শিল্প ও সাহিত্য

এখনো জ্যোৎস্না ফোটে রূপনগরে, আপনি ঘুমিয়ে আছেন মহানন্দার পাড়ে

জ্যোৎস্নাপাগল দু’জন লেখককে আমার খুব পছন্দ-  একজন মমতাজউদদীন আহমদ, অন্যজন হুমায়ূন আহমেদ। দু’জনই চিরতরে চলে গেছেন। জ্যোৎস্না বিলাস ছিল হুমায়ূন আহমেদের, তাঁর কথা আজ এখানে নয়, অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো ক্ষণে বলব। এখানে বলতে চাই- জ্যোৎস্নাপাগল আমাদের প্রিয় ভাষা-সংগ্রামী, প্রিয় শিক্ষাবিদ, প্রিয় নাট্যকার, প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় লেখক, প্রিয় কথক, প্রিয় বাঙালি পুরুষ মমতাজউদদীন আহমদকে নিয়ে সামান্য কিছু কথা।

কথাগুলো আবেগের, কথাগুলো এখন স্মৃতিতাড়িত, কথাগুলো এখন মর্মতাড়িত। কারণ এই কথাগুলো তিনি আর জানবেন না, শুনবেন না! তিনি তো চলে গেছেন- চিরতরে। গেছেন বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে, নাড়াবার ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর মেধা, বুদ্ধিমত্তা, মনন ও সৃজন শক্তি দিয়ে। বাংলাদেশের নাটককে, শিক্ষা-সংস্কৃতিকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। এই অভিযাত্রীর যাত্রাপথ আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে। আমিও বাংলাদেশ পক্ষের এই আবেগি মানুষটির সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হয়েছি। এই মুগ্ধতার কিছু অনুভূতি তুলে ধরছি।

ঢাকার মিরপুর, ৬ নম্বর সেকশন, ডি ব্লকের কাঁচা বাজার। মাছ কিনছেন চশমা পরিহিত কাঁচা-পাকা চুলের পরিণত বয়সের এক ভদ্রলোক। মাছ বিক্রেতা থেকে শুরু করে সবাই তাঁকে সমীহ করছে। কেউ হয়ত তাঁর নামও মনে করতে পারছে না। কেউ তাঁকে সালাম দিচ্ছে। উনি স্বভাবসুলভ মৃদু ভঙ্গিতে সালামের জবাব দিচ্ছেন। সমস্যাটা হচ্ছে কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে- কীভাবে মাছ কিনবেন তিনি? ভক্তদের কথার জবাব দিতেই সময় যাচ্ছে। আমার বাড়ির পাশেই এই বাজার। আমিও সেদিন মাছ কিনতে গেছি। একটু দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আমিও কাছে গেলাম। দেখলাম তিনি খুব চাপের মধ্যে আছেন। আমি সালাম দিয়ে বললাম, স্যার কেমন আছেন? হ্যাঁ ভালো, শিহাব তুমি কেমন আছো?

জি ভালো আছি। স্যার, একটু ভিড় হয়ে গেছে। আমি বললাম। আমার সেই মুহূর্তে মনে পড়ল- সম্ভবত এর দুই একদিন আগে তাঁর লেখা ও অভিনীত কোনো নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে- যে কারণে ভিড়। স্যার ভিড়ের মধ্যেই বাজার শেষ করে চলে গেলেন। যাবার আগে আমাকে বললেন, শিহাব বাসায় এসো। এই বলার মধ্যে যে স্নেহসুলভ আহ্বান তা আমাকে আকুল করল। বাজারের ব্যাগসহ রিকশায় উঠে আবারও আমাকে ইশারা দিয়ে ডেকে বললেন, আমার বাসা চেন তো? আমি বললাম, স্যার চিনি। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথকে- আমি চিনি গো চিনি...। আমি তৎক্ষণাৎ গর্ববোধও করলাম, মমতাজ স্যার আমার মহল্লাবাসী।

মমতাজ স্যারের বাসা রূপনগরে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদররা নিরীহ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করে সারা দেশে যে হাজার হাজার গণকবর তৈরি করেছিল- সেই গণকবরের দুটি গণকবর হলো মিরপুরের রূপনগর ও শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি বা গণকবর। স্যারের বাড়ি শিয়ালবাড়ি গণকবরের দক্ষিণ পাশের গলি দিয়ে ঢুকেই একটু ভিতরে। বাড়িটি দক্ষিণদুয়ারি। মনে আছে, একদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন আমাকে ফোনে বললেন, শিহাব, রাহমান ভাইয়ের বাসায় আসো। অর্থাৎ বাংলা কবিতার প্রধান কবি পুরুষ শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাসায়। আমি যথারীতি চলে গেলাম। তখন সকাল দশটা হবে। রাহমান ভাই তাঁর লেখার টেবিলে বসা। ঢুকেই দেখলাম, মামুন ভাই রাহমান ভাইয়ের ছবি তুলছেন। ছবি তোলা শেষ হলে মামুন ভাই বললেন, শিহাব চলো, এখন তোমাদের মিরপুর যাব। আমি বললাম, মিরপুরে কোথায়? কেন? মমতাজ ভাইয়ের বাসায়। আমি বললাম, উনার বাসা তো রূপনগর। হ্যাঁ, সেই বাসাতেই যেতে চাই। তোমার বাসার কাছে, তুমি তো চেন। 

