙ্গি ধারণার বীজ অঙ্গুরোদ্‌গমের সুযোগ ঘটে? তা হলো, চাকরি সন্ধানের কারিকুলাম বাদ দিলে, শিক্ষা একজনকে যেভাবে চিন্তাশীল করে, দার্শনিকতা এনে দেয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তা পূরণ করে না। ফলে জঙ্গি মতাদর্শী হওয়াকে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম দায় এড়াতে পারে না। যে কারণে বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠ করার পরও বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে ওঠে না। ফলে জঙ্গি হওয়া তাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। প্রয়োজন হচ্ছে বিজ্ঞান মনস্কতা, বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতার পথ সুগম করা, পরিচয়ের সংকট দূর করা এবং অবশ্যই বৈষম্য কমিয়ে আনা। যে দেশের চিন্তার সর্বোচ্চ কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলো যোগ্যতা নয়, নির্লজ্জ দলীয়করণের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়; দুর্নীতি-মেরুদণ্ডহীনতার পরও ব্যর্থতা এড়িয়ে কোনো ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা ঘুষ দেইনি বলে ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই’, সে দেশে উগ্রবাদীদের জন্ম হবে- অস্বাভাবিক কী? এ জন্য শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায় না।

লেখা শেষ করার মতো তারেক মাসুদের সিনেমার শেষ দৃশ্যের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। চিরায়তভাবে শুভ পরিণয়ের মধ্য দিয়ে সিনেমা শেষ হওয়ার দুর্বলতায় তিনি ধরা দিয়েছিলেন। ‘মাটি ময়না’, ‘রানওয়ে’তে তা স্পষ্ট। এমনকি ‘মুক্তির গান’-এ মূল চিত্রে বিজয় মিছিলে গানের দলের অংশগ্রহণের দৃশ্য নেই। তবু তিনি বিজয়ের দৃশ্য দেখিয়েছেন। আলমগীর কবির যেমন প্রযোজকের চাপে ‘সীমানা পেরিয়ে’ সিনেমার কাহিনীতে অনিবার্য বিচ্ছেদকে আরোপিতভাবে মিলন দেখিয়ে ছিলেন। চিরায়ত গল্পের শেষ বাক্যের মতো ‘তারপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিল’ সমাপ্তি টানা। যেন মানুষ কোনোভাবেই চিন্তা নয়, তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে। অথচ জহির রায়হান, আলমগীর কবিরের মতো তারেক মাসুদও অকাল প্রয়াত হলেন। তাদের জীবনের স্বাভাবিক সমাপ্তি হয়নি। আমরা তাদের অনিবার্য শূন্যতা অনুভব করি। এর কারণ তাদের চলচ্চিত্র দক্ষতার সঙ্গে চিন্তার সমৃদ্ধি। ভালো সিনেমা হলো তাই, যা চিন্তাকে উসকে দেয়। তারেক মাসুদ আমাদের সেই কাজটি করেন। করেন নান্দনিক সিনেমা দিয়েই। এখানেই তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র তর্ক, ইতিহাস তর্ক করা বৃথা যায় না।

আলমগীর কবির যেমন বলেছিলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উত্থান মানেই এতকাল ধরে কাহিনি-সৃজনে অত্যাবশ্যক হয়ে থাকা কল্পনাশক্তির অবসান নয়। কল্পনাকে এখানে সূক্ষ্মভাবে আলাদা একটি ভূমিকায় নিযুক্ত করা হবে; নির্বাচন এবং আয়োজনের কাজে। যদিও পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য হয় সত্যকে তুলে ধরা, তাহলে বোধ এবং কল্পনার দায়িত্ব হবে বাস্তবের আবর্তে ধাঁধাময় বিশৃঙ্খলা থেকে সত্যকে ছেঁকে বের করা; কারণ সত্যমাত্রেই বাস্তব কিন্তু বাস্তবতার গোটাটাই সত্য নয়। এতে প্রমাণ হয় যে নির্মাতা অর্থাৎ যিনি সৃষ্টি করেন তার ভূমিকা আগের চেয়ে মহান এবং গুরুত্বপূর্ণ।’

 

তথ্যসূত্র : ১. মাদুলি, তারেক মাসুদ সংখ্যা, সম্পাদনা : অরবিন্দ চক্রবর্তী, ৭ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৭ ২. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, আলমগীর কবির, অনুবাদ : নাজিয়া আফরিন, কিউরিয়াস ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ৩. চলচ্চিত্র যাত্রা, তারেক মাসুদ, প্রথমা প্রকাশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ, মে  ২০১২ ৪. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, মুহম্মদ খসরু, পড়ুয়া প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৪

লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক

 

ঢাকা/তারা