শিল্প ও সাহিত্য

মহত্তম কবিবন্ধু রেজাউদ্দিন স্টালিন

এখনকার মতন বাংলাদেশে যাওয়া-আসা বা যোগাযোগ করা সহজ ছিল না গত শতকের আটের দশকে। আমাদের বন্ধু ‘সাংস্কৃতিক খবর’ পত্রিকার কাজল চক্রবর্তীর কীভাবে যেন বাংলাদেশে অনেক যোগাযোগ ছিল। কাজল ছিল ভালো সংগঠক। সেই সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ কবি সম্মেলন আয়োজন করত আবৃত্তিলোক। কবি সম্মেলন কবিতা উৎসবে পর্যবসিত হয়েছিল। আমাদের তখন ২৬/২৭ বছর বয়স, খুব একটা কল্কে পেতাম না ওই কবিতা উৎসবে। কাজলকে বললাম আমরাও এরকম একটা কিছু করি না কেন? আমাদের সমবয়সীদের নিয়ে। আমাদের সামর্থ্য অল্প, কিন্তু আমাদের মতনই করি। সেই উপলক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে ‘সাংস্কৃতিক খবর’ আয়োজিত কবিতা উৎসবে বাংলাদেশ থেকে আমাদের সমসাময়িক কয়েকজন কবিবন্ধু আসেন যাদের মধ্যে প্রথম আলাপেই দুজনের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে তাদের একজন রেজাউদ্দিন স্টালিন, অন্যজন সমরেশ দেবনাথ। সেই সময়, অর্থাৎ আটের দশকের শেষে বা নয়ের দশকের গোড়ায় রেজাউদ্দিনকে দেখতাম প্রায়ই কলকাতা আসতে। প্রথম থেকেই আমি ওকে রেজা নামে ডাকতাম, যা পরে ‘দোস্ত’ সম্বোধনে গিয়ে দাঁড়ায়। রেজা আসা মানেই যেন এক ঝলক অন্য বাতাস। ও প্রাণবন্ত, ও আন্তরিক, ও বন্ধুবৎসল, সর্বোপরি ওর কবিতা অন্যরকম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রেজাউদ্দিন স্টালিন ও ওর সমসাময়িকদের বলা যেতে পারে বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের কবি। অগ্রজ কবিদের লেখায় তখন দেশবন্দনা, মাতৃভূমির জয়গান, তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জনের অনুভূতি। তারই প্রভাবে এই নতুন প্রজন্ম প্রভাবিত। কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ সবই বহির্মুখীন, সর্বোপরি অন্তর্মুখীনতা কম। সেই সময়ে রেজার কবিতায় অন্তর্মুখীনতার সুর আমরা পেতাম, যা ওকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল সমসাময়িকদের থেকে। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই নানান অস্থিরতা আর টালবাহানা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করেছে। ফলে কখনো যেমন আসা-যাওয়া সহজ হয়েছে, কখনো আবার প্রায় বন্ধও থেকেছে। বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বেলাল চৌধুরী, তিনি যেন কীভাবে ইচ্ছেমতন ভারতে চলে আসতে পারতেন, আবার ফিরেও যেতেন। এই পর্যায়ে রেজার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, যদিও আমি সাধ্যমতো ওর খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করতাম। উত্তর তিরিশের রেজা তখন বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের অন্যতম আধিকারিক, নজরুল গবেষণা ও নজরুল সাহিত্য প্রচারের গুরুদায়িত্ব ওর উপরে। ও মাঝে-মধ্যে কলকাতা আসত খবর পেতাম, কিন্তু যোগাযোগ ঘটত না। আমি প্রথম বাংলাদেশে যাই ২০০৬ সালে। যথারীতি পুরোনো বন্ধু রেজার খোঁজ করি, সে সময় ও ঢাকার বাইরে ছিল, ফলে দেখা হলো না। ২০১২ সাল থেকে মূলত চাকরিসূত্রে আমার নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত শুরু। ২০১৭ অবধি অব্যাহত ছিল। সেই সময় যে তরুণ কবিদের সঙ্গে আলাপিত হচ্ছিলাম, তাদের কবিতা শুনছিলাম, বেশ বুঝতে পারছিলাম কাব্যভাষা বদলাচ্ছে। সরাসরি কথা বলছে না, কবিতা হয়েছে অন্তর্মুখী। সেই সময় দু-একবার দূরভাষে কথা হলেও কখনো দেখা হবার অবকাশ হয়নি। সোস্যাল মিডিয়াতে রেজা বোধ হয় খুব সক্রিয় নয়, ফলে ফেসবুক আসার পরও যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি ওর সঙ্গে। কোভিড পরিস্থিতি ও প্যান্ডেমিক জনিত কারণে গৃহবন্দী অবস্থায় বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় যে লাইভ অনুষ্ঠানের বিস্ফোরণ সম্প্রতি ঘটে গিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটেই রেজাকে আবার খুঁজে পাওয়া, আবার যোগোযোগ। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, যেখানে ছেড়ে এসেছিলাম, সেখান থেকেই শুরু করতে পারছি। কোথাও কোনো জড়তা নেই। একসময় লিখেছিলাম—যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে জেনো/ ভালোবাসা মরে না কখনো। রেজাকে বলতে ইচ্ছে করেছিল, প্রকৃত বন্ধুত্বও মরে না কখনো। আমাদের বন্ধুত্ব বেঁচে আছে আজও ৩৫ বছর। স্টালিনের প্রথম বইয়ের নাম ফিরিনি অবাধ্য আমি, অসাধারণ কবিতাটি ছাপা হয়েছিল দেশ পত্রিকায়। এই ৪ টা লাইন এখনও মনে আছে…