আমরা একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে শ্যামলী থেকে রূপনগর এলাম। রূপনগর একটু নিরিবিলি, একটু গ্রামীণ পরিবেশ। আমরা মমতাজ স্যারের বাসার কলিংবেল চাপ দিতেই দু’তলা থেকে স্যার বললেন, গেট খুলতে লোক পাঠাচ্ছি। আমরা বাসায় ঢুকেই অন্য রকম একটা পরিবেশের খোঁজ পেলাম। সেটি হলো- একটু নিটোল, নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশ। স্যার এসে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সেই চিরাচরিত পোশাক- পাঞ্জাবি-পায়জামা, চোখে মোটা গ্লাসের চশমা। আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বসলেন সোফায়। তারপর গল্প শুরু করলেন। আপনারা যারা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট মিশেছেন, তারা জানেন, মমতাজ স্যার একজন অসাধারণ রসিক মানুষ। বলে রাখি, তিনি কিন্তু আমার সরাসরি শিক্ষক নন, কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষক থাকেন তারা সবারই স্যার। যেমন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মমতাজ স্যারকেও আমার কাছে তেমনি মনে হয়, তিনি ছোটদের সবার স্যার। আরো একটি কারণ আছে, সেটি হলো তাঁর সান্নিধ্যে গেলে, সব সময়ই কিছু না কিছু শেখা যায়। এই মানুষটি কম কথা বলার, কাজ বেশি করার মানুষ। জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা মানুষ। একজন মানবিক মানুষ। একজন বাংলাদেশ পক্ষের দৃঢ়চেতা মানুষ। যে মানুষটি নদী মহানন্দার ঘ্রাণ নাকে নিয়ে বড় হতে হতে বুড়িগঙ্গা থেকে নিয়েছেন জীবনের বাকি ঘ্রাণ। যিনি, যার চোখ দিয়ে বাঙালির জীবনাচরণ দেখেছেন, দীর্ঘ কাল। যে দেখাগুলো তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়, তাঁর কথায়, তাঁর অভিনয়ে।

তাঁর সামনে বসে হঠাৎ মনে পড়ল, এই মানুষটিই কী লিখেছেন, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’? যে নাটকটির মঞ্চায়ন দেখে আমি আলোড়িত হয়েছিলাম? কী ক্ষুরধার লেখা- আহা! স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুকে যিনি ঘৃণা করেছেন, থুথুর মতো। এই মুহূর্তে আমি মনে মনে পুলকিত হচ্ছি, তাঁর গৌরবময় কর্মবহরে। ভালই লাগছে, তাঁর সামনে বসে, তাঁরই কথা শুনে। তাঁর কথায় কখনো হাসছি, কখনো গম্ভীর হচ্ছি। একটু পরে তিনি উঠে গেলেন। আবার এলেন, ট্রে হাতে করে। বললেন, নাও মিষ্টি-চা। আমার মনে পড়ল, শাহ এ এস এম কিবরিয়ার কথা, তাঁকেও দেখেছি নিজ হাতে ট্রে হাতে ড্রয়িং রুমে বসতেন; বলছি যখন তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। আসলে এটিই বোধহয় বড় মানুষদের বিনয়, ভদ্রতা আর বৈশিষ্ট্য। তারপর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর রিডিং রুম ও লেখার টেবিলের কাছে।

এক বাক্যে বলি, মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর কক্ষ দেখে। বড় সুন্দর করে সাজানো তাঁর রিডিং রুম। ঘুরে ঘুরে দেখালেন, তাঁর বই, বুকসেলফ। বুঝলাম, একজন লেখকের পাঠ, লেখা ও সাধনার জন্যে কী নিবেদন আর আয়োজন থাকতে হয়। এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর দক্ষিণ দিকের বারান্দায়। বিশাল বারান্দা। বললেন, বাড়ি করতে হয় দক্ষিণদুয়ারি। আমি জানি, তারপরও তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন স্যার? উত্তরে বললেন, প্রকৃতির দুই সুবিধা পাওয়া চায়। এক. সূর্যের আলো, দুই. চাঁদের আলো। আমি দুটোই পাই। দিনে সূর্যের আর রাতে চাঁদের। জানো, পূর্ণিমা আলো আমাকে পরিপূর্ণ করে দেয়। জ্যোৎস্নার রং আমাকে উদ্ভাসিত করে। পূর্ণিমার রাতে আমি জ্যোৎস্নাপাগল হয়ে যাই। বাসায় থাকলে, প্রতি পূর্ণিমা রাতেই আমি পরিবারের সবাইকে নিয়ে এই বারান্দায় মাদুর পেতে বসে যাই। মেয়েকে বলি, মুড়ি-চা-কফি নিয়ে আসতে। ওরা নিয়ে আসে। তারপর এগুলো খাই, আড্ডা দিই আর পূর্ণিমার আলোয় গা ধুই। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই আড্ডা। আমি আবারও তাঁকে নিয়ে ভাবলাম, মহানন্দা পাড়ের এক কিশোরের রূপনগরে এসে জ্যোৎস্নাযাপনের আনন্দ-বয়ানের অনুভূতি- আহা!

