শিল্প ও সাহিত্য

ষাটের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি

অন্য দশটি দিনের মতোই আরেকটি দিন। আনন্দময় ব্যতিক্রম কেবল এটুকুই যে সেই প্রথম শ্রাবণের মতো (মা’র মুখে যার গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি) এ শ্রাবণও তার বহুমাত্রিক পেখম মেলে দিয়েছিল পূর্ণ বিভায়। কালো মেয়ে- সে কী তার রূপের গরিমা! দিগন্তপ্লাবী সে কী সম্মোহন! ইচ্ছে হয়, তার মেঘ-মখমল কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।

কীই-বা এমন তফাৎ! নিদ্রার সঙ্গে মৃত্যুর দূরত্ব এখন আর দৃশ্যমান নয়। অতিভক্তদের ভক্তির আতিশয্যে কত জীবিত মানুষই তো মৃত হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন! (যেখানে প্রায়শ শোকের সাড়ম্বর হাঁকডাককেও ছাপিয়ে উঠছে ফেসবুকে দ্রুত অধিকসংখ্যক ‘লাইক’ পাওয়ার আকুলতা।) তাদের আগ্রাসন ঠেকাতে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের শুভানুধ্যায়ীদের টানা তিনদিন ধরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানাতে হয়েছিল যে- তিনি ভালো আছেন। মামুন ভাই ভাগ্যবান। কারণ মৃত্যুর পরে কী হয় বা হবে, তা দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। আর জাতি হিসেবে আমাদের মনস্তত্ত্ব তো সর্বজনবিদিত। বড় খেদের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘মড়া ছাড়া তোমাদের কিছুই রোচে না!’

আমারও একবার মরে গিয়ে ফিরে এসে দেখতে ইচ্ছে হয় সেইসব! কিন্তু সাধু উপায়ে সেটা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছে, বিশেষ বিশেষ জন্মদিনগুলো হলো সেই জানালা- যা দিয়ে কিছুটা হলেও মৃত্যুপরবর্তী সেই নাটকীয় দৃশ্যাবলির স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে নিশ্চিতভাবে বিশাল এক ফাঁক (খানিকটা ফাঁকিও) কিন্তু থেকে যায়। এদেশে মৃত্যুর পরে মৃত ব্যক্তিটিকে ঘিরে শোক-উচ্ছ্বাসের যে-বন্যা বয়ে যায় তাতে আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বর থাকলেও স্বার্থগন্ধী হিসাবনিকাশ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। কিন্তু জীবিতদের ক্ষেত্রে হিসাবটা ভিন্ন। বিশেষ করে বিশিষ্টজনদের জন্মদিনে যে আয়োজনগুলো হয় সেখানে স্বার্থগন্ধী হিসাবী হাওয়ার তোড়ে প্রকৃত ভালোবাসারা গ্রামের গরিব আত্মীয়ের মতো কাছেই ঘেঁষতে পারে না।

আমি বিশিষ্টজন নই। তবু (বালাই) ষাট বলে কথা! (আমি কখনোই ৩০ অতিক্রম করতে চাইনি। কিন্তু দশচক্রে ভূত সাজতে হলেও আমি আমৃত্যু ৩০ই থাকতে চাই।) যদি বলি আমার ষাটতম জন্মদিনকে ঘিরে শুভেচ্ছা আর উপহারের বন্যা বয়ে গেছে- তাহলে অসত্য বলা হবে। অনেকেই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন নানাভাবে। লিখিত প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। তাদের বড় অংশই আমার দীর্ঘ পথযাত্রার ভ্রমণসঙ্গী। তারা আমার আনন্দবেদনার সঙ্গী। অস্তিত্বের অংশ। সেজন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌজন্য প্রকাশের অপারগতা আমাকে কখনোই তেমন পীড়িত করেনি। ব্যাপারটা এমন যে কারো কারো সঙ্গে আমার কথা হয় না বছরের পর বছর। কিন্তু তার বা তাদের সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের যোগ সার্বক্ষণিক। আবার কারো সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হয়, কথা হয় কিন্তু হৃদয় তার অবয়বটিও মনে রাখে না।

তবু ষাটের জানালা দিয়ে আমি আমাকে দেখেছি। নিজেকে আরেকবার মেপে নিয়েছি কফির চামচ দিয়ে। প্রাপ্তি প্রত্যাশার চেয়ে কিঞ্চিৎ অধিকই মনে হয়েছে। বেশিরভাগই অযাচিত। ক্ষ্যাপার পরশপাথর খোঁজার মতো করে আমি যেই তৃষ্ণার জল খুঁজে ফিরছি দশকের পর দশক ধরে, মনে হয়েছে তা সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। এবং আশ্বস্ত হয়েছি যে সবকিছু পঁচে গেলেও যার ওপর আমার আজন্মের অগাধ বিশ্বাস সেই ভালোবাসার শক্তি এখনো সূর্যের মতো দীপ্যমান। ভালোবাসা অবধ্য। তাকে হত্যার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু অমরত্বের বেলায় এ-কথা খাটে না।

করোনাও একটি জানালা। সেই জানালা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আমরা নক্ষত্র পতন  দেখছি। তাদের কেউ ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে, কেউবা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির। কিন্তু পাতা ঝরার এ মিছিলে কে কাকে মনে রাখে! মনে রাখা না রাখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ একটি কবিতা আছে। নামটি এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সুগভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি বলছেন, যা কিছু দরকারি মনে করে তিনি আজীবন আগলে রেখেছিলেন সেগুলোকে এখন মনে হচ্ছে: ‘শুধু ধূলি শুধু ছাই’; আর যা কিছু অদরকারি মনে করে ছুড়ে ফেলেছিলেন সেগুলোই সত্যিকারের সোনার ফসল হয়ে রয়ে গেছে। কবির ভাষায়, কেবল সেগুলোই ‘রয় রয় রয়’। অমরত্বের স্বাদ ও সাধনা- সে ভিন্ন জিনিস। আমাদের মতো ছাপোষা উদরজীবী মানুষের জন্যে শ্রাবণের সম্মোহনই কি যথেষ্ট নয়?

