শিল্প ও সাহিত্য

শামসুর রাহমানের কবিতার শক্তি ও প্রত্যয়

শামসুর রাহমান নিজে মোটেই সাহসী মানুষ ছিলেন না। কথা বলতেন খুব কম। খুবই নম্র স্বভাবের ছিলেন। তাঁকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে মৌলবাদীরা আক্রমণ করেছিল। তাঁকে সিলেটে যেতে দেয়নি এই মৌলবাদীরাই; ১৯৯৫ সালে।

কবিকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়েছে এই বাংলাদেশে। এমনকি তিনি যখন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট দেহরক্ষা করেন, তখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় মৌলবাদী রাজাকারপুষ্ট সরকার।কবি কি তাঁর যোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন?

না, পাননি। কেন পাননি? এই প্রশ্নটি এখনও অনেক প্রগতিবাদীদের করতে শুনি না। তিনি তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন। আমরা তাঁর মৃত্যুর পর যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি কেন?

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বলেছেন, ‘শামসুর রাহমান আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় কবি।’ আমি তাঁকে প্রশ্ন করি- কীভাবে? ব্যাখ্যা করুন। সুনীল বলেন, ‘বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে; বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্রের জন্ম আমরা দেখেছি। শামসুর রাহমান এই রাষ্ট্রের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের একজন বীর শব্দসৈনিক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়, সেগুলো ছিল অসাধারণ! আনন্দবাজার প্রকাশনা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রাহমানের এই সম্পৃক্তির কথা আমি জানতাম।’

শামসুর রাহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসনের যাতাকল, স্বৈরাচারী শাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা, প্রজন্মের জন্য পরিশুদ্ধ বাংলাদেশ ইত্যাদি বিষয়ে যে স্মরণীয় কবিতাগুলো লিখেছেন তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্য কোনো কবি লেখেননি। এটা আমাদের অজানা নয়।

সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, শামসুর রাহমানকে দেখলে এতোটা দ্রোহী মনে হতো না, যতটা স্বাক্ষর তিনি তাঁর কবিতায় রেখে গিয়েছেন। কবিতায় তাঁর শক্তি ছিল অপরিসীম। তাঁর প্রত্যয় ছিল অদম্য। শামসুর রাহমান শুধু কবিতাই লেখেননি, তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞ সংগঠক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’-এর জন্ম হয়। সেই সময়ের রাষ্ট্রীয় দৈনিক ‘দৈনিক বাংলা’ থেকে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান পদত্যাগ করেন। আমাদের মনে আছে, একই সময় দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদ কবিতা কেন্দ্র ও এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে তখন ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোশাররফ করিম প্রমুখ।

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন দখল করতে এরশাদের রক্তচক্ষু প্রতিহত করতেই জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্ম হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিবাদ-চিত্র কামরুল হাসানের ‘দেশ এখন বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক পোস্টারটির জন্ম হয়েছিল এই কবিতা পরিষদ উৎসবেই। এটি হয় ১৯৮৮ সালের জাতীয় কবিতা উৎসবে। কবিতা পরিষদের দ্বিতীয় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের সভাপতি ছিলেন শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান।

বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ছিলেন এ মঞ্চে। তাঁর পাশেই বসেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। হঠাৎ তিনি ঢলে পড়লেন। দ্রুত সবাই ধরাধরি করে তাকে তুলে দিলেন শেখ হাসিনার গাড়িতে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। শামসুর রাহমান দৃঢ় কণ্ঠে সেদিন বলেছিলেন, মানুষ যেমন রাজনীতিমুক্ত নয়, তেমনি একজন কবি, শিল্প-সমাজ ও দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এই রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই আমাদের কবিতা উৎসবের মর্মবাণী ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’।