এখানে একটু বলে রাখি- মমতাজ স্যার ও হুমায়ূন আহমেদের পূর্ণিমা-যাপন আমাকে দারুণ উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই আমি আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেছি, জ্যোৎস্না উদযাপন করা। আমরা প্রতি পূর্ণিমার রাতেই দল বেঁধে চলে যাই কালিগঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, বালি, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ-নদীর কাছে। প্রায় সারা রাত ধরে জ্যোৎস্না উদযাপনে চলে- নদী ভ্রমণ। ধন্যবাদ স্যার।

আরেকটি অনুভূতির কথা বলেই শেষ করি। নিউ ইয়র্ক। যাকে ভেদ করেছে হার্ডসন ও ইস্টার রিভার। সেই নিউ ইয়র্কে দেখা হলো মমতাজ স্যারের সঙ্গে। আমি লেখক হিসেবে মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহারা আমন্ত্রণে সেখানে বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে গিয়েছি। আর স্যার গিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই প্রিয়ভাজন হিসেবে এই সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার একজন বাহক হয়ে। জ্যাকসন হাইডে আমি আর সাংবাদিক দর্পণ কবির হাঁটছিলাম। দর্পণ বলল, শিহাব চলেন মমতাজ স্যার এখানে একটা অনুষ্ঠানে এসেছেন, দেখা করে আসি। বললাম, চলো। এরপর স‌্যারের সঙ্গে দেখা হলো। আমি সালাম দিতেই, উনি এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, শিহাব, তুমি কেমন আছো? তাঁর চোখে-মুখে আর শারীরিক আবেগ দেখে আমি নিজেই নার্ভাস হয়ে গেছি। বললাম, স্যার এখানে আপনি কেমন আছেন? ছলছল নয়নে উত্তর দিলেন, ভালো নেই! কেন স্যার? ভালো লাগছে না এখানে। স‌্যার বললেন, I miss Bangladesh.

আমিও একটু নীরব হয়ে গেলাম। আমরা হার্ডসনের পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকালাম আমাদের মহানন্দা আর ব্রহ্মপুত্রের বালুমাখা জলের চোখে। আহা নাড়ির টান মানুষকে কীভাবে নাড়ায়? তারপর আমি কয়েক দিন ফিরে এসেছি, স্যারও দায়িত্ব পালন শেষে কয়েক বছর পর তিনিও ফিরে এসেছেন আপন আলয়ে।  

মমতাজ স্যারের অভিনয় কেন জানি আমার ভালো লাগত। একটু অন্য রকম, একটু নাড়ানো জীবন্ত অভিনয়। সেই আশির দশকে, যখন আমার মিরপুরের বাসায় সাদা-কালো ছোট তানিন টেলিভিশনে স্যারের লেখা ও অভিনীত নাটক দেখতে সন্ধ্যা রাত পার করে দিতাম। পরিবারের সকলেই কখনো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম, কখনো সিরিয়াস হয়ে যেতাম অর্থাৎ তাঁর অভিনয়ের সাথে সাথে আমরাও উঠা-নামা করতাম। একইসঙ্গে মঞ্চ মাতাত তাঁর নাটক। বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের কাছে তিনি এভাবেই হয়ে উঠেছিলেন জননন্দিত নাট্যকার ও অভিনেতা। তাঁর ‘কী চাহ শঙ্খচিল’ ও ‘রাজা অনুস্বরের পালা’ নাটক দুটি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়েছে। বোঝা যায়- নাটক লেখায় তাঁর দক্ষতা।

সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহকে দিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলাম আমার কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায়। সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, তুমিও এসো। কিন্তু আমি যেতে পারিনি সময়ের কারণে। আহা সময়! সময় তো আর পেলাম না! এর কয়েক দিন পর শুনলাম, স্যার বসুন্ধরা অথবা বনানীতে চলে যাচ্ছেন মিরপুর থেকে। এরপর তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তুষার বলল, শিহাব ভাই স্যারের সাক্ষাৎকারটি শেষ করা যায়নি, আরো একদিন যেতে হবে। বললাম, যাও, আমাকেও সঙ্গে নিও। আর কী যাওয়া হলো? আর কী দেখা হলো তাঁর সঙ্গে? দেখা হবেও না কোনোদিন? স্যার আমাদের ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আমরা তো আছি বুড়িগঙ্গার পাড়ে। স্যার, আপনি কোথায় গেলেন? স্যার, আপনার রূপনগরে এখনো জ্যোৎস্না ফোটে আর আপনি ঘুমিয়ে আছেন মহানন্দার পাড়ে? 

 

ঢাকা/তারা