‘‘আমার কিসের তৃষ্ণা পথ না ঘরের পাবার না হারাবার বুঝতে পারি না নিজের বিরুদ্ধে তাই ক্ষমাহীন পাথর সাজাই সারাদিন নুডি ও তৃষ্ণা কাঁধে পথে পথে ঘুরি’’

এবার এই করোনাকালে পুনর্যোগাযোগ রেজার সাথে। বেশকিছু কবিতা শোনার (লাইভ অনুষ্ঠানে) ও কবিতা পড়ার সুযোগ হল। রেজার এখন নিজস্ব কাব্যভাষা গড়ে উঠেছে, ওর কবিতায় দর্শন প্রাধান্য পায় ফর্মের চেয়েও। ওর সাম্প্রতিক কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে কবিতার অন্তর্নিহিত দর্শনই ঠিক করে দেয় ফর্ম। বাংলাদেশের সামগ্রিক কবিতা অনেক বদলে গিয়েছে, এই বদলে রেজাউদ্দিনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, সাম্প্রতিক লেখায়ও আরো পরিণত, আরো মগ্ন। জীবনকে, পৃথিবীকে ও দেখে নিজের ভিতর দিয়ে। একজন কবিকে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে, নিজের লেখার কাছে সৎ থাকতে হয়। রেজা নিজের কবিতার কাছে সৎ। তাই ও লিখতে পারে ‘এক মৃত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার’ এর মতো কবিতা যেখানে গনগনে গলায় মৃতের ভান করে থাকা একজন প্রশ্ন করে—জীবিতের ভান করে কি লাভ বলুন? দৃশ্যের পর দৃশ্য তৈরি করে কবিতার ভিতরে যে গল্প রেজা দাঁড় করায়, সেই গল্পের আড়ালেও আসলে গ্রথিত করে কবির দর্শন, যা শিল্পের শিকড়। সহজ কথায়, গভীর উচ্চারণ ওর সহজাত। আত্মবিশ্বাস ওর চরিত্রেরই একটা অঙ্গ যা প্রতিফলিত হয় ওর কবিতায়। তাই ও লিখতে পারে— ‘আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা আমার জন্মের আগে পৃথিবীতে কোনো লগ্ন ছিল না আমার চিৎকারই পৃথিবীর প্রথম সূচনা।’ রেজাউদ্দিন স্ট্যালিনকে আমি আমার বিশেষ বন্ধু মনে করি। কত বছর হয়ে গেল ওর সঙ্গে আড্ডা হয় না। আমি অপেক্ষা করে আছি এই প্যান্ডেমিকের শেষে কবে ওর সঙ্গে দেখা হবে আবার, সামনাসামনি শুনব কবিতা, সেই তিরিশ বছর আগের মতন।