এমনকী ভালোবাসাও বিনিময় চায়। আমার সমবয়সী আমার খুব পছন্দের এক কবিবন্ধু (নাম বলে তাকে ধ্যানভ্রষ্ট করতে চাই না) যার প্রতিভা ও পরিশ্রমের শক্তি ঈর্ষণীয়- তাকেও দেখি প্রায় আক্ষেপ করছেন ফেসবুকের বন্ধুরা তার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী নয় বলে। আমি তাকে বলি, এসব লাইক-টাইকে কিছু যায় আসে না। সবই বুদবুদ। এ জন্মদিনে সত্যি সত্যি সেইরকম একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। আমার সমবয়সী আরেক প্রবাসী কবিবন্ধু গাঁটের পয়সা খরচ করে ফোনে তার রাগ-ক্ষোভ-অভিমান সবই উগড়ে দিলেন আমার ওপর। কারণ (তাঁর অভিযোগ) তিনি ফেসবুকে নানা উপলক্ষে আমাকে নিয়ে দুচার লাইন লিখলেও আমি কখনোই তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দিইনি! কথাটি সত্য। লাইকের বদলে লাইক! কমেন্টের বদলে কমেন্ট! আপনি আমার কবিতায় লাইক দিলে আমিও (পছন্দ হোক বা না হোক) আপনার কবিতার লাইক দেব- এ প্রত্যাশা খুবই যৌক্তিক। আমার অক্ষমতা হলো, জীবিকার লড়াইয়ে আমি এত ব্যতিব্যস্ত থাকি যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি তা পারি না। আমি আমার প্রতিভাবান কবিবন্ধুটিকে বলি, দেয়া-নেয়ার এ কুশলী খেলায় জিততে গিয়ে আসল খেলায় হেরে যাওয়াটা তার মতো মেধাবী কবির কাছে কখনোই কাম্য হতে পারে না।

মুশকিল হলো, আসল খেলাটি যে কী সেটি তো আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।  ফেসবুকের দেয়াল আর মহাকালের দেয়াল যে এক নয়, সেটা কে কাকে বোঝাবে! মহাকালের দেয়ালে নিজের নামটি খোদাই করাই কি তবে সৃষ্টিশীল মানুষের আসল কাজ? আমি অত শত ভাবি না। প্রতিটি শ্রাবণ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, সময় ফুরিয়ে আসছে। এবার সে বাদ্যটা ছিল আরও কর্কশ। (আমার প্রায় সমবয়সী বিশিষ্ট সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান সম্প্রতি খুব খোলামেলাভাবে বয়সের সেই জটিল হিসাবটি তুলে ধরেছেন নিজের বাকি জীবনের বিশদ একটি কর্মপরিকল্পনাসহ। অত্যন্ত সহজ ও সংযমী ভাষায়  লেখা সাবলীল এ বয়ানটি আমার ভাবনার বৃত্তকে দারুণভাবে ছুঁয়ে গেছে।) করোনাপূর্ব সময়ে আমিও সেভাবেই ভাবতাম। এখন করোনা এসে যখন দরোজার কড়া নাড়ছে তখন প্রায়শ পরিকল্পনার ‘পরি’ উড়ে যায়, পড়ে থাকে কেবল ডানাভাঙা ‘কল্পনা’।

যে-কথাটি বলার জন্যে এত কথা বলা সেটি হলো, প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে মূল্যবান মনে হয়। প্রাণভরে পূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে সময়ের সেই গ্লাসে চুমুক দেওয়া তীব্র তাগিদ অনুভব করি নিজের ভেতরে। সম্ভবত গীতায় স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় বলে একটি কথা আছে। যার যাতে আনন্দ সে সেভাবেই জীবনকে যাপন করুক- সরাসরি একথা বলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু সঠিক উপলব্ধির অভাবে এ-বক্তব্য আবার সাহেদ-সাবরিনাদের মতো মানুষকে উৎসাহিত করতে পারে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের নিজের আনন্দকে  খুঁজে নেওয়া দরকার। কারণ সবার আনন্দের ক্ষেত্র ও ধরন একরকম নয়। জরুরি জিজ্ঞাসাটি হলো, আনন্দ থাকে কোথায়? আমার তো মনে হয়, আনন্দ থাকে মনুষ্যত্বের কল্যাণে, আনন্দ থাকে ভালোবাসায়। নিজেকে যত বিলিয়ে দেওয়া যায়, বিলীন করে  দেওয়া যায় পরার্থপরতায়- তত বেশি করে তা ফিরে আসে আমাদের কাছে। জগতে আনন্দই সম্ভবত একমাত্র জিনিস যা দানে বাড়ে। আমার এ সামান্য জীবনে সত্যি সত্যিই সেই ভালোবাসার স্বাদ আমি পেয়েছি। এখন আমার ঘুমিয়ে যেতে কোনো খেদ বা আক্ষেপ  নেই।

কিন্তু শ্রাবণের দ্রুত বদলে যাওয়া অবোধ্য আকাশ আমার এ হঠকারী আত্মমুগ্ধতাকে বিদ্রূপ করছে। বলছে: ‘মাইলস টু গো বিফোর ... স্লিপ’।

লেখক: কবি। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

 

ঢাকা/তারা