আবদুল মান্নান পলাশ‘ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙ্গালে / জানি না জানি না আমার এ ঘুম কেন ভাঙ্গালে / যার পথ চেয়ে দিন গুনেছি, আজ তার পদধ্বনি শুনেছি / ও বাতাস কেন আজ বাঁশি তব বাঁজায়ে / দিলে তুমি এ হৃদয় সাঁজায়ে। লতা মুকেঙ্গশকারের গাওয়া কালজয়ী এ গান শিমুল-পলাশকে ভীষণ মনে করিয়ে দেয় আমাদের। শিমুল-পলাশকে ভালোবাসে না -এমন কে আছে? ‘তুমি ফুল ভালোবাস বলে-তোমাকে ফুলের বৃন্তে মাঙ্গলিক উৎসবের মতো লাগে বলে-আমাকে ফুলের খোঁজে যেতে হয় পথ খুঁজে খুঁজে-সিন্দুনদ, হিন্দুকুশ, হরপ্পার মতো দূরান্তরে।” কবি পুর্ণেন্দু পত্রী ফুল খুঁজতে সিন্দুনদ-হিন্দুকুশে গেলেও আমাদের অতো দূরান্তরে যাবার দরকার নেই। পলাশ-শিমুল আমাদের কাছের ফুল। বাঙ্গালীর ফুল। ফাল্গুনের-বসন্তের ভালোবাসার ফুল। বিরহ-বিদ্রোহের প্রতীক। বনে আগুন দু’রকমে লাগে। একটি দাবানলের আগুন। আরেকটি সাহিত্যের আগুন। অর্থাৎ বসন্তের পলাশ ফোঁটার আগুন। পলাশের নাম জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যেমন ভার, তেমনি পলাশকে চেনেনা এমন মানুষ আছে কি? ফুলটির ইংরেজি নাম বড়ই অদ্ভূত। ‘ফ্লেম অব দ্যা ফরেষ্ট’ অর্থাৎ বনের আগুনের স্ফুলিঙ্গ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা এমনটিই লিখেছেন তার ‘ফুলগুলো যেন কথা’ বইটিতে।‘ও শিমুল বন দাও রাঙ্গিয়ে মন / কৃষ্ণচূড়া দোপাটি আর পলাশ দিলো ডাক / মধুর লোভে ভীড় জমালো মৌ পিয়াসী অলির ঝাঁক।’ বসন্তের মাতাল সমীরণের টকটকে লাল বর্ণচ্ছটায় মন রাঙ্গানো শিমুল-পলাশ প্রকৃতিতে এনে দেয় বসন্ত বিভা। বাঙ্গালীর জীবনাচরণে সংস্কৃতির আবাহনে বসন্তে শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা হৃদয়কে সাজায়। প্রেম-ভালোবাসার সমীরণে দেয় তোলে ঢেউ। জীবনের কোন এক অধ্যায়ে প্রণয়ের মধুরিমায় শিমুল পলাশেরা আবেগে ছন্দায়িত করে তোলে মন। পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়া শুধু যে মনকে ভালোবাসায় রাঙ্গায়, তাই নয়। জ্বালিয়ে দিতে পারে বিদ্রোহের দাবানল। যেমনটি দিয়েছিলো, ৫২’র এই ফেব্রুয়ারিতে, বাংলা ভাষার দাবিতে। শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়াকে চেনার মহিমা এনে দিয়েছিলো তারাই।‘এ জীবনে যতটুকু চেয়েছি মনে হয় তারও বেশী পেয়েছি / ও আকাশ কেন আজ এতো আলো ছড়ায়ে’। -আকাশে আলো ছড়িয়েই যেন কথা কয় দীর্ঘ দেহের শিমুল। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে এই বাংলায় শিমুল এসেছে। ইংরেজি নাম সিল্ক কটন। বৈজ্ঞানিক নাম বোমবাক্স সিইবা। মালভেসি গোত্রভূক্ত। পাতাঝড়ে ফাগুনের মধ্যভাগ থেকে চৈত্র পর্যন্ত। বসন্তের এই সময়টায় ফুল ফুটে বৈশাখে ঝরে যায়। ট্রপিক্যাক জাতীয় এই গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে। শালিক পাখি এর অন্যতম। শিমুলের তুলো হয়। উড়ে বেড়ায় বাতাসে। শিমুল কাঠে ম্যাচের কাঠি, বরফের কাঠি ভালো হয়। শিমুলে গাছে ১৮ রকম হারবাল ওষুধ হয়।আর পলাশ..। শীতের কষাঘাতে যখন পাতা ঝরে যায়। তখন রিক্ত পলাশের কোল জুড়ে হেসে ওঠে রক্তিম পলাশ ফুল। নবীন পাতার সমারোহে বনজুড়ে দেখা দেয় পলাশের রক্তমিছিল। তখনই শিল্পী তপন চৌধুরী গেয়ে ওঠেন-‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে / এসেছে দারুণ মাস / আমি জেনে গেছি তুমি আসিবে না ফিওে / মিটিবে না পিয়াস।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পলাশের লাল দেখে লিখেছিলেন-‘পলাশের কুঁড়ি / একরাত্রে বর্ণবহ্নি জ্বলিল সমস্ত বনজুড়ি।’ দ্বিজেন শর্মা তার বইয়ে লিখেছেন-মাঝারি আকারের পত্রমোচী দেশীগাছ। তিনটি পত্র নিয়ে যৌগিকপত্র। ফুল ফোঁটে বসন্তে। ৭.৫ থেকে ১০ সে.মি. শিম ফুলের মতো। বাংলা সাহিত্যে পলাশের প্রভাব অতিশয়। শামসুর রাহমান থেকে হালের টোকন ঠাকুর পর্যন্ত। শিমুল-পলাশের ভালোবাসার কথাও লিখে শেষ হবার নয়। রাইজিংবিডি / শাহ মতিন টিপু