এই ছিলেন শামসুর রাহমান। আমাদের উজ্জ্বল স্মৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৮৭ সালের ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক মোহনায় কবির সভাপতিত্বে বেগম সুফিয়া কামাল জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন দর্শক সারিতে বসে কবিতা শুনেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। একইসঙ্গে সেদিন দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষের সহযোগিতা ও সমর্থন চেয়েছিলেন কবি। শামসুর রাহমান এভাবেই এই দেশে একটি প্রগতিশীল কাব্যকাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি কবিতায় রাজনৈতিক শ্লোগান পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, কবিতা হবে শিল্পিত আভার প্রতিবিম্ব। তিনি শাব্দিক প্রতিবাদ করেছেন বড় কোমল ভাষায়। যা গণমানুষের হৃদয়ে গেঁথেছে। বুকে বেজেছে। যেমন:

‘ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও, কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও, ফুর্তি করো সবান্ধব সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি, স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ। যখন যা খুশি মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার তোমরা সবাই। যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে, কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা। সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।’ [বন্দী শিবির থেকে]

‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রূপে-সুরে এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরুলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার- ইত্যাদি উপমায় অভিষিক্ত করেছেন। আর এসবই হচ্ছে বাঙালি জাতিসত্তার কাব্যিক ঢেউ। যে বাঁক নির্মাণে তিনি দেখিয়েছেন একক প্রভুত্ব। বাংলাদেশের মানুষের মজ্জায় মিশে আছে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির মতো মৌলিক বিষয়গুলো। রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস।

আমার মনে পড়ছে শেষ বয়সে এসেও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শামসুর রাহমান। তিনি খুব সাহসেই উচ্চারণ করেছিলেন:

‘এদেশের প্রতিটি গোলাপ উচ্চারণ করে তোমার নাম, প্রতিটি গাছের সবুজ পাতা, লতাগুল্ম আবৃত্তি করে তোমার জীবন; প্রত্যে সুকণ্ঠ পাখি তোমার নামের গান ছড়িয়ে দেয় খোলা রাস্তায়, মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে, নিঃস্ব বস্তিতে। খরগোশের লাল বোতামের মতো চোখে কাঁপে তোমার নাম। তোমার দিগন্ত-কাঁপানো আন্দোলনের গাথা বাঙ্ময় হয় প্রতিটি নদীর উৎসমুখে, পাহাড়ি কুটিরের বিষণ্নতায়, বিপন্ন মানুষের আর্তিতে। তোমার নাম আমাদের হৃৎস্পন্দন, আমাদের আক্রান্ত অতীতের ইতিহাস, আমাদের আহত গৌরবের সোনালি দুপুর, আমাদের মৈত্রীর পূর্ণিমা-রাত।’ [শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙ্‌ক্তিমালা ]

শামসুর রাহমান শেষবার যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, এর কিছুদিন আগে ফোনে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার কোনো অভিযোগ নেই ফকির ইলিয়াস! আমি খুবই সামান্য মানুষ। কবিতা লিখতে এসেছিলাম। লেখা শেষ করে চলে যাবো; যাবোই তো। কেউ আমাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিলো কিনা তাতে কি-বা যায় আসে! আমি তো অগণিত পাঠকের ভালোবাসা পেয়ে গেলাম!’

এমনই ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় রাহমান ভাই। তিনি বলতেন, ‘আমি তো আর কিছুই করতে পারি না, তাই কবিতা লিখি।’ তাঁর অত্যন্ত বলিষ্ঠ যে কথাটি সবসময় আমার কানে বাজে, তা হলো: ‘আপনি আজ এমপি আছেন, কাল থাকবেন না। আপনি আজ মন্ত্রী আছেন, কাল থাকবেন না। কিন্তু একজ কবি চিরদিন কবি-ই থেকে যাবেন। কেউ তাঁকে এসে বলতে পারবে না, আপনি এই আসনটি ছাড়ুন- আমি বসি।’

তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। নিউইয়র্কে আড্ডায়, সমুদ্র-পাড়ে, কফিশপে, সাহিত্য অনুষ্ঠানে অনেক কথা বিনিময় করেছি। তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি। যে গুণটি আমাদের অনেকের মাঝেই নেই। রাহমানের অনেক কবিতা উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আমি আজকের নবীন পাঠককে শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠের বিনীত আহ্বান জানাই। তারা তা পড়লে জানতে পারবে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও চাওয়া-পাওয়ার অনেক ইতিহাসের ইতিবৃত্ত। কবির প্রয়াণ দিবসে আমার শ্রদ্ধা।